ভোলার চরফ্যাশনে মেঘনা ও তেঁতুলীয়া নদীতে প্রকাশ্যে অবাধে শিকার বাগদা ও গলদা চিংড়ির রেনু পোনা। উপজেলার ২০ ঘাটে প্রায় সহস্রাধিক ভ্রাম্যমান জেলে ৫ সিন্ডিকেটের মাধ্যমে নদীতে বাগদা ও গলদা রেনুর নির্বিচারে নিধন করেছে বিভিন্ন প্রজাতির রেনু পোনা। মৎস্য বিভাগসহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের কোন তৎপরতা না থাকায় বাগদা ও গলদা পোনা নিধনের মহোৎসব চালিয়ে যাচ্ছে অসাধু চক্র। রেনু পোনা নিধনের ফলে প্রতিনিয়ত ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
অভিযোগ আছে, সিন্ডিকেট চক্রের মুল হোতা আড়ত মালিক মাদ্রাজ এলাকার ইউপি সদস্য রাসেল, পাঁচ কপাট এলাকার মো. ইউনুস, ঘোষের হাট এলাকার তেঁতুলিয়া নদীতে জাহাঙ্গীর, চরমানিকা ইউনিয়নের চর কচ্চপিয়া এলাকার জাকির ফকির ও মো. ছাবের প্রশাসনের কর্তাদের ম্যানেজ করে নাম মাত্র দাদন দিয়ে ভ্রাম্যমান জেলেদের দিয়ে শিকার করাচ্ছেন চিংড়ি রেনু পোনা। ভ্রাম্যমান জেলেদের কাছ থেকে স্থানীয় পাইকারদের মাধ্যমে রেনু সংগ্রহ করে ওই সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য আড়ত মালিকরা রাতের আঁধারে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করছেন।
স্থানীয় সুত্রে জানা যায়, নদী পাড়ের বেশী সংখ্যক মানুষই অভাবগ্রস্ত পরিবারের সদস্য। এদের মধ্যে রয়েছে নারী ও শিশু কিশোররা। অসাধু রেনু নিধনকারী চক্ররা এসব ভাসমান জেলেদের দাদনের ফাঁদে ফেলে উপার্জনের লোভ দেখিয়ে নাম মাত্র দাদন দিয়ে বাধ্য করেন রেনু পোনা নিধনে। মেঘনা ও তেঁতুলিয়ার তীরবর্তী অভাবী পরিবারের শিশু কিশোর লেখাপড়া বাদ দিয়ে সাময়িক ভাবে নেমে পড়েছে রেনু পোনা শিকারে। মেঘনা ও তেঁতুলীয়া নদীর প্রায় ২০টি স্থানে অসাধু আড়ত মালিকরা ভ্রাম্যমান সাধারন জেলেদের দিয়ে ভারতীয় ভাসা জাল দিয়ে শিকার করাচ্ছে রেনু পোনা। এসব রেনু পোনা সংখ্যা গুনে নির্ধারিত মূল্য দিয়ে নিয়ে আসা হয়ে বিভিন্ন আড়তে। আড়ত থেকে রাতের আঁধারে পাচার হয় দেশের বিভিন্ন জেলাতে। ভাসা জালে বাগদা ও গলদা রেনু নির্বিচারে শিকারের ফলে ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতীর মাছের পোনা।
মেঘনা ও তেঁতুলীয়ার বিভিন্ন স্থানে ঘুরে দেখা যায়, নদীর পাড়ে টং ঘর নির্মান করে নদীতে জাল ফেলে বাগদা ও গলদা রেনুপোনা আহরনে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। কেউ বা গুনে গুনে ব্যারেল ভর্তি করছেন আড়তে পাঠানোর জন্য। নদীর পাড়ের ভাসমান জেলেদের টং ঘরে ছুটে আসছে স্থানীয় পাইকাররা। আড়তদারদের বেধে দেয়া নির্ধারিত মূল্য পরিশোধ করেই নিয়ে যাচ্ছেন নিজের অড়তে। নেই প্রশাসনের কোন তৎপরতা। এ সুযোগে স্থানীয় পাইকারদের চুক্তি ভিত্তিক ভাসমান জেলেরা অবাধে শিকার করছেন রেনুপোনা। এতে বাগদা ও গলদা রেনুর পাশাপাশি ধ্বংস হচ্ছে বিভিন্ন প্রজাতির মাছের পোনা।
জেলেদের সুত্রে জানা যায়, উপজেলার বাগদা ও গলদা রেনুর ৫ আড়ত মালিকদের অধিনে প্রায় শতাধিক খুচরা পাইকার রয়েছে। তারা চুক্তিভিত্তিক ভাবে স্থানীয় পাইকারদের কাছ ১০ হাজার থেকে ১৫ হাজার টাকা দাদন নিয়ে নদীতে রেনুপোনা শিকার করেন। আড়তদারদের অধিনস্থ ওইসব স্থানীয় পাইকাররা ভ্রাম্যমান জেলেদের কাছ থেকে ১০০ রেনু পোনা ২০ টাকা করে কিনে নেন। এবং পাইকাররা জেলেদের কাছ থেকে গুনে নিয়ে ব্যারেল ভর্তি করে আড়ত মালিকদের কাছে নিয়ে যান। ওই আড়ত মালিকরা সংগ্রহ করা রেনু পোনা খুলনা, সাতক্ষীরা মংলা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে চালান করে থাকেন।
