দেশের আলোচিত সাত খুনের সময় রোজা ছিল মাতৃগর্ভে। পৃথিবীতে আসার পর যখন সবকিছু বুঝতে পারে তখন থেকেই মায়ের কাছেই জানতে পারে বাবা হত্যার কথা। এরপর থেকেই বিচারের আশায় অপেক্ষায় আছে কিশোরী রোজা। রোজার বয়স এখন ১১ বছর। সে নিহত জাহাঙ্গীরের মেয়ে। জাহাঙ্গীর সাত খুনে নিহত আরেক হতভাগ্য স্বপনের গাড়িচালক। শুধু রোজা নয়, রায় কার্যকর দেখতে সাত খুনের শিকার প্রতিটি পরিবারের সদস্যরাই প্রতীক্ষার প্রহর গুনছে।
আগামী ২৭ এপ্রিল রোববার এ বহুল আলোচিত সাত খুন ঘটনার ১১ বছর পূর্ণ হচ্ছে। এর মধ্যে আলোচিত রায়েরও পেরিয়ে গেছে ৮টি বছর। উচ্চ আদালতে সেই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল চলছে। কিন্তু গত আগস্টে পতন ঘটেছে আওয়ামী লীগ সরকারের। নিহতের পরিবারগুলোর শঙ্কা, সরকার আন্তরিক না হলে এর বিচার আরও প্রলম্বিত করতে পারে প্রভাবশালীরা। তাছাড়া এ মামলায় মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেন একসময় বিএনপি করতেন। সুবিধা পেতে আবারো ফিরে যেতে পারেন পুরনো দলে।
বহুল আলোচিত এ মামলাটির বিচারের দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। সর্বশেষ ২০১৭ সালে ৩৫ আসামির মধ্যে ১৫ জনকে মৃত্যুদণ্ড, ১১ জনকে যাবজ্জীবন এবং ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেন উচ্চ আদালত। মামলাটি এখন চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য অপেক্ষায় রয়েছে।
এদিকে বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট সাখাওয়াত হোসেন খান জানান, চূড়ান্ত নিষ্পত্তির অপেক্ষায় রয়েছে ২০১৪ সালের বহুল আলোচিত নারায়ণগঞ্জের সাত খুন মামলার বিচার। এর মধ্যে বিচারের দুটি ধাপ শেষ হয়েছে। হত্যাকাণ্ডের পর তিন বছরের মধ্যে দুটি ধাপে বিচারিক আদালত ও হাইকোর্টে শেষ হয় বিচার। পরে সেই মামলার চূড়ান্ত বিচার সাত বছর ধরে আপিল বিভাগে ঝুলে আছে। দীর্ঘ সময় ধরে আপিলসহ ডেথ রেফারেন্স (আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) আবেদন নিষ্পত্তি না হওয়ায় হতাশা ব্যক্ত করেছেন নিহতের পরিবার ও স্বজন। রায় দ্রুত কার্যকরের দাবি তাদের।
২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকারসহ সাতজন। তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে ভেসে ওঠে ছয় লাশ। পরদিন খোঁজ মেলে আরেক লাশের। এ ঘটনায় স্থানীয় আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন ও র্যাবের কয়েকজন সদস্য জড়িত ছিলেন, যা নিয়ে দেশজুড়ে তোলপাড় হয়।
২৭ এপ্রিল নারায়ণগঞ্জ আদালতে মামলায় হাজিরা দিয়ে সিদ্ধিরগঞ্জের নিজ বাসভবনে ফেরার পথে অপহৃত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, আইনজীবী চন্দন সরকার, নজরুলের বন্ধু মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম, লিটন, জাহাঙ্গীর আলম ও চন্দন সরকারের গাড়িচালক মো. ইব্রাহীম। পরে শীতলক্ষ্যা থেকে উদ্ধার হয় তাদের মরদেহ। এ ঘটনায় নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি ও চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল বাদী হয়ে ফতুল্লা থানায় দুটি মামলা করেন। মামলায় ২০১৬ সালের ১৬ জানুয়ারি রায় দেন বিচারিক আদালত। রায়ে ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড ও ৯ জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। পরে রায়ের বিরুদ্ধে হাইকোর্টে আপিল করেন ২৮ আসামি। ২০১৭ সালের ২২ আগস্ট বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডাদেশ পাওয়া ১১ আসামিকে যাবজ্জীবন এবং বাকি ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রাখেন হাইকোর্ট।
