ঢাকা, বুধবার, ১৭ এপ্রিল ২০২৪ | ৩ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

করোনাকাল ও নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য

স্বাতী চৌধুরী
🕐 ৭:১৮ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ১০, ২০২০

করোনাকাল আমাদের দেশের সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্য ব্যবস্থাপনার যে অন্তঃসারশূন্য ও বেহাল দশা চোখে আঙুল দিয়ে দেখিয়ে দিয়েছে সেখানে নারীর স্বাস্থ্য বিশেষ করে তার প্রজনন স্বাস্থ্যব্যবস্থা কী হতে পারে সেটা সহজেই অনুমেয়। আমাদের সমাজ মানস, আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক যে পরিবেশ তাতে মহামারিকাল বলে কিন্তু প্রজনন কাজ মোটেই থেমে থাকবে না বরং গৃহবন্দি একঘেয়ে জীবনের পরিস্থিতি বলছে নিকট ভবিষ্যতে তা আরও বাড়বে এবং তা অন্যান্য দেশের বেলাতেও একই হবে। কিন্তু সমস্যাটা হচ্ছে এর ফলে আমাদের দেশের মতো দরিদ্র দেশগুলোতে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য বিশাল ঝুঁকির মধ্যে পড়বে। এমনিতেও যে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য ব্যবস্থা খুব একটা ভালো ছিল তা তো নয়! মহামারির কারণে যা ছিল তাও ভেঙে পড়তে শুরু করেছে এবং সামনে বিপদ আরও বাড়বে। জাতিসংঘের সার্বজনীন মানবাধিকারের ঘোষণার ধারা ২৫-এ বলা হয়েছে- ‘প্রত্যেকেরই স্বাস্থ্যরক্ষাসহ তার এবং তার পরিবারের মানসম্মত জীবনযাপন, খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থান এবং চিকিৎসার সুযোগ পাওয়া এবং প্রয়োজনীয় সামাজিক সেবা, বেকার, অসুস্থ, শারীরিক অক্ষমতা, বৈধব্য ব্যবস্থা, বার্ধক্য ও জীবন যাপনের অন্যান্য ক্ষেত্রে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরের পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার অধিকার রয়েছে।’

এখানে নিজের নিয়ন্ত্রণের বাইরের পরিস্থিতিতে বেঁচে থাকার অধিকারের কথা বলা হয়েছে। কিন্তু এখন অবস্থা যেমন তাতে যাদের হাতে অপর্যাপ্ত টাকা আছে শুধু তারাই বেঁচে থাকতে পারবে। হাসপাতালে চিকিৎসা নেই, যদিও গরিবের জন্য কোনোকালেই থাকে না। কিন্তু হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে, বুদ্ধি, ধৈর্য ও অদম্য মনোবল দিয়ে দারিদ্র্যকে কিছুটা হলেও মোকাবেলা করে নিজের প্রয়োজন সীমিতভাবেও মেটাতে পারার একটা অবস্থা তৈরি করেছিল সাধারণ মানুষ। করোনা মানুষের সেই সামর্থ্য কেড়ে নিয়েছে। কিন্তু তাই বলে সন্তান জন্মদানের কাজ থেমে নেই। কিশোরী থেকে প্রজননক্ষম নারীদের ঋতুচক্র থেমে নেই। ঘরবন্দি, কর্মহীন মানুষ, অভাব অনটনে ভোগা নিরানন্দ মানুষের জীবন যখন শুকিয়ে যায় তখন তারা যৌনতায় আনন্দ খোঁজে, করুণাধারায় ভাসতে চায়।

করোনার থাবায় পুরো পৃথিবী যখন বিপর্যস্ত, থমকে গেছে তার অনেক কার্যক্রম, স্থবির হয়ে গেছে মানুষের জীবনযাত্রা তখন জীবনের নিত্য প্রয়োজনীয় আরও অনেক সামগ্রীর মতো জন্মনিয়ন্ত্রণ সামগ্রীর বিতরণ ব্যবস্থাও কঠিন ও জটিল হয়ে পড়েছে। এদিকে বিদেশ থেকে ফিরে এসেছে লাখো মানুষ যারা সক্ষম দম্পতির অন্তর্ভুক্ত। বিদেশে থাকার কারণে এসব দম্পতি আগে কোনো জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতির আওতায় না থেকেও জন্মনিয়ন্ত্রণে পজিটিভ ভূমিকা রেখেছে। কিন্তু তারা বাড়ি ফিরে আসায় জন্মহার বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কাও বেড়ে গেছে।

