বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: প্লট দুর্নীতি : জয়-পুতুলের পাঁচ বছর কারাদণ্ড      শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড      শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের মামলার রায় আজ, আদালতে বিজিবি মোতায়েন      এবার একযোগে ১৫৮ ইউএনওকে বদলি      হংকংয়ে আবাসিক ভবনে অগ্নিকাণ্ডে নিহত ৪৪, নিখোঁজ ২৭৯      শেখ হাসিনাকে প্রত্যর্পণের অনুরোধ পর্যালোচনা করা হচ্ছে      ৫০তম বিসিএসের বিজ্ঞপ্তি প্রকাশ      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
বন্দর চুক্তি : বাংলাদেশের লাভ-ক্ষতি
সুধীর বরণ মাঝি
প্রকাশ: মঙ্গলবার, ২৫ নভেম্বর, ২০২৫, ৯:৩১ এএম
সংগৃহীত ছবি

সংগৃহীত ছবি

বাংলাদেশের ভৌগোলিক অবস্থান দক্ষিণ ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কেন্দ্রস্থলে, বঙ্গোপসাগর ঘেঁষা দীর্ঘ উপক‚লরেখা এবং ঐতিহাসিক বাণিজ্যপথের সংযোগ— সব মিলিয়ে দেশটিকে একটি সম্ভাবনাময় ‘মেরিটাইম গেটওয়ে’-তে পরিণত করেছে। চট্টগ্রাম, মোংলা, পায়রা এবং সর্বশেষ মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দরকে ঘিরে বাংলাদেশ আজ আঞ্চলিক বাণিজ্যের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র হয়ে উঠছে। এই অবস্থানকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন, জাপান, যুক্তরাষ্ট্রসহ মধ্যপ্রাচ্যের বেশ কয়েকটি শক্তি বাংলাদেশে বিনিয়োগ, ট্রানজিট, করিডর এবং যৌথ ব্যবস্থাপনা-সংক্রান্ত বিভিন্ন প্রস্তাব দিয়েছে। 

স্বভাবতই প্রশ্ন উঠছে। এসব বন্দর চুক্তি কি সত্যিই বাংলাদেশের লাভজনক, নাকি এর আড়ালে ভবিষ্যতের সম্ভাব্য ঝুঁকি লুকিয়ে আছে? বাংলাদেশের বন্দর চুক্তির অর্থনৈতিক, ভূরাজনৈতিক, নিরাপত্তাগত, পরিবেশগত ও সার্বভৌমত্বের লক্ষ্য। কোন শর্তে এসব চুক্তি জাতীয় স্বার্থে উপকারী, আর কোন পরিস্থিতি ক্ষতির আশঙ্কা তৈরি করতে পারে— তা স্পষ্ট করা প্রয়োজন। দেশের মালিক যদি দেশের জনগণ হয় তাহলে বিদেশিদের সঙ্গে চুক্তির শর্তগুলো জানার অধিকার থাকলেও আমরা ঠিক তার উল্টো চিত্রে।

বন্দর যেকোনো দেশের অর্থনীতির প্রাণশক্তি। উন্নত ও আধুনিক বন্দরের মাধ্যমে পণ্য পরিবহন দ্রুততর হয়, পরিবহন ব্যয় কমে এবং আন্তর্জাতিক বাণিজ্য নেটওয়ার্কে দেশের অবস্থান সুদৃঢ় হয়। বিদেশি ট্রানজিট সুবিধা, কন্টেইনার ব্যবস্থাপনা, জেটি অপারেশন, কার্গো হ্যান্ডলিং— এসব খাত থেকে বাংলাদেশ উল্লেখযোগ্য পরিমাণ রাজস্ব অর্জন করতে পারে। ভারতের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের রাজ্যগুলো চট্টগ্রাম ও মোংলা বন্দর ব্যবহার করলে ট্রানজিট ফি, বন্দর ব্যবহার ফি এবং কাস্টমস রাজস্ব থেকে বাংলাদেশের আয় বহুগুণে বাড়বে। একইভাবে জাপানের বিনিয়োগে গড়ে ওঠা মাতারবাড়ী গভীর সমুদ্রবন্দর বাংলাদেশকে দক্ষিণ এশিয়ার বৃহৎ কন্টেইনার হাব হিসেবে প্রতিষ্ঠা করতে পারে। এর ফলে রপ্তানি-আমদানি প্রক্রিয়া আরো দক্ষ হবে, পরিবহন খরচ কমবে এবং শিল্পায়ন গতিশীল হবে।

