চট্টগ্রামের ফটিকছড়ির দাঁতমারায় রাজনৈতিক প্রভাব খাটিয়ে বিএনপির এক নেতার নেতৃত্বে সরকারি খাস টিলা কেটে মাটি পাচারের অভিযোগ উঠেছে। দীর্ঘদিন ধরে প্রকাশ্যে টিলা কর্তন ও মাটি পাচার চললেও প্রশাসনের নীরবতা জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে। গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় টিলা কাটার সময় মাটি চাপা পড়ে মো. আরিফ (২০) নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হলে ঘটনাটি প্রকাশ্যে আসে। এ ঘটনায় এলাকায় তীব্র প্রতিক্রিয়া ও তোলপাড় সৃষ্টি হয়েছে।
সরেজমিনে পরিদর্শন ও স্থানীয় সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, উপজেলার দাঁতমারা ইউনিয়নের সোনারখীল মৌজার অধীনে ৪নং সীটের আওতায় বালুখালী চামাঘোনা মনাইয়ার দোকান এলাকায় ইউনিয়ন বিএনপির সহ-দপ্তর সম্পাদক মামুনুর রশিদ মামুন (প্রকাশ পোল্ট্রি মামুন)-এর নেতৃত্বে সরকারি খাস অধিভুক্ত টিলা কাটা চলছে। মামুন ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম চৌধুরীর অনুসারী বলে স্থানীয়রা জানান। টিলা থেকে কাটা মাটি ট্রাকে করে নেওয়া হচ্ছে জনৈক ব্যবসায়ী শাহাদাত হোসেন (প্রকাশ ভাগিনা শাহাদাত)-এর মালিকানাধীন ফসলি জমি এবং বালুখালী এলাকার গাছ ব্যবসায়ী মিয়া সওদাগরের ভিটা ভরাটের কাজে।
এ বিষয়ে বিএনপি নেতা মামুনুর রশিদ মামুন বলেন, মাটি কাটার কাজে আমি জড়িত নই। ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম চৌধুরীর সঙ্গে রাজনীতি করার কারণে একটি গোষ্ঠী হীনস্বার্থে অপপ্রচার চালাচ্ছে।
স্থানীয় সূত্র জানায়, সরকারি খাস টিলা ভূমি দখলদার সিরাজ গং এবং বিএনপি নেতা মামুনের সমন্বয়ে গঠিত সিন্ডিকেট শ্রমিক দিয়ে প্রতি রাতে কেটে এসব মাটি পাচার করছে ইউনিয়নের বিভিন্ন স্থানে। অভিযোগ রয়েছে, স্থানীয় প্রশাসনকে ম্যানেজ করে দীর্ঘদিন ধরে ইউনিয়ন বিএনপির সাধারণ সম্পাদক শফিউল আজম চৌধুরীর শেল্টারে চলছে এসব মাটি কর্তন।
তবে অভিযোগ অস্বীকার করে শফিউল আজম চৌধুরী বলেন, ‘দাঁতমারা এলাকার বিভিন্ন স্থানে মাটি কাটা চলছে। রাতের আঁধারে কারা করছে তা আমাদের জানা নেই। আমি রাজনীতি ও চা বাগান নিয়ে ব্যস্ত। মাটি কাটার কাজে জড়িত হওয়ার প্রশ্নই আসে না।’
অনুসন্ধ্যানে জানা যায়, গত ২৬ অক্টোবর সন্ধ্যায় ৫/৬ জন শ্রমিক টিলার মাটি কাটার সময় ধসে পড়ে টিলার একাংশ। এতে চাপা পড়ে মো.আরিফ নামে এক শ্রমিকের মৃত্যু হয়। বিএনপি নেতা মামুন প্রশাসনকে না জানিয়ে প্রায় ১ ঘণ্টার চেষ্টায় লাশ উদ্ধার করে ১০ কি. মি দূরে নিহতের বাড়িতে নিয়ে যায়। খবর পেয়ে পুলিশ ঘটনাস্থল ও নিহতের বাড়িতে গেলে স্থানীয় ইউপি সদস্য পারভেজ মেম্বারের বাধার মুখে পড়ে। আর্থিক লেনদেনের মাধ্যমে পরিবারকে ম্যানেজ করে ময়নাতদন্ত ছাড়াই আরিফের মরদেহ দাফন করা হয়। নিরুপায় হয়ে পুলিশ থানায় ফেরত যায়। লাশ আনতে পুলিশকে বাধা দেওয়ার বিষয়টি রিউমার (অপপ্রচার) বলে জানান স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. পারভেজ। তিনি বলেন, ‘আমি জনপ্রতিনিধি হয়ে পুলিশকে বাধা দেওয়ার প্রশ্নই আসে না। নিহতের পরিবারের অভিযোগ না থাকায় লাশ ময়নাতদন্ত না করতে সহায়তা করেছি।’
তথ্যানুসন্ধ্যানে আরো জানা যায়, উপজেলার পাইন্দং ইউনিয়নের আমতল ও রাবারবাগান এবং উত্তরাঞ্চলের দাঁতমারা ও বাগানবাজার ইউনিয়নের প্রত্যন্ত এলাকায় প্রতি রাতে চলছে পাহাড় ও টিলা কেটে মাটি পাচারের মহোৎসব। রাত যত গভীর হয় ততই তৎপরতা বেড়ে যায় মাটিখেকোঁদের। জুলাই আগস্টের ছাত্র জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সিন্ডিকেট পরিবর্তন হলেও বন্ধ হয়নি টিলা ও পাহাড় কেটে মাটি পাচার। এতে করে এক দিকে যেমন এসব এলাকার পাহাড় ও টিলাভুমি বিলীন হচ্ছে তেমনি পরিবেশ ও প্রতিবেশের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হচ্ছে। এ ছাড়া রাত বাড়ার সাথে সাথে টিলা কাটার কাজে ব্যবহৃত স্ক্যাভেটর (ভেকু মেশিন) ও মাটি বোঝাই গাড়ির বিকট শব্দে এসব এলাকায় বসবাসকারী মানুষের ঘুম হারাম হয়ে যায়। প্রশাসনের কর্মকর্তা ব্যক্তিদের সাথে এসব মাটিখেকোঁ সিন্ডিকেটের গোপন সমঝোতা থাকায় অনেক সময় সংবাদ সংগ্রহ করতে গিয়ে বেকায়দায় পড়তে হয় সংবাদকর্মীদেরও।
দাঁতমারা ইউনিয়ন বিএনপির সভাপতি বোরহান উদ্দিন বলেন, ‘বিএনপি রাজনীতিতে জড়িতরা পাহাড়-টিলা কর্তনসহ রাষ্ট্রীয় ক্ষতিসাধন এমন কার্যক্রমে জড়িত হওয়ার সুযোগ নেই। এসব কাজে কেউ জড়িত হলে তাদের বিরুদ্ধে সংগঠন ব্যবস্থা নিবে।’
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রাম জেলা অঞ্চলের রিসার্চ অফিসার মো. আশরাফ উদ্দিন বলেন, ‘ক্ষত টিলাগুলো পরিদর্শন করা হবে এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’
এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট মোজাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, ‘বিষয়টি জেনেছি। পরিবেশ অধিদপ্তরকেও অবহিত করেছি। আমরা শীঘ্রই ব্যবস্থা নেব।’
কেকে/এআর