দক্ষিণ কোরিয়ায় ইন্টিগ্রেটেড এনার্জিতে (এআই) স্নাতকোত্তর এবং ল্যাব রিসার্সার হিসেবে পড়াশোনা করছেন আলিফ খন্দকার। তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্সে স্নাতক সম্পন্ন করেছেন। মাইলস্টোন স্কুল অ্যান্ড কলেজের এই প্রাক্তন শিক্ষার্থী বর্তমানে দক্ষিণ কোরিয়ার জিওনজু শহরে বসবাস করছেন। বর্তমানে আলিফ খন্দকার সারং গ্লোবাল এডুকেশনের সিইও ও শিক্ষার্থী। তিনি দক্ষিণ কোরিয়ায় উচ্চশিক্ষা, ক্যারিয়ার গড়ার সুযোগ এবং স্থায়ীভাবে বসবাসের সম্ভাবনা নিয়ে দৈনিক খোলা কাগজের সঙ্গে কথা বলেছেন।
আলিফ খন্দকার খোলা কাগজকে জানান, কোরিয়ায় বৃত্তি মূলত আইইএলটিএস স্কোরের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়। নিয়মিত অধ্যয়ন, সময়ের সঠিক ব্যবহার এবং নিজের প্রতি বিশ্বাস আমাকে বৃত্তি পাওয়ার পথে সাহায্য করেছে। বর্তমানে আমি ল্যাব রিসার্চার হিসেবে প্রফেসরের ফান্ড পাচ্ছি এবং টিউশন ফিতেও ছাড় পেয়েছি।
তিনি আরো বলেন, ছোটবেলা থেকে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন আমাকে আকর্ষণ করেছে। সব সময় ভাবতাম, কীভাবে বিজ্ঞান ব্যবহার করে মানুষের জীবন আরো সহজ ও উন্নত করা যায়। ইঞ্জিনিয়ারিং সায়েন্স এই সুযোগ দিয়েছে। এছাড়া আমার স্কুলজীবন থেকে বিজ্ঞান বিভাগে পড়াশোনা করেছি, তাই তত্ত্ব ও বাস্তবের সমন্বয় আমার কাছে স্বাভাবিক ছিল। বর্তমানে আমি লিথিয়াম আয়ন ব্যাটারি নিয়ে গবেষণা করছি।
স্নাতক পর্যায়ে আমি বৃত্তি পেয়েছিলাম। এটি আমার আইইএলটিএস ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে দেওয়া হয়েছিল। বর্তমানে স্নাতকোত্তরে প্রফেসরের তত্ত্বাবধানে অধ্যয়ন করছি। কোরিয়ায় বৃত্তির জন্য বিভিন্ন সুযোগ আছে। যেমন জিকেএস, কেজিএসপি, ব্রেইন কোরিয়া। সাধারণ প্রক্রিয়া হলো অনলাইন আবেদন, যেখানে শিক্ষাগত ফলাফল, সহশিক্ষা কার্যক্রম এবং ব্যক্তিগত উদ্দেশ্য (এসওপি) জমা দিতে হয়। এরপর নির্বাচিত প্রার্থীদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে বৃত্তি দেওয়া হয়। বৃত্তি দুই ধরনের হয়- একটি শুধু টিউশন ফি মওকুফ, আর অন্যটি টিউশন ফি মওকুফসহ স্টাইপেন্ড। আবেদন করার সময় কী কী নথি বা প্রস্তুতি দরকার হয়? স্নাতক পর্যায়ের আবেদন করতে কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ নথি প্রয়োজন। যেমন- এসএসসি ও এইচএসসি সনদপত্র ও মার্কশিট, সদ্য তোলা পাসপোর্ট সাইজের ছবি, জাতীয় পরিচয়পত্র বা জন্মনিবন্ধনের কপি, পুলিশ ক্লিয়ারেন্স, ব্যাংক সলভেন্সি ও স্টেটমেন্ট, স্পনসরশিপ বা এনওসি। অনলাইন আবেদন করার সময় সঠিক তথ্য দিয়ে ফরম পূরণ করতে হয় এবং বিশ্ববিদ্যালয় ও বিষয় সম্পর্কে আগে থেকে ভালোভাবে গবেষণা করা জরুরি। আমি নিজের ফলাফল, যোগ্যতা ও আগ্রহের জায়গাগুলো পর্যালোচনা করে আবেদন করেছি, যাতে সিদ্ধান্তটা হয় সচেতন ও আত্মবিশ্বাসীভাবে। ইংরেজি বা কোরিয়ান ভাষার দক্ষতা কতটা জরুরি? ভাষাগত দক্ষতা এখানে খুব গুরুত্বপূর্ণ। অনেক ক্লাস, লেকচার ও গবেষণা কার্যক্রম ইংরেজি বা কোরিয়ান ভাষায় হয়। ইংরেজি জানা থাকলে আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের সঙ্গে যোগাযোগ সহজ হয় এবং একাডেমিক রিসোর্স বোঝা যায়। কোরিয়ান ভাষা জানা থাকলে স্থানীয় শিক্ষকদের সঙ্গে যোগাযোগ, ক্যাম্পাস লাইফে মানিয়ে নেওয়া এবং পার্টটাইম কাজ বা ইন্টার্নশিপের সুযোগও বাড়ে। তাই দুই ভাষার মৌলিক জ্ঞান থাকা পুরো শিক্ষাজীবনকে সমৃদ্ধ করে।