বন্দরকেন্দ্রিক উন্নয়ন রেল-সড়ক-নদীপথসহ সামগ্রিক অবকাঠামোকে আধুনিক করে। এসব উন্নয়নের ফলে নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়— লজিস্টিক, গুদামজাতকরণ, তথ্যপ্রযুক্তি, নিরাপত্তা পরিষেবা ও পরিবহনসহ অসংখ্য খাতে। বাংলাদেশের তরুণ শ্রমবাজারের জন্য এটি একটি বড় সুযোগ। তা ছাড়া দক্ষিণ এশিয়া ও দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার সংযোগস্থলে অবস্থানের কারণে বাংলাদেশ দক্ষ, আধুনিক এবং গভীর বন্দর ব্যবস্থা গড়ে তুলতে পারলে আঞ্চলিক লজিস্টিক হাব হিসেবে দ্রুত উত্থান ঘটাতে পারবে। এতে বাংলাদেশের কৌশলগত অবস্থানও দৃঢ় হবে। তবে আমাদের নিজস্ব অর্থায়নে করতে পারলে সবচেয়ে ভালো এবং নিজস্ব  অর্থায়নে করার সক্ষমতা আমাদের আছে। যদি আমরা পাচারকৃত টাকা ফিরিয়ে আনতে পারি এবং নতুন করে টাকা পাচার বন্দ করতে পারলে আমাদের জন্য অসম্ভব বলে মনে হবে না।

বন্দর সাধারণ অবকাঠামো নয়; এটি জাতীয় অর্থনীতি, নিরাপত্তা ও প্রতিরক্ষার সঙ্গে সরাসরি সম্পর্কিত। দীর্ঘমেয়াদে (২০-৩০ বছর বা তার বেশি) এমন কোনো চুক্তি করা হলে যেখানে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ বা মালিকানা দুর্বল হয়ে পড়ে, সেখানে বিদেশি পক্ষ অস্বাভাবিক প্রভাবশালী হয়ে উঠতে পারে। শ্রীলংকার হাম্বানটোটার উদাহরণ দেখায়। বেপরোয়াভাবে ঋণ নেওয়া ও ব্যবস্থাপনা চুক্তি করার ফলে বন্দরটি ৯৯ বছরের জন্য বিদেশি নিয়ন্ত্রণে চলে গেছে। যদিও বাংলাদেশের পরিস্থিতি ভিন্ন, তবুও অসতর্কতা বা ভুল সিদ্ধান্ত দেশের স্বার্থের জন্য দীর্ঘমেয়াদি ঝুঁকি তৈরি করতে পারে।

বন্দর হলো সামুদ্রিক সীমান্তের প্রবেশদ্বার। কার্গো স্ক্যানিং, নৌনিরাপত্তা, গোয়েন্দা নজরদারি। এসব ব্যবস্থাপনা যদি বিদেশি অপারেটরের ওপর অতিরিক্ত নির্ভরশীল হয়ে পড়ে, তাহলে জাতীয় নিরাপত্তা ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার আশঙ্কা থাকে। বিশেষ করে বঙ্গোপসাগর অঞ্চলে ভারত-চীন-যুক্তরাষ্ট্রের কৌশলগত প্রতিযোগিতা বৃদ্ধি পাচ্ছে। বন্দরকে কেন্দ্র করে কোনো পক্ষ নজরদারির সুবিধা পেলে তা সামগ্রিক নিরাপত্তাকে প্রভাবিত করতে পারে।
অনেক ক্ষেত্রে দেখা যায়- বিদেশি কোম্পানি বা রাষ্ট্র লাভের বড় অংশ নিয়ে যায়, আর স্বাগতিক দেশ তুলনামূলকভাবে কম পায়। যদি ট্রানজিট ফি, কন্টেইনার হ্যান্ডলিং চার্জ বা অপারেশনাল ফি কম নির্ধারণ করা হয়, বা রাজস্ব বণ্টনে বাংলাদেশ দুর্বল অবস্থায় থাকে, তাহলে বন্দর যত উন্নতই হোক, প্রকৃত অর্থে দেশের আয় সীমিতই থাকবে। বিদেশি কোম্পানিগুলো উন্নত প্রযুক্তি ও বৃহৎ মূলধন নিয়ে এসে বাজার নিয়ন্ত্রণ করলে দেশীয় উদ্যোক্তারা প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সমস্যা করতে পারেন। এতে দীর্ঘমেয়াদে দেশীয় ব্যবসায় ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার ঝুঁকি থাকে।

বাংলাদেশের বন্দরকে কেন্দ্র করে ভারত, চীন, জাপান ও যুক্তরাষ্ট্রের ভ‚রাজনৈতিক আগ্রহ অত্যন্ত প্রখর। কোনো একটি দেশের সঙ্গে অতিরিক্ত ঘনিষ্ঠতা অন্য দেশের সঙ্গে কূটনৈতিক সম্পর্কের জটিলতা তৈরি করতে পারে। চীনের কোনো বিনিয়োগকে ভারত সন্দেহের চোখে দেখে; আবার ভারতের ট্রানজিট সুবিধা সম্প্রসারণকে চীন কৌশলগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে বিবেচনা করে। এ ধরনের প্রতিদ্বন্দ্বিতা যদি ভারসাম্যহীন হয়, তাহলে বাংলাদেশ অনাকাক্সিক্ষত কৌশলগত চাপের মুখে পড়তে পারে।

গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ, ড্রেজিং, জেটি স্থাপন এবং বড় আকারের সামুদ্রিক কর্মকাÐ পরিবেশে বড় ধরনের প্রভাব ফেলে। এতে নদীর নাব্য, উপক‚লীয় জীববৈচিত্র্য, মাছের প্রজনন ক্ষেত্র, এমনকি ম্যানগ্রোভ বনের অস্তিত্ব পর্যন্ত ঝুঁকিতে পড়ে। শক্তিশালী পরিবেশগত মূল্যায়ন ছাড়া বড় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে দীর্ঘমেয়াদে পরিবেশগত ও অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হতে হতে পারে।

বন্দরের মালিকানা ও নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনা অবশ্যই বাংলাদেশের হাতে থাকতে হবে। ফি, চার্জ ও রাজস্ব বণ্টনে বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক মানদণ্ডের সঙ্গে সামঞ্জস্য রাখতে হবে। পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করতে কঠোর পরিবেশগত মূল্যায়ন বাধ্যতামূলক হতে হবে। প্রতিটি বড় বন্দর চুক্তি সংসদীয় নজরদারি ও জনস্বচ্ছতার আওতায় আসা উচিত। কৌশলগতভাবে ভারত-চীন-জাপান-যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রাখতে হবে, যাতে কোনো পক্ষ অতিরিক্ত প্রভাব বিস্তার করতে না পারে। বিদেশি অপারেটর যদি বন্দর পরিচালনার পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ পায়। অতিরিক্ত দীর্ঘমেয়াদি বা অসামঞ্জস্যপূর্ণ চুক্তি। রেল-সড়ক-নদীপথ উন্নয়ন ছাড়া শুধু বন্দর উন্নয়ন পরিবেশগত মূল্যায়ন উপেক্ষা। ভ‚রাজনৈতিক নির্ভরতা রাজস্ব বণ্টনে অসমতা এবং দেশীয় শিল্পের দুর্বলতা।

বাংলাদেশের বন্দর চুক্তি ভবিষ্যতের অর্থনৈতিক, কৌশলগত ও নিরাপত্তাগত চিত্র নির্ধারণ করবে। সঠিক পরিকল্পনা, স্বচ্ছতা, পরিবেশ সচেতনতা এবং কৌশলগত ভারসাম্য বজায় থাকলে বাংলাদেশ একটি শক্তিশালী সামুদ্রিক বাণিজ্যকেন্দ্র হিসেবে প্রতিষ্ঠা পাবে। কিন্তু সিদ্ধান্তগুলো যদি দুর্বল, অপরিকল্পিত বা স্বার্থান্ধ হয়ে পড়ে, তাহলে অর্থনীতি, নিরাপত্তা এবং সার্বভৌমত্ব— সবই ঝুঁকির মুখে পড়তে পারে। অতএব, বন্দর চুক্তিকে কেবল অবকাঠামো উন্নয়নের দৃষ্টিতে নয়— বরং জাতীয় স্বার্থ, ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা, আঞ্চলিক কৌশলগত অবস্থান এবং সার্বভৌমত্বের আলোকে বিবেচনা করাই সর্বাধিক জরুরি। সঠিক নীতি, ভারসাম্যপূর্ণ কূটনীতি এবং দক্ষ ব্যবস্থাপনার সমন্বয়েই এসব চুক্তি বাংলাদেশের জন্য প্রকৃত কল্যাণ বয়ে আনতে পারে।

লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট

কেকে/এমএ

আরও সংবাদ   বিষয়:  বন্দর চুক্তি   বাংলাদেশ   লাভ-ক্ষতি  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

দ্বিতীয় বারের মতো ভূমিকম্পে কাঁপল ইন্দোনেশিয়া
দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ায় চীন-মার্কিন দ্বৈরথ
বয়ান শিল্পাঙ্গনের তৃতীয় নাট্য কর্মশালা ৩০ নভেম্বর থেকে
অস্থিতিশীল বিদ্যুৎ খাত : উত্তরণের উপায়
প্লট দুর্নীতি : জয়-পুতুলের পাঁচ বছর কারাদণ্ড

সর্বাধিক পঠিত

চট্টগ্রামে কবির হোসেন সিদ্দিকীর বিরুদ্ধে ১৮ কোটি টাকার ঋণখেলাপির মামলা
বেনাপোলে বিএনপির উঠান বৈঠক, উন্নয়ন ভাবনা তুলে ধরলেন তৃপ্তি
ধামরাইয়ে সাত অবৈধ ইটভাটায় অভিযান, ১৫ লাখ জরিমানা
বিএনপি যে কথা দেয় সে কথা রাখে : নাসিরুল ইসলাম
বুধবারের আলোচিত ছয় সংবাদ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close