জনস্বাস্থ্যের হুমকি বিবেচনায় বিশ্বের বহু দেশে ‘নিকোটিন পাউচ’ নিষিদ্ধ ও নিয়ন্ত্রণে পদক্ষেপ নিচ্ছে। ঠিক এমন সময়ে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ বহুজাতিক তামাক কোম্পানি ফিলিপ মরিসকে দেশে নিকোটিন পাউচ উৎপাদন কারখানা স্থাপনের অনুমোদন দিয়েছে। তামাক নিয়ন্ত্রণে সরকারের আন্তরিকতা স্বত্ত্বেও বেপজা’র এমন নির্দেশনা জনস্বাস্থ্য বিধ্বংসী পদক্ষেপ, অভিহিত করেছে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতি (বাডাস) ও মাদকদ্রব্য ও নেশা নিরোধ সংস্থা (মানস)।
শনিবার (২৫ অক্টোবর) সংস্থা কর্তৃক প্রেরিত এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উপরোক্ত মন্তব্য করা হয় এবং একই সাথে অনতিবিলম্বে দেশে ‘নিকোটিন পাউচ’ উৎপাদনের অনুমোদন বাতিলে জোর দাবি জানানো হয়েছে। শনিবার সকালে মানস আয়োজিত অনলাইন টকশোতেও একই দাবি উত্থাপন করেন দেশবরেণ্য চিকিৎসকবৃন্দ।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়, অসংক্রামক রোগ প্রতিরোধ ও নিয়ন্ত্রণে সরকারের ৩৫টি মন্ত্রণালয় ও বিভাগ যৌথ ঘোষণায় স্বাক্ষর করেছে। মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা সুস্থ-সবল প্রজন্ম গড়তে তামাক নিয়ন্ত্রণের প্রতি গুরুত্বারোপ করেছেন। সেখানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ (BEZA) কর্তৃক তামাকজাত পণ্যের উৎপাদনের সুযোগ প্রদান জনস্বাস্থ্য সুরক্ষার জন্য একটি প্রাণঘাতি পদক্ষেপ। এবং এটা স্পষ্ট যে, তামাকের প্রসার বৃদ্ধির জন্য এটি তামাক কোম্পানির নতুন অপকৌশল। মূলত: বিদ্যমান ধূমপান ও তামাকজাত দ্রব্য ব্যবহার (নিয়ন্ত্রণ) আইনে ই-সিগারেট/ভ্যাপ জাতীয় পণ্য নিয়ে কোন নিষেধাজ্ঞা না থাকায় এই অপকৌশলের সুযোগ নিচ্ছে তামাক কোম্পানি।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে আরো বলা হয়, অর্থনৈতিক বিনিয়োগ জনবান্ধব না হলে তা কখনোই রাষ্ট্রের উন্নয়নে অবদান রাখে না। বাংলাদেশে তামাকজনিত রোগ, মৃত্যু ও সার্বিক ক্ষয়-ক্ষতি এমনিতেই অনেক বেশি এবং তা বেড়েই চলেছে। বিষয়টিকে অত্যন্ত গুরুত্বের সাথে নিয়ে অন্তরবর্তীকালীন সরকার কাজ করছে। চলতি বছর এসআরও জারী করে ই-সিগারেট ও সংশ্লিষ্ট পণ্য আমদানী নিষিদ্ধ করেছে বানিজ্য মন্ত্রণালয়। এসকল পণ্য উৎপাদনের কারখানা স্থাপনের অনুমতি প্রদান না করার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দিয়েছে প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়। দেশে নতুন তামাক কোম্পানি স্থাপনের অনুমোদন না দেওয়ার বিষয়ে হাইকোর্টের রায় আছে। তা স্বত্ব্বেও দেশে ‘নিকোটিন পাউচ’ উৎপাদনের অনুমোদন অনাকাঙ্খিত এবং ব্যক্তি স্বার্থকেন্ত্রিক। এই ভুল পদক্ষেপ জনগণকে রোগাক্রান্ত করবে, স্বাস্থ্য সেবা ও আর্থিক খাতে চাপ বাড়াবে, মুনাফা লুটবে তামাক কোম্পানি।
