জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের (জাবি) জনসংযোগ অফিসে প্রশাসনিক কর্মকর্তা পদে ভাইভায় প্রথম হওয়া হাফিজুর রহমান ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের কমিউনিকেশন অ্যান্ড মাল্টিমিডিয়া জার্নালিজম বিভাগে শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায়ও বাজিমাত করেছেন। তবে তার আবেদনপত্রে অসঙ্গতি থাকা সত্ত্বেও রহস্যজনকভাবে শিক্ষক হিসেবে নিয়োগ পেতে যাচ্ছেন বলে গুঞ্জন উঠেছে। অভিযোগ রয়েছে, তার চেয়ে অধিক যোগ্য প্রার্থীদের কৌশলে বাদ দেওয়া হয়েছে।
জানা যায়, শিক্ষক সংকট নিরসনের লক্ষ্যে গত ৩ আগস্ট ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের জার্নালিজম বিভাগে প্রভাষক পদে নিয়োগ বিজ্ঞপ্তি দেওয়া হয়। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জনসংযোগ অফিসে কর্মরত থেকেও সেই তথ্য গোপন করে ইবিতে প্রভাষক পদে আবেদন করেন তিনি। কোন প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলে এ ধরণের পদে আবেদনের ক্ষেত্রে উক্ত প্রতিষ্ঠানের অনাপত্তিপত্র (এনওসি) নেওয়ার বাধ্যবাধকতা থাকলেও তা মানেননি হাফিজুর রহমান। বরং ইবির সিন্ডিকেট সভার আগে ভিন্ন পন্থায় আবেদন পত্রের সাথে এনওসি যুক্ত করার পায়তারা করছেন বলে অভিযোগ উঠেছে।
শুধু তাই নয়, প্রভাষক পদে আবেদনের ক্ষেত্রে প্রশাসনের আরোপিত শর্তাবলীর অন্যতম প্রধান শর্ত ছিলো স্নাতক ও স্নাতকোত্তরে সিজিপিএ ৪.০০ এর মধ্যে ন্যুনতম ৩.৫০ থাকতে হবে। কিন্তু তিনি স্নাতকোত্তর ফলাফলে ৩.৫০ এর কম পেয়েছেন।
অভিযোগ রয়েছে, গত ২২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত শিক্ষক নিয়োগ বোর্ডে লিখিত পরীক্ষার ফলাফলে দেখা যায়, লিখিত পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হয়ে ভাইবার জন্য মনোনীত হননি হাফিজুর রহমান। তবে তার রোল ছিল ২২। কিন্তু হঠাৎ সংশোধিত ফলাফলে দেখা যায়, সেখানে ২৬ রোলের বদলে নাম এসেছে এই হাফিজুর রহমানের। এ বিষয়ে প্ল্যানিং কমিটির সদস্যরা বলেছেন এটি তাদের সংখ্যাগত একটি ভুল যা তাৎক্ষনিকভাবেই সংশোধন করা হয়।
এদিকে, নিয়োগ পরীক্ষার জন্য যথাসময়ে কার্ড না পাওয়ার অভিযোগ তুলেছেন একাধিক নিয়োগ প্রত্যাশী। একাধিক প্রার্থীর সাথে কথা বলে জানা যায়, বেশ কয়েকদিন আগেই ২২ অক্টোবর বুধবার নিয়োগ পরীক্ষার দিন ধার্য করা হলেও প্রার্থীদের ফোনে তা জানানো হয় ২০ অক্টোবর বিকেল থেকে সন্ধ্যার মধ্যে। ফলে বড় সংখ্যক প্রার্থী পর্যাপ্ত সময় না পাওয়ায় পরীক্ষা দিতে আসেননি। ফলে বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটি ৩৩ জনের সুপারিশ করলেও নিয়োগ পরীক্ষায় অংশ নেন মাত্র ২০ জন প্রার্থী যার মধ্যে ১৩ জনকে ভাইভার জন্য মনোনীত করা হয়।
শুধু ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়েই নয়, হাফিজুর রহমান চমক দেখিয়েছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ে চাকরি পাওয়ার ক্ষেত্রেও। গত বছরের জানুয়ারিতে জাবির জনসংযোগ অফিসের প্রশাসনিক অফিসার পদের পরীক্ষায়ও প্রথম হয়ে বর্তমানে কর্মরত আছেন। প্রশাসনিক অফিসার পদে চাকুরি পেতে নিষিদ্ধ সংগঠন জাবি ছাত্রলীগের সভাপতি আখতারুজ্জামান সোহেল ও সাধারণ সম্পাদক হাবিবুর রহমান লিটন গং চাকরি বাণিজ্য চক্রকে টাকা দিয়ে ম্যানেজ করেছিলেন বলে গোয়েন্দা তথ্য রয়েছে। ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রভাষক নিয়োগের ক্ষেত্রেও একই খেলার মঞ্চায়ন হতে পারে বলে ধারণা করছেন কেও কেও।
