পরীক্ষা শুধু জ্ঞান যাচাইয়ের মাধ্যম নয়—এটি আমাদের ধৈর্য, মনোযোগ, আত্মবিশ্বাস আর পরিশ্রমেরও পরীক্ষা। পড়ার টেবিলে রাতের পর রাত জেগে থাকা, স্বপ্নের মতো ভবিষ্যতের জন্য লড়ে যাওয়া—এসবের মাঝে কখনও কখনও ভয় ও দুশ্চিন্তা এসে মনকে ভারী করে তোলে। ঠিক সেই সময়টাতেই প্রয়োজন হয় অন্তরের শক্তি জাগিয়ে তোলা, প্রয়োজন হয় এমন কিছু আমল ও করণীয় যা মনকে শান্ত করে, আল্লাহর প্রতি ভরসা বাড়ায় এবং প্রচেষ্টাকে সঠিক পথে এগিয়ে দেয়।
কারণ পরীক্ষা শুধু কলমের লিখন নয়—এটি হৃদয়েরও এক বড় আনুষ্ঠানিকতা। সঠিক আমল, আন্তরিক দোয়া এবং পরিশ্রমের বরকতই পরীক্ষায় সাফল্যের দরজা আরও প্রশস্ত করে দেয়। তাই গভীর রাত পর্যন্ত পড়াশোনায় জেগে না থেকে সন্ধ্যার স্বাভাবিক সময়ে ঘুমিয়ে পড়া। পরীক্ষার আগ মুহূর্তে ভোর রাতে এবং সকালে পড়াগুলোতে একটু নজর দেওয়া। তাতে পরীক্ষার প্রস্তুতি সুন্দর হয়। কারণ ভোর রাত কিংবা সকালে পড়াশোনা এবং প্রস্তুতি সবচেয়ে বেশি বরকতময় ও কার্যকরী। এ সময়টিতে মানুষের স্মৃতিশক্তি সতেজ থাকে।
পরীক্ষা ভালো করার আমল
পরীক্ষার কঠিন মুহূর্ত ও পেরেশানি থেকে মুক্ত থাকতে আল্লাহর কাছে দুইটি আবেদন করা যেতে পারে। যে আমলে মানুষ পরীক্ষার পেরেশানি ও দুঃশ্চিন্তা থেকে মুক্ত থাকতে পারবে। তাহলো—
১. আল্লাহর ওপর ভরসা করা
পরীক্ষায় সাফল্য অর্জনের প্রথম ও সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হলো আল্লাহর ওপর পূর্ণ ভরসা করা। সত্যিকার তাওয়াক্কুল মানুষের অন্তরকে শান্ত করে, ভয়–দুশ্চিন্তা দূর করে এবং মনকে আলোর মতো স্বচ্ছ করে তোলে। যে পরীক্ষার্থী আল্লাহর ওপর নির্ভর করে, আল্লাহ তাঁকে পরীক্ষার জটিলতা সহজ করে দেন এবং সঠিকভাবে উত্তর দেওয়ার শক্তি দান করেন। মহান আল্লাহ বলেছেন—
وَمَنْ يَتَوَكَّلْ عَلَى اللَّهِ فَهُوَ حَسْبُهُ ۚ إِنَّ اللَّهَ بَالِغُ أَمْرِهِ
‘আর যে আল্লাহর ওপর ভরসা করে—আল্লাহ তার জন্য যথেষ্ট। নিশ্চয়ই আল্লাহ তাঁর সিদ্ধান্ত বাস্তবায়ন করেই থাকেন।’ (সুরা ত্বালাক: ৩০)
অতএব, প্রত্যেক পরীক্ষার্থীর উচিত—নিজের পরিশ্রমের পাশাপাশি অন্তরকে আল্লাহর প্রতি সমর্পণ করা, তাঁর ওপর পূর্ণ আস্থা রাখা এবং কুরআনের নির্দেশনা অনুযায়ী জীবন গঠন করা। এ ভরসাই পরীক্ষাকে সহজ করে এবং ফলাফলকে বরকতময় করে তোলে।
২. পরীক্ষা সহজ হওয়ার দোয়া
নবী (সা.) মানুষকে আল্লাহর কাছে সহজ হিসাবের জন্য এক মহামূল্যবান দোয়া শিখিয়েছেন। পরকালের কঠিন হিসাব থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য এই দোয়া হলেও, পরীক্ষার মুহূর্তে দুশ্চিন্তা ও মানসিক চাপ দূর করে সহজতা কামনা করার উদ্দেশ্যে এটি পড়া যেতে পারে। কারণ আল্লাহই সকল কঠিনকে সহজ করেন, দুশ্চিন্তাকে দূর করেন এবং অন্তরে শান্তি দান করেন। দোয়া—
اللَّهُمَّ حَاسِبْنِي حِسَابًا يَسِيرًا
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা হাসিবনি হিসাবান ইয়াসিরা
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি আমার হিসাব (পরীক্ষা) সহজ করে দিন।
যদিও দোয়াটি সরাসরি দুনিয়ার পরীক্ষাকে লক্ষ্য করে নয়, তবুও ভালো নিয়তে এটি পাঠ করলে আল্লাহ তা’আলা অবশ্যই সহজতা দান করবেন—এ প্রত্যাশায় পরীক্ষার্থী এ আমল করতে পারে। আল্লাহর সাহায্যই পরীক্ষার জটিলতাকে সহজ পথ করে দেয়।
৩. দরূদে ইবরাহিম পড়া