স্থানীয় বাসিন্দাদের ভাষ্য, ভারতের তৈরী বিশেষ এক প্রকার জাল ও ভাসা জাল দিয়ে চলছে পোনা শিকার।কিন্তু পোনা শিকারীরা পোনা শিকার করতে গিয়ে প্রতিদিন অন্যান্য প্রজাতির অসংখ্য মাছের রেনু পোনা এবং মাছের জলজ খাদ্যকনা বিনষ্ট করে চলছে। এতে নদীতে এসব মাছ বিলুপ্ত ও খাদ্য সংকট দেখা দিতে পারে।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে এক আড়ত মালিক জানান, প্রতিদিন চরফ্যাশনে বেতুয়া, ঘোষেরহাট, বকসি, সামরাজ, গাছিরখালসহ বিভিন্ন ঘাট থেকে সংগ্রহ করা হয় বাগদা ও রেনু পোনা। এসব পোনা তারা খুচরা পাইকারদের কাছ থেকে ১০০ পোনা ৩০ টাকা করে কিনে তারা ট্রাক বা ট্রলার যোগে খুলনা, সাতক্ষীরা মংলা, বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলায় চালান করে থাকেন। বাগদা ও গলদা রেনু পোনার স্বর্ণের মতো দাম ও দেশের বিভিন্ন খামারীদের কাছে ব্যাপক চাহিদা থাকায় তার মোকামে চড়া মূল্যে বিক্রি করে থাকেন। তবে তাদের দাবী প্রশাসনের লোকজনসহ প্রত্যেক ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয় তাদের। এজন্যই বেশী সময় তারা এসব পোনা রাতের আধারে চালান করে থাকেন।
ভাসমান রেনু শিকারী জেলে মো. বাবুল জানান, পেটের দায়ে পাইকার মনির এর কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা দাদন নিয়ে মেঘনা নদীতে বাগদা ও গলদার রেনু শিকার করছি। সে আমার কাছ থেকে ১০০ পোনা ২০ টাকা দরে কিনে নেন। এরইকম আমার মতো অসংখ্য জেলে রয়েছে সাধারন পাইকারদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে মেঘনা নদীতে রেনু শিকার করছেন।
জেলে মো. জসিম উদ্দিন জানান, পাইকার জাহাঙ্গীর ও হারুনের কাছ থেকে ১০ হাজার টাকা করে ১৫ হাজার টাকা দাদন নিয়েছি। আমার তিনটি ভাসা জাল রয়েছে। সেইগুলো দিয়ে প্রতিদিন বাগদা ও গলদার রেনু শিকার করে পাইকারদের কাছে বিক্রি করে রোজ ৫০০ থেকে ১০০০ টাকা আয় করছি।
পাইকার মনির হোসেন জানান,তার অধীনে ২০ জন জেলে রয়েছে। তাদেরকে দাদন দিয়ে রাখা হয়েছে। সে জেলেদের কাছ থেকে রেনু ক্রয় করে আড়ত মালিক ইউপি সদস্য রাসেলের নিকট বিক্রি করা হয়।তিনি দেশের বিভিন্ন জেলায় রপ্তানী করে থাকেন।
আড়ত মালিক ইউপি সদস্য রাসেল জানান, প্রশাসনকে ম্যানেজ করে ব্যবসা চালাতে হয়। পাইকারদের নিকট থেকে বাগদা ও গলদার রেনু ক্রয় করে সাতক্ষীরা, খুলনা ও বাগেরহাটসহ দেশের বিভিন্ন জেলাতে চালান করতে গিয়ে ঘাটে ঘাটে চাঁদা দিতে হয়।
উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা জয়ন্ত কুমার অপু জানান, আমাদের অভিযান অব্যহত আছে। জাল পুড়িয়েও রুগতে পরা যাচ্ছেনা জেলেদের। ছোট ছোট জাল নিয়ে ভ্রাম্যমাণ জেলেরা নদীতে বাগদা ও গলদা রেনু শিকারে নেমে পড়ে। আমারা অভিযানে যাওয়ার আগে জেলেরা পালিয়ে যায়। তবে দ্রুত সময়ের মধ্যে অভিযান আরো জোরদার হবে। তবে মৎস্য বিভাগেকে ম্যানেজের বিষয়টি সঠিক নয়।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব জানান, চরফ্যাশন মৎস্য অফিস কেন এখনো বাগদা ও গলদা রেনু শিকারের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করেনি, এই বিষয়ে আমি যথাযথ ব্যবস্থা নিব। যারা এই ব্যবসার সাথে জড়িত তাদের বিরুদ্ধেও আমি ব্যবস্থা নিচ্ছি।
উপজেলা নিবার্হী কর্মকর্তা রাসনা শারমিন মিথি জানান, আমি মৎস্য দফতরের সাথে আলাপ করে দ্রুত সময়ের মধ্যে বাগদা ও গলদা রেনু শিকারের বিরুদ্ধে অভিযান পরিচালনা করা হবে। তবে প্রশাসনকে ম্যানেজের বিষয়টি খতিয়ে দেখে আমি পরবর্তী ব্যবস্থা গ্রহণ করবো।
কেকে/ এমএস