দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যুর মিছিল ক্রমে বড় হচ্ছে। প্রতি বছর ডেঙ্গুতে শতশত মানুষের মৃত্যু হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে দেশের সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর তেমন মাথাব্যথা নেই। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ মশক নিয়ন্ত্রণে সফল হলেও আমরা এখনো মশকের হাতে বন্দি। আর্থার সি ক্লার্ক একবার রসিকতা করে বলেছিলেন, ‘আমরা মনে করি- আমরা মহাকাশ জয় করব। অথচ এখনো সামান্য একটা মশাকেও পুরোপুরি দমন বা পরাজিত করতে পারিনি’।
কীটতত্ত্ববিদেরা অনেকবার ঢাকা শহরের মশার ঘনত্ব বৃদ্ধির চিত্রসংবলিত প্রতিবেদন তুলে ধরেছেন। কিন্তু মশা নিধনে যথার্থ ব্যবস্থা না নেওয়ায় সম্প্রতি ডেঙ্গু জ্বরের যে ভয়াবহ রূপ আমরা দেখতে পাচ্ছি-তা ক্লার্কের সেই রসিকতা অথচ রূঢ় বাস্তবতাকে স্মরণ করিয়ে দেয়। দেশে গত এক দিনে ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে চারজনের মৃত্যু হয়েছে, তার আগের দিন ৬ জনের।
স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী এ বছর মশাবাহিত এই রোগে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৩৫৩ জনে। গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে ভর্তি হয়েছেন ৭৪৫ জন ডেঙ্গু রোগী। সব নিয়ে এ বছর ডেঙ্গু রোগে হাসপাতালে ভর্তি রোগীর মোট সংখ্যা বেড়ে দাঁড়িয়েছে ৮৮ হাজার ৪৫৭ জনে। এখন পর্যন্ত চলতি নভেম্বর মাসে ১৮ হাজার ৫৯৫ জন ডেঙ্গু রোগী হাসপাতালে ভর্তি হলেন। আর এ মাসে ডেঙ্গুতে মৃতের সংখ্যা বেড়ে দাঁড়াল ৭৫ জনে। যা গত অক্টোবর মাসের মৃতের সংখ্যাকে ছাড়িয়ে যাবে।
এ বছর অক্টোবর মাসে ডেঙ্গুতে সবচেয়ে বেশি ৮০ জনের মৃত্যু হয়েছিল এবং হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিলেন ২২ হাজার ৫২০ জন ডেঙ্গু রোগী, যা এ বছরের সর্বোচ্চ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি ও মৃত্যুর তথ্য রাখে ২০০০ সাল থেকে। এর মধ্যে ২০২৩ সালে এ রোগ নিয়ে সবচেয়ে বেশি ৩ লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন হাসপাতালে ভর্তি হয়। ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে সবচেয়ে বেশি ১ হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যুও হয়ছিল ওই বছর। বিগত বছরগুলোর ডেঙ্গু রোগ ও রোগীর পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়- এটি আগে মৌসুমি রোগ হলেও এখন সারা বছরই আক্রান্ত হচ্ছে মানুষজন।
কেবল ঢাকার বিবেচনা যদি করি তবে দেখতে পাই মশা মারতে বছর বছর ঢাকার দুই সিটি করপোরেশন ক্রমান্বয়ে যেভাবে বাজেট বাড়িয়ে থাকে, তা দিয়ে ‘কামান দাগানো’ও সম্ভব। দফায় দফায় মশা মারার ওষুধ পাল্টানো হয়, ওষুধ আমদানিতে টেন্ডারও হয়। কাজের কাজ কিছুই হয় না। আমরা বারবার ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে ব্যর্থ হচ্ছি। ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে রাষ্ট্রীয় প্রাতিষ্ঠানিক উদ্যোগ কেমন হতে পারে, তার একটা উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত হতে পারে সিঙ্গাপুর।
সিঙ্গাপুরের ন্যাশনাল এনভায়রনমেন্ট এজেন্সির (এনইএ) কর্মীরা নিয়মিত মানুষের ঘরে ঘরে এবং এলাকায় এলাকায় গিয়ে পাবলিক স্পেস, কনস্ট্রাকশন সাইট এবং হাউজিং এস্টেটে ডেঙ্গু মশার জন্মস্থল খুঁজে ধ্বংস করে থাকে। পরিদর্শন কার্যক্রমের ক্ষেত্রে কনস্ট্রাকশন সাইটের মতো সম্ভাব্য বিপজ্জনক স্থানের প্রতি বিশেষ মনোযোগ দেওয়া হয়। বিশেষজ্ঞদের মতে ডেঙ্গু সব জায়গায় একবারে ছড়ায় না, কোনো কোনো অঞ্চলে এর প্রাদুর্ভাব বেশি থাকে। সময়মতো শুরুর দিকের ক্লাস্টারগুলোতে ডেঙ্গু দমনের যথাযথ পদক্ষেপ নিলে সারা শহর বা সারা দেশে সহজে ছড়াতে পারে না। প্রতিষ্ঠানগুলোর যেমন দায়িত্ব রয়েছে নাগরিকরাও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণের দায় এড়াতে পারে না। ফলে ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকের সমন্বিত পদক্ষেপ জরুরি।
কেকে/এমএ