এখন তারা যদি নিজে থেকে জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণ না করে তাদের এর আওতায় নিয়ে আসা একটা কঠিন কাজ। বাড়ি বাড়ি গিয়ে সেবাদানকারী কর্মীদের পক্ষে আগের মতো তাদের সঙ্গে নিবিড়ভাবে যোগাযোগ করা সম্ভব নয়। কর্মীরা চাইলেও গ্রহীতারা যদি দুয়ার না খোলে কিছুই করার নেই। স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেই অনিচ্ছুক দম্পতিদের জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণে উদ্বুদ্ধ করা ছিল একটা দুরূহ কাজ। এখন যে সেটা দুরূহতম হয়ে যাবে তা সহজেই অনুমান করা যায়।

আবার যারা স্বেচ্ছায় পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান তাদের জন্যও পরিবার পরিকল্পনা সেবা ও উপকরণ প্রাপ্তির বিষয়টা আর সহজলভ্য নয়। তাই অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণ বৃদ্ধি পাচ্ছে উচ্চহারে। এই অবস্থায় শুধু কোভিড-১৯ বিষয়ক স্বাস্থ্য সেবা প্রদানে গুরুত্ব দেওয়ার কারণে নারী ও কিশোরীদের যৌন-প্রজনন স্বাস্থ্য সেবা বিষয়টি মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এদিকে অনির্দিষ্টকালের জন্য স্কুল কলেজ তথা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় দরিদ্র, নিম্নবিত্ত, এমনকি শিক্ষা সংস্কৃতিহীন সচ্ছল পরিবারেও মেয়েদেরকে অযথা বসিয়ে রেখে লাভ কী, তার চেয়ে বিয়ে দেওয়াটাই যুক্তিযুক্ত মনে করছেন অভিভাবকগণ।

ফলে বেড়ে গেছে বাল্যবিবাহ। বাল্যবিবাহ ও কৈশোর মাতৃত্ব যে নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য তথা নারীর গোটা জীবনকে ঝুঁকিতে ফেলে দেয় এবং শুধু তাই নয় বাল্যবিবাহ ও কৈশোর মাতৃত্ব শিশু স্বাস্থ্যসহ সামগ্রিক স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্যই ঝুঁকিপুর্ণ তা এখনো আমাদের অধিকাংশ মানুষ বোঝেন না বা বুঝতে চান না। করোনা বিপর্যস্ত সময়ে বিশ্বব্যাপী ঘরে বাইরে নারীর প্রতি সহিংসতা বৃদ্ধি পেয়েছে এবং তা প্রজনন স্বাস্থ্যের ওপর মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। পরিবার পরিকল্পনা অধিদফতরের ২০১৮ সালের তথ্য অনুযায়ী মোট সক্ষম দম্পতির ১২.১৬ শতাংশ হচ্ছে অফড়ষবংপবহঃ পড়ঁঢ়ষব। কোভিড-১৯ এর কারণে অনির্দিষ্টকালের জন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকায় ইতোমধ্যে বাল্যবিবাহ বেড়ে গেছে সে খবর আমরা জানতে পারছি। কোথাও প্রতিরোধ কিছু হচ্ছে কিন্তু সবসময় সর্বত্র তা হচ্ছে না। করোনাকালে বিভিন্ন সংগঠনের জরিপে নারী ও শিশু নির্যাতনের যে চিত্র উঠে এসেছে তা ভয়াবহ।

শিশু-কিশোরী ধর্ষণ ও বিভিন্ন প্রকার সহিংসতা, বাল্যবিবাহের যে পরিসংখ্যান তা বিপজ্জনক ভবিষ্যতের ইঙ্গিত দেয়। এই অবস্থায় নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য কতটা হুমকির মুখে সে বিষয়ে সকলকেই সচেতন ও সতর্ক না থাকলে এবং প্রতিরোধে এগিয়ে না এলে পরিস্থিতি আরও সংকটময় হবে। বাল্যবিবাহ, নারীর প্রতি সহিংসতা এবং শারীরিক ও মানসিক নির্যাতন নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য তথা জাতীয় স্বাস্থ্য ব্যবস্থার জন্য বিরাট হুমকি। কারণ নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য কেবল নারীর বিষয় নয় এর ওপর নির্ভর করছে গোটা সমাজের মানসিক ও শারীরিক সুস্থতার তো বটেই মানব সভ্যতার বিষয়টিও।