আলিফ খন্দকার আরো জানান, বিশ্ববিদ্যালয়টি সাংস্কৃতিকভাবে সমৃদ্ধ, বিদেশি শিক্ষার্থীদের জন্য উপযোগী। এখানে হোস্টেল, স্টাডি লাউঞ্জ, লাইব্রেরি, কম্পিউটার ল্যাব, ছাত্রসেবা কেন্দ্রসহ সব সুবিধা রয়েছে। আন্তর্জাতিক শিক্ষার্থীদের জন্য ‘ইন্টারন্যাশনাল লাউঞ্জ’ আছে, যেখানে পড়াশোনা, আলাপ ও বিশ্রামের সুযোগ পাওয়া যায়। ভাষা কোর্স, ওয়ার্কশপ এবং স্থানীয় সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হওয়ার সুযোগও আছে। বিশ্ববিদ্যালয় আধুনিক গবেষণা প্রকল্পে যুক্ত, যেমন ‘ফিজিক্যাল এআই’। ফলে শিক্ষার্থীকে রিসার্চ ও আন্তর্জাতিক অংশীদারির সঙ্গে যুক্ত করে। বিদেশি শিক্ষার্থীদের পরামর্শ কোরিয়ান ভাষার মৌলিক জ্ঞান আগে থেকে শেখা, হোস্টেলের তথ্য জানা এবং নিজের বিষয় ও সুযোগ সম্পর্কে আগেই যাচাই করা।
তিনি বলেন, কোরিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা প্রয়োগমুখী, প্রযুক্তিনির্ভর এবং শিক্ষার্থীকেন্দ্রিক। এখানে শিক্ষার্থীদের প্রকল্প, ল্যাব এবং গবেষণার মাধ্যমে বাস্তব সমস্যার সমাধান শেখানো হয়। এ ছাড়া ক্লাসে শিক্ষকেরা শিক্ষার্থীদের মতামতকে গুরুত্ব দেন, নিয়মিত আলোচনা ও বিতর্কের মাধ্যমে জ্ঞান গভীর হয়। এই সমন্বিত পদ্ধতি শিক্ষাকে শুধু শেখার জন্য নয়, চিন্তাশীল ও সৃজনশীল হতে সাহায্য করে।
এখানে পড়াশোনার পাশাপাশি কাজ ও ইন্টার্নশিপের সুযোগ প্রয়োগমুখী ও বাস্তব অভিজ্ঞতাকেন্দ্রিক। বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষার্থীদের ইন্ডাস্ট্রি লিঙ্ক ও রিসার্চ প্রজেক্টে অংশ নেওয়ার সুযোগ দেয়। অনেক কোম্পানি ক্লাসের সময়সূচির সঙ্গে মিল রেখে পার্টটাইম কাজ বা ইন্টার্নশিপের প্রোগ্রাম চালু রেখেছে। এ ছাড়া বিশ্ববিদ্যালয় নিজেও বিভিন্ন ইন্টার্নশিপ, সেমিনার ও কর্মশালার আয়োজন করে, যা ব্যবহারিক অভিজ্ঞতা বাড়ায়।
কোরিয়া উচ্চ প্রযুক্তি ও উদ্ভাবনী শিল্পে অগ্রণী যেমন- অটোমোবাইল, ইলেকট্রনিকস, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও রোবোটিকস। শিক্ষার্থীরা রিসার্চ, ইন্ডাস্ট্রি-ভিত্তিক প্রকল্প, ইন্টার্নশিপ, কো-অপ প্রোগ্রাম এবং স্টার্টআপে অংশ নিতে পারে। আন্তর্জাতিক সংস্থা ও কোম্পানির সঙ্গে কাজের সুযোগ থাকায় বিদেশি শিক্ষার্থীরাও গ্লোবাল করপোরেট বা রিসার্চ পজিশনে সহজে প্রবেশ করতে পারে। দক্ষিণ কোরিয়ায় পড়াশোনা শেষে স্থায়ী কাজ করার সুযোগ কেমন? স্থায়ী কাজের সুযোগ আছে, তবে কিছু শর্ত ও প্রক্রিয়া মেনে চলতে হয়।
আগে ঠিক করুন কোন বিষয়ে পড়তে চান এবং সেই বিষয় কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে ভালো। ইংরেজি বা কোরিয়ান ভাষার প্রাথমিক জ্ঞান থাকলে পড়াশোনা ও সামাজিক জীবন সহজ হয়। আবেদনের নথি সময়মতো প্রস্তুত রাখুন। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হলো মনোযোগ, অধ্যবসায় এবং সময় ব্যবস্থাপনা।
জ্ঞান শক্তিশালী করুন। ভালো মার্কশিট এবং প্রকল্পের অভিজ্ঞতা অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ। আবেদনপত্রে উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য স্পষ্টভাবে উপস্থাপন করুন। নেতৃত্বের গুণাবলি, সামাজিক কার্যক্রমের অভিজ্ঞতা বা ব্যক্তিগত গল্প থাকলে বৃত্তি প্রাপ্তিতে সাহায্য করে। ধারাবাহিক প্রস্তুতি, আত্মবিশ্বাস এবং সময়মতো নথি প্রস্তুত রাখা সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ।
ইঞ্জিনিয়ারিং ও প্রযুক্তি ব্যবহার করে সমাজে ইতিবাচক প্রভাব তৈরি করা। দেশের প্রযুক্তিগত অগ্রগতি এবং মানুষের জীবনমান উন্নয়নে কাজ করা। পাশাপাশি নিজের পেশাগত দক্ষতা ও উদ্ভাবনকে আন্তর্জাতিক মানের সঙ্গে সমন্বয় করে বিশ্বব্যাপী প্রযুক্তিগত সমস্যার সমাধানে অবদান রাখা। সংক্ষেপে, লক্ষ্য হলো জ্ঞান, দক্ষতা ও উদ্ভাবন ব্যবহার করে অর্থবহ ও প্রভাবশালী ক্যারিয়ার গড়া।
কেকে/ এমএস