বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      সিসিইউতে খালেদা জিয়া      নিজের গড়া ট্রাইব্যুনালে হাসিনার বিচার হচ্ছে : রিজভী      প্লট দুর্নীতির মামলায় সাবেক প্রতিমন্ত্রী শরীফের ১৮ বছর কারাদণ্ড      প্লট দুর্নীতি : জয়-পুতুলের পাঁচ বছর কারাদণ্ড      শেখ হাসিনার ২১ বছরের কারাদণ্ড      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
জলবায়ু পরিবর্তনের কড়াল গ্রাসে বাংলাদেশের কৃষি
মো. শাহীন হোসেন
প্রকাশ: বুধবার, ১২ নভেম্বর, ২০২৫, ১০:০৮ এএম

জলবায়ুর কড়াল গ্রাসে কৃষির লড়াই এখন আর বই পুস্তকেই আবদ্ধ নেই। এখন এটা কঠিন বাস্তবতা। আমাদের বই পুস্তকে আর দেশ বিদেশের বিভিন্ন সেমিনার, সিম্পোজিয়ামে, জলবায়ু পরিবর্তন কথাটা নিয়ে গত ১ দশক ধরে খুব চারিত হয়ে আসছে, বড় বড় কন্ফারেন্সে আর টেলিভিশনের পর্দায় এইসব বিষয় নিয়ে বিশ্বের বিভিন্ন পর্যায়ের নীতি নির্ধারকরা স্যুট টাই পড়ে আলোচনা করে, খবরের পাতায় বড় করে ছাপে খবর, প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর এক অংশ ধরেই নিয়েছে এগুলো ধনী আর উচ্চশিক্ষিতদের আলোচ্য বিষয়, তবে এসব আলোচনা আর টিভি স্কিনে কিংবা খবরের কাগজে আর সীমাবদ্ধ নেই, এগুলোট প্রভার ক্রমশই দৃশ্যমান হয়ে উঠছে চিরচারিত জীবনধারায়, হঠাৎ করে যখন কৃষক দেখে তাদের ষড়ঋতুর বাংলাদেশে ছয় ঋতুকে একসাথে খুজেঁ পাচ্ছে না অথবা অতীব তাপমাত্রা, অসময়ে বৃষ্টিপাত চোখের সমানে সোনালী ফসল গিলে খাচ্ছে তখন প্রান্তিক কৃষকরাও ভাবতে শুরু করেছে এইসব বিষয়গুলো নিয়ে, এখন আর জলবায়ু পরিবর্তন দূরের কোনো হুমকি নয়- এটি নেমে এসেছে কৃষকের মাঠে। 

সারা পৃথিবীর মতোই বাংলাদেশের কৃষকরাও এর প্রভাব সরাসরি টের পাচ্ছেন। অনিয়মিত বর্ষা, তীব্র খরা, লবণাক্ততা আর নতুন পোকামাকড়ের আক্রমণ সব মিলিয়ে ফসলের ভাগ্য এখন অনেকটাই নির্ভর করছে প্রকৃতির অনিশ্চয়তার ওপর। আন্তর্জাতিক জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক প্যানেল (IPCC) জানিয়েছে, ২০৫০ সালের মধ্যে বৈশ্বিক ফসল উৎপাদন ১০-২৫ শতাংশ পর্যন্ত কমে যেতে পারে। এতে খাদ্যঘাটতির ঝুঁকিতে পড়বে প্রায় ৮০০ মিলিয়ন মানুষ। এই ঘাটতির খাদ্যের জোগান কোথা থেকে আসবে, অথবা এই খাদ্য উৎপাদন করতে না পারলে ক্রমশ লাফিয়ে চলা জনসংখ্যার গ্রাফ সামলাতে কি ব্যবস্থা নিতে হবে এগুলো ভাবতে মনের অজান্তে ভ্রু কুচঁকে অসহায়ভাবে চেয়ে থাকে কৃষক, পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা ইতোমধ্যে শিল্পপূর্ব সময়ের তুলনায় ১.১°C বেড়েছে এবং আগামী এক দশকের মধ্যেই তা ১.৫°C ছুঁতে পারে। মাত্র ১ক্কঈ তাপমাত্রা বৃদ্ধিতেই গম ও ধানের ফলন ৬-১০ শতাংশ পর্যন্ত কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। কমবে আরো অনান্য ফসলের উৎপাদন। বাংলাদেশে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব এখন স্পষ্ট। 