কায়রো প্রোগ্রাম অব আ্যাকশনে আন্তর্জাতিক দলিল হিসেবে প্রজনন স্বাস্থ্যকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে তা হল- ‘প্রজনন স্বাস্থ্য শারীরিক, মানসিক ও সামাজিক উন্নয়নের একটি সম্মিলিত রূপ। প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার শুধু শারীরিক, মানসিক দুর্বলতা অথবা এ সংক্রান্ত রোগের অনুপস্থিতিকেই বোঝায় না বরং এটা নারীর অধিকারকে সমুন্নত করবে যেখানে একজন নারী তার ইচ্ছে ও স্বাধীনমতো সন্তান সংখ্যা এবং দুটি সন্তানের মাঝে কত সময় বিরতি হবে তা নির্ধারণ করবে। সেই সঙ্গে সন্তুষ্ট ও নিরাপদ যৌনজীবন নিশ্চিত করতে সক্ষম হবে।‘

সম্প্রতি বাংলাদেশসহ বিশ্বজুড়ে বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস পালিত হয়ে গেল। জাতিসংঘ প্রতিবছর বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের জন্য একটি প্রতিপাদ্য বিষয় নির্ধারণ করে দেয় এবং প্রতিপাদ্য বিষয়গুলোর যে বক্তব্য তা অধিকাংশ সময়েই মেয়েদের এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার ও তাদের সুযোগ সুবিধার পক্ষেই থাকে। যেমন এই ২০২০ সালে সারা বিশ্ব যখন করোনাভাইরাসের মারণ ছোবলে দিশেহারা তখনও জাতিসংঘ বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস ২০২০-এর প্রতিপাদ্য বিষয়ে নারীর স্বাস্থ্যকেই অগ্রাধিকার দিয়েছে। এবারের প্রতিপাদ্য বিষয়Ñ ‘কোভিড-১৯ প্রতিরোধ করি, নারী ও কিশোরীর সুস্বাস্থ্যের অধিকার নিশ্চিত করি’।

এবারের বিশ্ব জনসংখ্যা দিবসের মূল লক্ষ্য এই মহামারিতে নারী ও কিশোরীদের যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার প্রয়োজনীয়তা এবং এসকল সেবা অপ্রাপ্তির ফলে সৃষ্ট জটিলতার বিষয়ে সকলকে সচেতন করে তোলা। কীভাবে নিরাপত্তা বেষ্টনি সৃষ্টি করে এই কঠিন যুদ্ধ জয় করা যায় এজন্য প্রত্যেক দেশ নিজস্বভাবে যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকার বিষয়টিকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে কর্মসূচি গ্রহণ করবে যাতে ২০৩০ সালের মধ্যে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জন করা যায়।

এই কঠিন যুদ্ধ জয় করার জন্য সকলকে সচেতন করে তোলা এবং নিরাপত্তা বেষ্টনি তৈরি করা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে কি আদৌ সম্ভব? করোনাপূর্ব সময়ের বাস্তব অভিজ্ঞতায় দেখেছি অনেকের সচেতন প্রয়াস সত্ত্বেও মানুষকে সচেতন করে তোলার কার্যকর চেষ্টাও প্রায়শই ব্যাহত হয়ে গেছে। একটা গোষ্ঠীর সচেতন না হওয়ার গোয়ার্তুমি, স্বেচ্ছাচারিতা, মূর্খতাও এর একটা বড় কারণ। এসব বিষয়ে কেউ যখন এদের সচেতন করতে যায় তখন তাদের আচরণে মনে হয় এর চেয়ে হাস্যকর বস্তু বোধহয় আর কিছু হতে পারে না। ভাবখানা এমন- আমরা কিছু কম বুঝি না যে তোমরা বোঝাতে এসেছ! অধিকাংশ সময় তারা বলেও ফেলে- আমরা কম বুঝি নাকি? তারা বলবে আমরা অধিক সন্তান নেব তাতে তোমার কী? তোমার সরকারের কী? তোমার সরকার তো তাদের খাবার দেবে না আমিই খাওয়াব। তাহলে! আমার মেয়ে আমি ঠিক করব কখন তার বিয়ে দেব। তুমি বলার কে? মেয়েদের এত পড়াশোনারই দরকার কী? আমাদের মেয়েরা চাকরি করবে না। পুরুষরাই সংসার চালাতে পারে। মেয়েদের চাকরি লাগে না। তারা ঘর সংসার করবে।

