বুড়িগঙ্গা আর ধলেশ্বরী বেষ্টিত এক কর্মমুখর জনপদের নাম কেরানীগঞ্জ। গার্মেন্টস, জাহাজ নির্মাণ, ইটভাটা এবং মেড ইন জিনজিরা খ্যাত দেশীয় শিল্পপণ্যের বড় বাজার গড়ে উঠেছে এখানে। হাজার হাজার কারখানা, লাখ লাখ শ্রমি, কেরানীগঞ্জের প্রতিটি ধুলোমাখা সকাল আর ক্লান্ত দুপুর সাক্ষ্য দেয় এক গোপন ত্যাগের, যে ত্যাগে দাঁড়িয়ে আছে দেশের শিল্প-অর্থনীতি।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, কেরানীগঞ্জের গার্মেন্টস পল্লীর ১০ হাজার কারখানায় কমবেশি ১০ লাখ নারী-পুরুষ প্রতিদিন কাজ করছেন ১০ থেকে ১২ ঘণ্টা। তাদের মধ্যে অনেকে নামমাত্র মজুরিতে মাস পেরিয়ে দেন। অথচ দেশেরব ৮৫ ভাগ প্যান্ট, রেডিমেড কাপড় জোগান দেন তারা। কাজের চাপে অসুস্থতা, দুর্ঘটনা বা ওভারটাইম বকেয়া হয়ে থাকলেও অভিযোগের জায়গা খুব সীমিত।
নারী শ্রমিক সেলিনা বেগম জানান, কাজ না করলে ছাঁটাই, প্রতিবাদ করলে চাকরি যাবে এই ভয় নিয়ে প্রতিদিন মেশিনে বসি। কিন্তু আমরা তো মানুষ, মেশিন না। আমাদের পক্ষে কথা বলার কেউ নেই, কাজ করলে খাবার জোটে না গেলে উপস থাকা ছাড়া উপায় নেই। আর অধিকার তো বিলাসিতা।
কেরানীগঞ্জের দক্ষিণাংশে গড়ে ওঠা জাহাজ নির্মাণ ও মেরামত শিল্পেও শ্রমিকরা কাজ করছেন সীমাহীন ঝুঁকি নিয়ে। নিরাপত্তা সরঞ্জামের অভাব, দুর্ঘটনার শঙ্কা ও চিকিৎসা সুবিধার ঘাটতি প্রতিনিয়ত তাদের জীবনের অংশ হয়ে গেছে।
এক শ্রমিক শহিদুল বলেন, লোহার কাঠামোতে কাজ করতে গিয়ে হাত-পা কেটে যায়, কেউ খোঁজও নেয় না। দিনে ১৪ ঘণ্টা কাজ করি, তবুও মাস শেষে টানাটানি।
ইটভাটায় ঘাম, ধুলা আর অনিশ্চয় জীবন শ্রমিকদের।শীতকাল এলেই কেরানীগঞ্জের ইটভাটাগুলোতে কাজের চাপ বেড়ে যায়। শ্রমিকরা ভোর থেকে রাত পর্যন্ত পুরো পরিবার নিয়ে কাজ করেন ইট ভাটায়। অধিকাংশ শ্রমিক মৌসুমি, তারা নামমাত্র মজুরিতে ও চুক্তিবিহীনভাবে কাজ করেন।
ইটভাটা শ্রমিক হাকিম মিয়া বলেন, ভাটায় কাজ করলেও আমাদের কারও পরিচয় কাগজে-কলমে নেই। কেউ মারা গেলেও ক্ষতিপূরণ মেলে না। স্ত্রী সন্তানসহ কাজ করেও মৌসুম গেলে না খেয়ে থাকতে হয়।
মেড ইন জিনজিরা ব্র্যান্ডের আড়ালে শ্রমিক বাস্তবতা মেনে নেওয়া যায় না। কেরানীগঞ্জের অন্যতম গর্ব ‘মেড ইন জিনজিরা’ পণ্য। প্রবাদ রয়েছে জিনজিরার দক্ষ শ্রমিকরা যেকোনো একটি কাজ একবার দেখলে হুবহু তা করে দিতে পারেন। এমনকি যেটা দেখে কাজটি করেন তার চেয়ে ভালো কাজ করে দিতে পারেন জিনজিরার শ্রমিকরা।
তারা এখন কৃষি উপকরণ, খাদ্য প্রক্রিয়াকরণ, মেশিন, গাড়ি, রেলওয়েসহ বিভিন্ন খাতের যন্ত্র ও যন্ত্রাংশ তৈরি করেন দক্ষ হাতে। সারা দেশে যে যন্ত্রের ব্যবহার হচ্ছে তার বিরাট অংশ তৈরি হয় জিনজিরা ও তার আশপাশের ছোট ছোট কারখানায় , জিনজিরার যন্ত্রের জন্য বিদেশনির্ভরতাও কমেছে অনেক। তবে এ শিল্পেও শ্রমিকরা কাজ করছেন নিরাপত্তাহীন পরিবেশে, অনেক সময় অস্থায়ী চুক্তিতে, জীবন ফেলছে ঝুঁকিতে।
কেরানীগঞ্জের এক কারখানা মালিক মো. হারুন অর রশীদ বলেন, শ্রমিকদের অধিকার আমরা গুরুত্ব দিই। তবে খরচ ও চ্যালেঞ্জ বেড়েছে অনেক। সরকার যদি প্রণোদনা দেয়, শ্রমিক কল্যাণ নিশ্চিত করা সহজ হবে।
শ্রমিক অধিকারকর্মী ফারজানা চৌধুরী বলেন, কেরানীগঞ্জ দেশের অন্যতম শিল্পভিত্তিক এলাকা হলেও এখানকার শ্রমিকরা এখনও অরক্ষিত। আইনের প্রয়োগ এবং সামাজিক সুরক্ষা নিশ্চিত না হলে এই শ্রমিকরা দিনের শেষে শুধু পরিশ্রান্ত ইতিহাস হয়েই থাকবেন।
মে দিবসে নতুন প্রত্যাশা
মে দিবস এলেই কেরানীগঞ্জে বিভিন্ন শ্রমিক সংগঠন ও উপজেলা প্রশাসন আলোচনা সভা, সচেতনতামূলক প্রচার এবং র্যালির আয়োজন করেছে। আলোচনায় উঠে এসেছে ন্যায্য মজুরি, নিয়োগপত্র, চিকিৎসা সুবিধা এবং ওভারটাইম বোনাসের মতো গুরুত্বপূর্ণ দাবিগুলো। তবে দাবীগুলো যেনো শুধু টেবিলে আর কাগজ কলমেই সীমাবদ্ধ থেকে যায়।
কেরানীগঞ্জের এই শিল্পভিত্তি শুধু শ্রমিকদের ঘামে গড়া নয়, এটি পুরো দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। মে দিবস তাই এই শ্রমিকদের নয়, আমাদের সকলের উপলব্ধির দিন হওয়া উচিত।শ্রমিক শুধু উৎপাদনের অংশ নয়, তিনি অর্থনীতির সম্মানিত নির্মাতা।
কেকে/ এমএস