দক্ষিণ এশীয় দেশগুলোর মধ্য অসহায় এই দেশটিতে, অনিয়মিত বর্ষায় মাঠ ডুবে যায়, আবার দীর্ঘ খরায় মাটি ফেটে যায়। দক্ষিণাঞ্চলে লবণাক্ততা উর্বর জমিকে অনুর্বর করে তুলছে, আর নতুন রোগ-পোকার আক্রমণে ফসলের ক্ষতি বাড়ছে। জৈব বালাই ব্যবস্থাপনা কাজে দিচ্ছে কম অন্যদিকে উপর্যুপরি কীটনাশকের ব্যবহারে কৃষি খরচ বেড়ে যাওয়ার পাশাপাশি বাড়ছে স্বাস্থ্যঝুকি। তবুও, কৃষকরা থেমে নেই। হাওর অঞ্চলে তারা বানাচ্ছেন ভাসমান বাগান, যা বর্ষাকালেও ফসল দেয়। রাজশাহীতে খরা-সহনশীল মুগডাল ও জোয়ার চাষে পানি ব্যবহারে ৩০-৪০ শতাংশ সাশ্রয় হচ্ছে। সাতক্ষীরা ও খুলনায় লবণাক্ত জমিতে BRRI dhan67, Binadhan-10 I BRRI dhan97, BRRIdhan-87  জাতের সহনশীল ধান আবার ফিরিয়ে আনছে আশার আলো। বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট (BARI), ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট (BRRI) ও ব্র্যাক (BRAC) এসব উদ্ভাবনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখছে। তবে এই সাফল্যকে ছড়িয়ে দিতে দরকার নীতিগত সহায়তা, প্রশিক্ষণ ও সহজ ঋণসুবিধা। কম নির্গমন, তবু বড় ক্ষতি। 

বাংলাদেশ জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশ নয়, বৈশ্বিক গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের অংশ মাত্র ০.৪ শতাংশেরও কম, কিন্তু ঝুঁকির তালিকায় দেশটি শীর্ষ ১০-এর মধ্যে। অনেকটা বাবুদের ফুটানির যোগান দিতে ধুকছে দক্ষিণ এশীয় দেশগুলো। দেশের অভ্যন্তরীণ নির্গমনের বড় অংশ আসে কৃষি, বন ও ভূমি ব্যবহার (AFOLU) খাত থেকে। ২০১২ সালে এই খাতের অংশ ছিল ২৭.৩৫ শতাংশ, যা ২০২১ সালে কমে দাঁড়িয়েছে ১৩.৪৪ শতাংশে। এটি সম্ভব হয়েছে উন্নত রিপোর্টিং ব্যবস্থা (MRV) ও ভূমি ব্যবহারের পরিবর্তনের কারণে। 

তবুও, মোট নির্গমন বেড়েছে- ২০২২ সালে ২৬২.৩ মিলিয়ন টন CO₂ সমতুল্য থেকে ২০২৩ সালে ২৬৩.৬ মিলিয়নে পৌঁছেছে। এই নির্গমন বিলাসিতার নয়, বরং বেঁচে থাকার খরচ। ধানখেতের মিথেন বা গবাদি পশুর নির্গমন জীবিকা নির্বাহের অংশ। কৃষি এখানে কোনো শিল্প দূষণ নয়, বরং মানুষের খাদ্য নিরাপত্তার উৎস। অথচ এই খাদ্য নিরাপত্তা যোগান দিতে গিয়ে যতটুকু কার্বন নির্গমন করছে তার চেয়ে কয়েকগুন বেশি পোহাতে হচ্ছে খারাপ পরিণতির  মূল্যহীন ঘাম ও কৃষকের দারিদ্র্যবাংলাদেশের কৃষকের বড় চ্যালেঞ্জ শুধু প্রকৃতি নয়, বাজারও। প্রতি কেজি বোরো ধান উৎপাদনে কৃষকের খরচ হয় প্রায় ২২-২৫ টাকা, অথচ বিক্রির সময় দাম মেলে মাত্র ১৫-১৬ টাকা।