যখন কোথাও বাল্যবিবাহের খবর পাওয়া যায় সেখানে গেলে দেখা যায়, চেয়ারম্যান সার্টিফিকেট দিয়েছে সুতরাং এটা বাল্যবিবাহ নয়। এসব বন্ধ করার জন্য প্রশাসনের অনেক সিস্টেমের ভেতর দিয়ে যেতে হয় আর সিস্টেমের ফাঁকতালে অভিভাবকপক্ষ চেয়ারম্যান, কাজী এবং প্রভাবশালী নেতাদের সহযোগিতায় এমন সিস্টেম করে রাখে যে এই বিবাহ বন্ধ করার আর কোনো সিস্টেম থাকে না।

নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য সেবার সঙ্গে জন্মনিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। আর নারীর প্রজনন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে হলে নারীর ক্ষমতায়ন অত্যাবশ্যক। ক্ষমতায়ন মানে হচ্ছে সিদ্ধান্ত নেওয়ার অধিকার। ৬০-৬৫ শতাংশ বাল্যবিবাহ যে দেশে হয় সেখানে নারীর ন্যূনতম সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতা যে নেই সে তো বলাই বাহুল্য। তো যে কিশোরীগণ বিয়ের ব্যাপারে বাবার ঘরে থেকেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার সুযোগ পায় না তারা সন্তান ধারণ করা না করার সিদ্ধান্ত যে নিতে পারে না সেটা তো জানা কথাই। বিয়ের বছরের মধ্যে সন্তান পেটে না এলে বর ও পরিবারের অন্যান্যরা তালাক দেওয়ার বা আরেকটা বিয়ে করে নেবে বলে হুমকির মধ্যে থাকে।

কাজেই এই পিতৃতান্ত্রিক ব্যবস্থায় বিবাহ ও সন্তান ধারণে যখন পুরুষের আধিপত্য বা কর্তৃত্ব একচেটিয়া সেখানে জন্মনিয়ন্ত্রণ বা পরিবার পরিকল্পনার মতো বিষয়টি পুরুষের ইচ্ছা অনিচ্ছার ওপর নির্ভর করবে তাতে আর আশ্চর্য কী? এসব ক্ষেত্রেও পুরুষের সিদ্ধান্তই চূড়ান্ত সে যতই জরায়ুটা নারী নিজে তার দেহে বহন করুক এর মালিক তো আর সে নয়। এটা পুরুষের ক্ষেত্র এখানে সে যত খুশি যা খুশি ফসল বুনবে। কিছু যে ব্যতিক্রম নেই তা নয় কিন্তু বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই পুরুষ যদি পরিবার পরিকল্পনা বা জন্মনিয়ন্ত্রণ পদ্ধতি গ্রহণের সিদ্ধান্ত না নেয় কিংবা বলা ভালো মেয়েদের অনুমতি না দেয় তবে তার পক্ষে সেটা সম্ভব নয়। একটু সাহসী নারী আছে যারা কিছু অস্থায়ী পদ্ধতি যেমন পিল বা ইনজেকশন গ্রহণ করে বর শাশুড়ি ও পরিবারের অন্যান্য লোকদের লুকিয়ে। ধরা পড়লে বিপদ আছে। আর হাতেনাতে ধরতে না পারলেও সন্দেহের বশেই গালাগালি শাসন ত্রাসন চলতে থাকে।

যেক্ষেত্রে পুরুষের অনুমোদন আছে সেও অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীকেই পদ্ধতি গ্রহণ করতে বাধ্য করা হয়। চিকিৎসাবিজ্ঞানও এক্ষেত্রে নারীর প্রতি বৈষম্য করেছে। কেননা অস্থায়ী ও দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতির প্রায় সব নারীর জন্যই আবিষ্কার করা হয়েছে। এর মধ্যে অস্থায়ী পদ্ধতি পিল ও ইনজেকশন এবং দীর্ঘমেয়াদি পদ্ধতি ইমপ্ল্যান্ট (যা একজন নারীর বাহুর চামড়ার নীচে দুটো সুঁচ গেঁথে রাখা হয়) এই তিনটি পদ্ধতির অনেক পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া আছে। যেমনÑ অনিয়মিত পিরিয়ড, অত্যধিক ব্লিডিং, তীব্র মাথা ঘোরা, শরীর মুটিয়ে যাওয়া বা শুকিয়ে যাওয়াসহ আরও কিছু সমস্যা।