অভিযোগের বিষয়ে হাফিজুর রহমান বলেন, ‘আমি অনাপত্তিপত্র নেইনি এটা ঠিক নয়, আমার আবেদন করা ছিল, আমি এনওসি নিয়েছি। আর মাস্টার্সের ফলাফল কম থাকলেও আমার ভারতীয় মাস্টার্স করা আছে, সেটা দিয়েছি। কোন নিয়মের ভেতরে না থাকলে কেন আমাকে প্রশাসন আমাকে পরীক্ষায় বসতে দিবে।’
তবে জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ওয়েবসাইটে তার নামে ইস্যুকৃত কোন এনওসির কপি পাওয়া যায়নি। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের জারিকৃত বিজ্ঞপ্তিতে এমফিল/পিএইচডি থাকলে শর্ত শিথিলের কথা উল্লেখ থাকলেও ডাবল মাস্টার্সের ব্যাপারে কোন কিছু উল্লেখ ছিলো না। ফলে তার ভারতীয় মাস্টার্সের গ্রহণযোগ্যতার ব্যাপারে প্রশ্ন থেকেই যায়।
এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ইবির জার্নালিজম বিভাগের সভাপতি প্রফেসর ড. রশিদুজ্জামান বলেন, ‘আমার জ্ঞান, বিদ্যা, বুদ্ধি, সততা, নৈতিকতা থেকে পুরো প্রক্রিয়াটি পর্যবেক্ষণ করেছি, যে প্রশ্নগুলো এসেছে সেগুলো প্রশ্নযোগ্য মনে হয়নি। কোডিংয়ের বিষয়টিতে আমাদের ভুল ছিলো। তবে এক্ষেত্রে বিষয়টি আরও জরুরি মনে হতো যদি ২৬ রোলের উনি পরীক্ষা দিতো। যারা অনুপস্থিত ছিলো তাদের মধ্যেই এই ২৬ রোল অন্যতম। মানুষ হিসেবে যে ভুল হয় সেটা ছিলো এরকম একটি ভুল যা সংখ্যা মেলাতে গিয়ে হতে পারে। ১৫/২০ মিনিটের মধ্যেই এই ভুল সংশোধন করা হয়।’
হাফিজের চাকরির এনওসির ব্যাপারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, এনওসির বিষয়টি আমি কর্তৃপক্ষকে জানিয়েছিলাম। জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে আমাদের রেজিস্ট্রার বরাবর লেখা ‘যথাযথ কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে প্রেরিত হল’, মর্মে এমন একটি কাগজ তিনি পরবর্তীতে সাবমিট করেছেন এবং আমাদের রেজিস্ট্রার কর্তৃক সেটা গৃহীত হয়েছে যে ‘এই কাগজটি গ্রহণ করা হলো’- সেই কাগজটি আমি দেখেছি। বিশ্ববিদ্যালয় ব্যক্তিগত ভাবে কাওকে কোন কাগজ দিলে সেটা ওয়েবসাইটে যায় কিনা তা আমার জানা নেই।
ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত রেজিস্ট্রার অধ্যাপক ড. মনজুরুল হক বলেন, ‘বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটিকে কোন প্রার্থীকে সুপারিশ করতে বলার কোন এখতিয়ার আমার নেই। ঐ প্রার্থীর ভারতীয় স্নাতকোত্তর ডিগ্রির ফলাফল আবেদনের শর্তাবলীতে উল্লেখিত বাংলাদেশের ৩.৫০ এর সমতুল্য কিনা তা যাচাই করার দায়িত্ব বিভাগীয় প্ল্যানিং কমিটির। এগুলো যাচাই-বাছাই করেই পরবর্তীতে তারা কাউকে সুপারিশ করেন। সেটা আমাদের জায়গা থেকে গ্রহণ করে পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হয়।’
জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের রেজিস্ট্রার দপ্তর থেকে উক্ত প্রার্থী সংশ্লিষ্ট কোন চিঠি পেয়েছেন কিনা জানতে চাইলে ড. মনজুরুল হক বলেন, ‘আমার কাছে কোন প্রার্থীর কোন অনাপত্তিপত্র বা কোন চিঠি আসেনি। এই দাবিটি সত্য নয়। জাবি প্রশাসন থেকে কোন চিঠির ব্যাপারে আমি জানিনা, আমার মনে নেই। যদি ফলাফল কেন্দ্রিক বা চাকরির তথ্য গোপনের কোন ঘটনা ঘটেও থাকে তাহলে সে নিয়োগ পেলেও তা বাতিল হয়ে যাবে।’
কেকে/ আরআই