পরীক্ষার আগে ও সময়ে দরূদ পড়া অন্তরে শান্তি আনে, দুশ্চিন্তা দূর করে এবং আল্লাহর রহমত ও সাহায্য লাভের এক মহান উপায়। দরূদে ইবরাহিম সবচেয়ে মর্যাদাপূর্ণ দরূদগুলোর একটি। পরীক্ষার্থী মনকে শান্ত রাখতে এবং সহজতা কামনা করে এ দরূদ পড়তে পারে। দরূদে ইবরাহিম—
اللَّهُمَّ صَلِّ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا صَلَّيْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
اللَّهُمَّ بَارِكْ عَلَىٰ مُحَمَّدٍ وَعَلَىٰ آلِ مُحَمَّدٍ كَمَا بَارَكْتَ عَلَىٰ إِبْرَاهِيمَ وَعَلَىٰ آلِ إِبْرَاهِيمَ إِنَّكَ حَمِيدٌ مَجِيدٌ
উচ্চারণ: আল্লাহুম্মা সাল্লি আলা মুহাম্মাদিও, ওয়া আলা আালি মুহাম্মাদ, কামা সাল্লাইতা আলা ইবরাহিমা, ওয়া আলা আালি ইবরাহিমা, ইন্নাকা হামিদুম মজিদ। আল্লাহুম্মা বারিক আলা মুহাম্মাদিও, ওয়া আলা আালি মুহাম্মাদ, কামা বারাকতা আলা ইবরাহিমা, ওয়া আলা আালি ইবরাহিমা, ইন্নাকা হামিদুম মজিদ।
অর্থ: হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর রহমত বর্ষণ করুন—যেভাবে আপনি ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর রহমত বর্ষণ করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসনীয় ও মহিমান্বিত।
হে আল্লাহ! আপনি মুহাম্মাদ (সা.)-এর ওপর এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করুন—যেভাবে আপনি ইবরাহিম (আ.) এবং তাঁর পরিবারবর্গের ওপর বরকত দান করেছেন। নিশ্চয়ই আপনি প্রশংসনীয় ও মহিমান্বিত।
পরীক্ষার আগে এ দরূদ পাঠ করলে হৃদয়ে প্রশান্তি নেমে আসে এবং আল্লাহর সহায়তা লাভের আশা আরও দৃঢ় হয়।
পরীক্ষার্থীর করণীয়
পরীক্ষার আগে অতিরিক্ত চিন্তা না করা; নির্ঘুম রাত কাটানো থেকে বিরত থাকা; অতিরিক্ত চর্বিযুক্ত খাবার না খাওয়া; আরামদায়ক পোশাক পরা; পরীক্ষার উদ্দেশ্যে রওয়ানা হওয়ার আগে অ্যাডমিট কার্ড, রেজিস্ট্রেশন কার্ডসহ পরীক্ষার সরঞ্জামগুলো গুছিয়ে নেওয়া; পরীক্ষার কেন্দ্রে নির্ধারিত সময়ের কিছু আগে প্রবেশ করা এবং ফ্রেশ (পরিচ্ছন্ন) হওয়া; ওজু করে পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রবেশ করা।
পরীক্ষার কেন্দ্রে প্রবেশের পর (সম্ভব হলে)-
দরূদে ইবরাহিম পড়া; স্মরণ শক্তির দোয়া পড়া—
رَبِّىْ زِدْنِىْ عِلْمَا
উচ্চারণ: রাব্বি ঝিদনি ইলমা (৩ বার)
প্রশ্নপত্র ও খাতা হাতে পেয়ে-
‘আউজুবিল্লাহি মিনাশ শায়ত্বানির রাঝিম ও বিসমিল্লাহির রাহমানির রাহিম পড়ে খুব খেয়াল করে রোল নম্বর, রেজিস্ট্রেশন নম্বর, বিষয় কোড, প্রশ্নপত্রের সেট কোডসহ যাবতীয় তথ্য সুন্দর করে (বৃত্ত ভরাট) পূরণ করা। এরপর পরীক্ষা শুরু করা।
উল্লেখযোগ্য হলো—পরীক্ষায় উৎকৃষ্ট ফল পাওয়ার জন্য নিয়মিত মনোযোগ ও পরিশ্রমের কোনো বিকল্প নেই। বছরজুড়ে নানা পরীক্ষা আমাদের প্রস্তুতিকে যাচাই করে, তাই যে-ই পরীক্ষায় অংশ নিক না কেন, প্রথম দায়িত্ব হলো আন্তরিকভাবে পড়াশোনায় মনোযোগ দেওয়া এবং যথাযথ প্রস্তুতি গ্রহণ করা।
তবে বাস্তবতা হলো—পরীক্ষার মুহূর্তে অনেকেই মানসিক চাপে ভেঙে পড়ে, দুশ্চিন্তা বেড়ে যায়, মন স্থির থাকে না। তখন পরিশ্রমের পাশাপাশি দোয়া, আমল ও আল্লাহর প্রতি ভরসা পরীক্ষার্থীকে এক ভিন্ন শক্তি দেয়—অন্তরে শান্তি আনে, আত্মবিশ্বাস বাড়ায় এবং সফলতার পথে সহায়তা করে।
তাই পরীক্ষায় ভালো করার নিয়তে উল্লেখিত আমলগুলো যে কেউ করতে পারে। এগুলো পরীক্ষায় সরাসরি নম্বর না বাড়ালেও মনকে স্থির, শান্ত ও আল্লাহর সাহায্যের প্রতি নিবদ্ধ করে, যা সঠিকভাবে পরীক্ষা দেওয়ার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
কেকে/ আরআই