যা নিয়ে কোনো গ্রহীতা নারীকে তার সমগ্র প্রজননকাল অতিবাহিত করতে হয়। অথচ পুরুষের জন্য এনএসভি বা ভ্যাসেকটমি নামের যে স্থায়ী পদ্ধতিটি আছে তা অনেক নির্ঝঞ্ঝাট যার কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। অথচ পুরুষরা ওই পদ্ধতি গ্রহণ করতে চান না। দেশের মোট সক্ষম দম্পতির মোট তিন শতাংশের কম পুরুষ এই পদ্ধতি গ্রহণ করেছেন। বিপরীতে এনএসভির চেয়ে তুলনামূলক একটু জটিল পদ্ধতি টিউবেকটমি পদ্ধতি গ্রহীতা নারী মোট সক্ষম দম্পতির প্রায় সাড়ে সাত শতাংশসহ মোট গ্রহীতার শতকরা ৬৯ শতাংশ হচ্ছে নারী গ্রহীতা।

দেখা যাচ্ছে, অনেকেই আছে যারা নিজেরাও কোনো পদ্ধতিতে যাবে না আবার বউকেও পদ্ধতি নিতে দেবে না। এদের কা-জ্ঞান না থাকলেও যৌনজ্ঞান আছে টনটনে। ওরাল পিল, ইনজেকশন বা ইমপ্ল্যান্ট নিয়ে বউ যদি শুকিয়ে যায় বা লাগাতার ব্লিডিং হতে থাকে এবং আইইউডি বা টিউবেকটমি করে তবে তার যৌনজীবনে ব্যাঘাত ঘটবে। আবার অত্যধিক মুটিয়ে গেলে বা মাথা ঘোরা ও হাইপ্রেসার থাকলে সংসারের কাজকর্ম করতে পারবে না। তারচেয়ে বউ বছর বছর সন্তান নিতে থাকুক সংসারের কোনো কাজে ঝামেলা হল না। এ প্রসঙ্গে একটি বাস্তব কাহিনি তুলে ধরছি। একবার ফিল্ড ভিজিটে এক মাঠকর্মীর কার্যক্রম মনিটর করতে গেছি। হঠাৎ দেখি ২৮/২৯ বছরের এক গ্রহীতা আমার সঙ্গে যে মাঠকর্মী ছিল তাকে দেখে দৌড়ে এসে কান্না জুড়ে দিল। আপা আমার হাতের সুঁচ খুলে দেন। নইলে আমার সংসার ভেঙে যাবে।

মেয়েটির তিনটি ছেলেমেয়ে আছে তার শরীর স্বাস্থ্য ভালো নয়। তাই সে আর সন্তান চায় না। কিন্তু তার দিনমজুর বরের আরও সন্তান চাই। তার একটা ছেলেতে হবে না। মেয়েটি তাই বরকে লুকিয়ে হাতের সুঁচ মানে ইমপ্ল্যান্ট নিয়েছিল। কী করে যেন তার বর জেনে গেছে এখন এই নিয়ে রোজ অশান্তি, মারধর। মেয়েটির সঙ্গে কথা বলে জানতে পারি, তের চৌদ্দ বছর বয়সে তার বিয়ে হয়। কিন্তু বিবাহিত জীবন বলতে যৌনজীবন কখনোই তার কাছে সুখের মনে হয়নি। মনে হয়েছে এটা নির্যাতন। চৌদ্দ-পনের বছরের বিবাহিত জীবনেই যৌনতার প্রতি তার এখন চরম অনীহা এসে গেছে। কিন্তু তার বর মনে করে সে হাতে সুঁই ফুটিয়েছে বলেই এমন হচ্ছে। কিন্তু মেয়েটি আর সন্তান নিতে চায় না। তার বড় মেয়েটি তের-চৌদ্দ বছরের। আমরা সেখানে থাকা অবস্থায়ই ওর বর ঘরে ফিরে এল। শুনতে পেলাম সে নিজের বউকে আর প্রতিবেশী যে নারী তার বউকে পরামর্শ দিয়েছিল তাদের অকথ্য ভাষায় গালাগালি দিচ্ছে। সেই বাড়িরই আরেকটা ঘরে দেখলাম দুটো কিশোরীকে। বার থেকে চৌদ্দ বছরের হবে। ওরা প্রাইমারি পাস দেওয়ার পর আর স্কুলে ভর্তি হয়নি। কারণ হিসেবে বলল, বাপে খাওয়াইয়া কূল পায় না আবার পড়াইব?