রায়ের পর্যবেক্ষণে হাইকোর্ট বলেন, র্যাব একটি এলিট ফোর্স। তারা মানুষের জানমাল রক্ষার জন্য বহুবিধ কাজ করছে। কিছু ব্যক্তির জন্য সামগ্রিকভাবে এ বাহিনীকে দায়ী করা যায় না। আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছে, যদি তারা ছাড়া পায়, তাহলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে। এর পর হাইকোর্টে ওই রায়ের বিরুদ্ধে প্রধান আসামি র্যাব কর্মকর্তা তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেনসহ ১৫ আসামি আপিল বিভাগে আবেদন করেন। অন্যদিকে যাবজ্জীবন ও বিভিন্ন মেয়াদে দণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা বাড়াতে আপিল করে রাষ্ট্রপক্ষ, যা শুনানির অপেক্ষায় রয়েছে।
হাইকোর্টের মৃত্যুদণ্ড বহাল থাকা ১৫ আসামি হলেন র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল (অব.) তারেক সাঈদ মোহাম্মদ, সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (অব.) আরিফ হোসেন, লে. কমান্ডার (চাকরিচ্যুত) এম মাসুদ রানা, সাবেক কাউন্সিলর ও আওয়ামী লীগ নেতা নূর হোসেন, ল্যান্সনায়েক বেলাল হোসেন, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, আরওজি-১ মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্সনায়েক হিরা মিয়া, সিপাহি আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।
মৃত্যুদণ্ড পরিবর্তন হয়ে যাবজ্জীবনপ্রাপ্ত ১১ আসামি হলেন- সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন। এদের মধ্যে পলাতক পাঁচ আসামি হলেন- সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন, সৈনিক তাজুল ইসলাম, নূর হোসেনের সহকারী সানাউল্লাহ সানা ও ম্যানেজার শাহজাহান। এ ছাড়া বিচারিক আদালতের রায়ে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ডপ্রাপ্ত ৯ আসামিও র্যাবের বরখাস্ত কর্মকর্তা ও সদস্য। তাদের মধ্যে কনস্টেবল (পরে এএসআই পদে পদোন্নতি পেয়ে নৌ থানায় কর্মরত) হাবিবুর রহমানের ১৭ বছর, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, কনস্টেবল বাবুল হাসান, করপোরাল মোখলেসুর রহমান, ল্যান্স করপোরাল রুহুল আমিন ও সিপাহি নুরুজ্জামানের ১০ বছর করে এবং এএসআই বজলুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিন সাত বছর করে কারাদণ্ডাদেশ উচ্চ আদালতে বহাল রয়েছে। তাদের মধ্যে মোখলেসুর রহমান ও কামাল হোসেন পলাতক।
আপিল শুনানির বিষয়ে আসামি নূর হোসেনের আইনজীবী এস আর এন লুৎফর রহমান আকন্দ বলেন, ‘আপিল বিভাগে একসময় তিনটি বেঞ্চে মামলা পরিচালনা হতো। এখন বিচারকের অপর্যাপ্ততা থাকায় একটি বেঞ্চে বিচারকাজ সম্পন্ন হচ্ছে। ফলে পুরোনো মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়া পিছিয়েছে। মামলাটি এখন শুনানির জন্য আপিল বিভাগের সিরিয়ালে নেই। অগ্রাধিকার ভিত্তিতে দ্রুত নিষ্পত্তির ব্যবস্থা নিলে চলতি বছরেই মামলাটি নিষ্পত্তি হতে পারে।’
মামলার বাদী বিজয় কুমার পাল বলেন, ‘আমরা হতাশ। উচ্চ আদালতের দিকে তাকিয়ে আছি।’ তিনি জানান, শিগগির অ্যাটর্নি জেনারেলের সঙ্গে দেখা করে মামলাটি দ্রুত নিষ্পত্তির বিষয়ে প্রধান বিচারপতি কাছে আবেদন করার জন্য অনুরোধ করবেন। মামলার অপর বাদী সেলিনা ইসলাম বিউটি বলেন, ‘আসামিরা প্রভাবশালী। রায় কার্যকর আদৌ দেখে যেতে পারব কিনা, জানা নেই।’
কেকে/এআর