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (BBS) তথ্য অনুযায়ী, প্রায় ৪৮ শতাংশ কৃষক এখনো দারিদ্র্যসীমার নিচে। মধ্যস্বত্বভোগীর দৌরাত্ম্য, সংরক্ষণ সুবিধার অভাব ও বাজার তথ্যের অপ্রাপ্যতা কৃষককে বাধ্য করছে কম দামে ফসল বিক্রি করতে। একজন কৃষকের ভাষায়, ‘আমরা জাতিকে খাওয়াই, কিন্তু নিজেদের সন্তানদের দিনে তিনবেলা খাওয়াতে পারি না।’ এই বাস্তবতা শুধু অর্থনৈতিক নয়- এটি সামাজিক মর্যাদারও ক্ষয়। উদ্ভাবনেই টিকে থাকার পথ বাংলাদেশের কৃষকেরা কেবল ভুক্তভোগী নন- তারাই অভিযোজনের পথপ্রদর্শক। 

সময়ের প্রয়োজনে নিজেরাই গড়ে তুলছে অভিজনের পথ, সারাবছর পানিতে ডুবে থাকা জলায়শে কচুরিপানার স্তূপ দিয়ে তৈরি করছে চারা, করে চলেছে কৃষির আনায়ন, হাওরে ভাসমান সবজি বাগান প্রতি হেক্টরে ২৫ টন পর্যন্ত সবজি দেয়। খরা অঞ্চলে ড্রিপ সেচ প্রযুক্তি পানি সাশ্রয় করছে ৪০ শতাংশ পর্যন্ত। আর দক্ষিণের লবণাক্ত মাটিতে সহনশীল ধান জাত নতুন আশার সঞ্চার করেছে। একই সঙ্গে ফসল সংগ্রহ-পরবর্তী ক্ষতি কমানোও জরুরি। দেশে উৎপাদিত ফল ও সবজির ২০-৩০ শতাংশ বাজারে পৌঁছানোর আগেই নষ্ট হয়। শীতল সংরক্ষণ, সৌর শুকানো প্রযুক্তি ও ক্ষুদ্র প্রক্রিয়াজাতকরণ- যেমন টমেটো থেকে কেচাপ বা আম থেকে পাল্প তৈরি- ফলে মূল্য সংযোজন ও কর্মসংস্থান দুই-ই বাড়াতে পারে। তবে এসব উদ্যোগ টিকিয়ে রাখতে হলে দরকার নমনীয় ঋণ, ফসল বীমা ও কৃষি-ঝুঁকিভিত্তিক মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যবস্থা। অর্থায়ন কেবল সহায়তা নয়- এটাই জলবায়ু-সহনশীল কৃষির প্রাণশক্তি। নীতিতে কৃষকের স্থান নিশ্চিত করতে হবে। 

বাংলাদেশের জাতীয় অভিযোজন পরিকল্পনা (NAP ২০২৩-২০৫০) এবং ডেল্টা প্ল্যান ২১০০ কৃষি ও জলবায়ু অভিযোজনের জন্য একটি সুস্পষ্ট দিকনির্দেশনা দিয়েছে। কিন্তু বাস্তব পরিবর্তন ঘটবে তখনই, যখন কৃষককে এই নীতির কেন্দ্রবিন্দুতে রাখা হবে। এখন সময় এসেছে নীতির অগ্রাধিকার বদলানোর- উৎপাদন বৃদ্ধির পাশাপাশি কৃষকের আয়, মর্যাদা ও স্থিতিশীল জীবিকা নিশ্চিত করাই হতে হবে মূল লক্ষ্য। 