ঘরে তাদের অনেকগুলো ভাইবোন। দিনমজুর লোকটি সংসারের খাওয়ার খরচ মেটাতে হিমশিম খায়। ঠিকমতো ভাতই দিতে পারে না। কিশোরী মেয়েদের যে বাড়ন্ত শরীরের জন্য পুষ্টিকর খাবার দরকার, প্রজনন স্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য পরিচ্ছন্ন পোশাক, নিরাপদ স্যানিটেশন ব্যবস্থা ও পরিবেশ দরকার তার কোনোটাই দেওয়ার সামর্থ্য থাকে না তাদের। নিজের ঘাড়ের বোঝা নামাতে যেনতেন প্রকারে বিয়ে দিতে পারলেই যেন বাঁচে। এখন এই করোনাকালে এইসব হতদরিদ্র পরিবারের কিশোরীদের পুষ্টিব্যবস্থা, স্বাস্থ্যব্যবস্থা যে বেহাল হবে তা কি আর বলার অপেক্ষা রাখে?

জাতিসংঘ জনসংখ্যা তহবিলের সাম্প্রতিক গবেষণায় দেথা গিয়েছে যদি স্বাস্থ্য ব্যবস্থার অতি প্রয়োজনীয় অংশ নারী ও কিশোরীদের যৌন প্রজনন স্বাস্থ্য বাদ রেখে একটানা ৬ মাস লকডাউন থাকে তাহলে ১১৪টি নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশের প্রায় ৪ কোটি ৭০ লক্ষ নারী পুরুষ আধুনিক পরিবার পরিকল্পনা পদ্ধতির সেবাপ্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হবে। প্রায় ৭০ লক্ষ অনাকাক্সিক্ষত গর্ভধারণের ঘটনা ঘটবে। ৩১ মিলিয়ন বা ৩ কোটি ১০ লক্ষ নারী ও কিশোরী যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হবে। ২০ লক্ষ নারীর খৎনা সংগঠিত হতে পারে এবং ১ কোটি ৩০ লক্ষ কিশোরী বাল্যবিয়ের শিকার হবে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে আগামী ১০ বছরে প্রাতিষ্ঠানিক ডেলিভারি ও দক্ষ সেবাদানকারী দ্বারা প্রসব সেবা যদি ২০ শতাংশ হ্রাস পায় তাহলে প্রতি লাখে মাতৃমৃত্যু ১৭৩ থেকে বেড়ে ১৯২ হবে আর শুধু ২০২০ সালে অতিরিক্ত ৩১৯১ জন মা মারা যাবে।

একটি নিম্ন আয়ের দেশ হিসেবে বাংলাদেশের মাতৃশিশু স্বাস্থ্য যে বিপর্যয়ের মুখে পড়বে এবং নারী ও কিশোরী যে যৌন নির্যাতন ও সহিংসতার শিকার হবে তা বলাই বাহুল্য। পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে উদ্ভূত সমস্যাকে মোকাবেলার জন্য ইউএনএফপিএ যে তিনটি বিষয়কে গুরুত্ব দেওয়ার কথা বলেছে তা হল- কোভিড-১৯ এর কারণে সৃষ্ট নতুন প্রতিবন্ধকতা চিহ্নিতকরণ। কাউকে পেছনে ফেলে নয়- বিষয়টি আরও গুরুত্ব দিয়ে দৃঢ়ভাবে প্রতিষ্ঠা করা। মহামারি বিষয়ে বিশ্বনেতা ও প্রভাবশালীদের কৌশলগত দৃঢ় অবস্থান ও উপযুক্ত পদক্ষেপ গ্রহণ।

কাজেই করোনাকালে নারী ও কিশোরীর প্রজনন স্বাস্থ্যকে কোনোভাবেই উপক্ষো করা যাবে না। বিষয়টিকে উপেক্ষা করা মানেই ভবিষ্যতে সুস্থ প্রজন্ম গড়ে না ওঠার সংকট সৃষ্টি করা। পরিস্থিতি যত প্রতিকূলই হোক, ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে সুরক্ষিত করার জন্য নারীর প্রজনন স্বাস্থ্য অধিকারকে অধিক গুরুত্ব দিয়ে তা নিশ্চিতকরণ সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এক্ষেত্রে সরকারের দায়িত্বের পাশাপাশি সমাজের সর্বস্তরের সচেতন মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে।

স্বাতী চৌধুরী : লেখক ও নারী অধিকার কর্মী
[email protected]

 
Electronic Paper