উল্লেখ্য, ২০২৩ সালে ফিলিপ মরিস ৩৫ কোটি ‘নিকোটিন পাউচ’ ক্যান বিক্রি করেছে, যা ২০২২ এর তুলনায় ৬২ শতাংশ বেশি ছিল। এজন্যই বহুজাতিক তামাক কোম্পানিগুলো ব্যবসা বাড়াতে উন্নয়নশীল ও কম উন্নত দেশগুলোর দিকে নজর দেয়। বাংলাদেশ তরুণ জনগোষ্ঠির দেশ। এমতাবস্থায়, ফিলিপ মরিসকে বার্ষিক ৫৩৬.৩ ইউনিট নিকোটিন পাউচ উৎপাদন এবং ১.৫৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার সমমূল্যের যন্ত্রপাতি বিদেশ থেকে আমদানির অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। অনুমোদনে ‘নিকোটিন পাউচ’ এর বাজার শতভাগ দেশীয় বাজারের মধ্যে বলে উল্লেখ করা হয়েছে। অর্থাৎ আমাদের কিশোর-তরুণ এবং আগামী প্রজন্মের জন্য তামাকসৃষ্ট আরেকটি মৃত্যুফাঁদ প্রস্তুত হচ্ছে! ফলে বর্তমানে প্রায় ৪ কোটি মানুষ তামাক সেবন করছে এবং ১ লক্ষ ৬১ হাজারের বেশি মানুষ মারা যাচ্ছে, সেই সংখ্যা নিশ্চিতভাবে আরো বাড়বে। যা জনস্বাস্থ্য খাতের সঙ্কট আরো প্রকট করে তুলবে। যা আমাদের কাম্য নয়।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ ডায়াবেটিক সমিতির সভাপতি জাতীয় অধ্যাপক একে আজাদ খান বলেন, স্বাস্থ্যখাত সংস্কারের মাধ্যমে বর্তমান সরকার আগামীর জন্য একটি স্বাস্থ্যবান জাতি নিশ্চিতের লক্ষ্যে কাজ করছে। সকলের সেই উদ্যোগে সামিল হওয়া প্রয়োজন। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা, সিডিসি সহ জনস্বাস্থ্য সম্পর্কিত আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো নিকোটিন পাউচ ক্ষতিকর হিসেবে চিহ্নিত করেছে। সুতরাং জনগণের ক্ষতির কারণ হতে পারে এমন পণ্য দেশে উৎপাদন, বাজারজাতকরণে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক অঞ্চল কর্তৃপক্ষ যে অনুমোদন দিয়েছে তা বাতিল করা প্রয়োজন। উল্লেখ্য, বেলজিয়াম, রাশিয়া, উজবেকিস্তান, ফ্রান্সসহ কমপক্ষে ৩৪টি দেশ ইতিমধ্যে এই নিকোটিন পাউচ বিক্রয় নিষিদ্ধ বা নিয়ন্ত্রণ পদক্ষেপ গ্রহণ করেছে।
মানসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি ও বারডেম হাসপাতালের ভিজিটিং প্রফেসর ড. অরূপরতন চৌধুরী বলেন, নিকোটিন পাউচ উৎপাদনকারী কোম্পানিগুলো মিথ্যা ও বিভ্রান্তিকর তথ্য দিয়ে সরকারের কাছে অনুমোদন নিয়ে থাকে, যা তাদের চিরচারিত রুপ। প্রাপ্তবয়স্কদের জন্য তামাক ও ধূমপান ছাড়তে নিকোটিন পাউচ-কে র প্রতল্প বললেও এর নতুনত্ব, ফ্লেভার ও ডিজাইন নতুন ব্যবহারকারী অর্থাৎ- কিশোর-তরুণরা এর প্রতি অবাধভাবে আসক্ত হতে পারে। বাংলাদেশে যখন তামাকের প্রকোপ অসহনীয়, তখন নতুন বিপদ টেনে আনা বোকামি সিদ্ধান্ত যার মাসুল চড়া হতে পারে। মাত্র ৬৩ জন লোকের কর্মসংস্থান এবং প্রায় ৫১ কোটি টাকার প্রকল্পের দোহাই দিয়ে জাতিকে ক্ষতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে। আইন সংশোধনীর এসময় এ ধরনের পণ্য উৎপাদনের অনুমোদন কোনভাবেই নীতি ও আইনসম্মত নয়।
কেকে/এআর