আজকের বাংলাদেশ এক নতুন কৃষি অধ্যায়ের দ্বারপ্রান্তে- যেখানে প্রযুক্তি, ন্যায্য বাজার, ও জলবায়ু সহনশীলতা মিলেই গড়ে উঠবে টেকসই কৃষির ভবিষ্যৎ। এই নবোদয় থেমে গেলে জাতির সূর্য স্তিমিত হতে বেশি সময় লাগবে না বোধহয়, তাই কৃষক তার সর্বোচ্চটা দিয়ে চেষ্টা করছে এই যুদ্ধে জয়ী হওয়ার, জাতির সূর্য সন্তানেরাই প্রকৃত অর্থে সাধক, দেশের নীতি নির্ধারকদের উচিত এই কৃষকদের পাশে থাকা, যুদ্ধ শুধু রণক্ষেত্রেই হয় না, এখন যুদ্ধ বাংলাদেশের প্রত্যেক কৃষি জমিতে আর কাস্তে হাতে প্রস্তুত দেশের অগণিত সাধক, যারা লড়ছে জলবায়ু পরিবর্তন নামক এক ডাইনোসরের সঙ্গে, গিলে খাওয়ার আগে কৃষক তার সবটুকু নিংড়ে দিচ্ছে,  এই জলবায়ু আলোচনা এখন মাঠে মাঠে কৃষি জমিতে চলছে, ‘In the battle field our farmers  are the lone warrior’'

জলবায়ু পরিবর্তন ও কৃষি নিয়ে কাজ করা সকল স্তরের স্টেকহোল্ডারদের উচিত এখনই এই যুদ্ধের রণকৌশল কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দেওয়া, অন্ন বন্ধ হয়ে গেলে, গাড়ি চলবে না চলবে না শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যানবাহন অথবা আলিশান প্রাসাদ, সকলের উচিত মাঠে নেমে আশা, অন্যথায় ভুল রনকৌশল আর গোলাবারুদের অভাব Climate resilience অঙ্কুরেই বিনষ্ট হয়ে যাবে, জাতি পড়ে যাবে এক ভুতুড়ে ভবিষ্যতের দিকে কৃষকের মাটিতে বপন করা সেই আশার বীজই একদিন হয়ে উঠবে স্থিতিশীল ও মর্যাদাপূর্ণ আগামী বাংলাদেশের প্রতিচ্ছবি।  

লেখক : সেক্টর স্পেশালিস্ট (এগ্রিকালচার) 

কেকে/এআর
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

কাঠালিয়ায় ঝালকাঠির নতুন জেলা প্রশাসকের সাথে মতবিনিময়
ইটনায় জমি বিরোধকে কেন্দ্র করে সংঘর্ষ, নিহত ১
নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান
ফরিদপুরে পাটবীজ বিক্রয় তরান্বিতকরণ বিষয়ক কর্মশালা অনুষ্ঠিত
তিন ভাইয়ের মিশ্র বাগা‌নে কমলার বাম্পার ফলন

সর্বাধিক পঠিত

খালেদা জিয়ার রোগমুক্তি কামনায় বান্দরবানে কুরআন খতম ও মাহফিল
কক্সবাজারে ৭ উপজেলায় ইউএনও রদবদল
কাপাসিয়ায় অবৈধ কয়লা চুল্লি পুনরায় চালু, পরিবেশ বিপর্যস্ত
শেখ হাসিনা-জয়-পুতুলের মামলার রায় আজ, আদালতে বিজিবি মোতায়েন
নার্সিং ও মিডওয়াইফারি অধিদপ্তর বিলুপ্তির প্রতিবাদে কাপাসিয়ায় বিক্ষোভ

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close