রাজধানীর মোহাম্মদপুরের জেনেভা ক্যাম্পে আবারও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। মাদক কারবারীদের আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করে দুই গ্রুপের সংঘর্ষে ককটেল বিস্ফোরণে মো. জাহিদ (২০) নামে এক যুবক নিহত হয়েছেন। এছাড়াও এখন পর্যন্ত ৮-৯ জন সংঘর্ষে নিহত হয়েছে। এরা হচ্ছে জাহিদ, সনু, শাহআলম, শাহনেওয়াজ, শিশু সাজ্জাদ, রাজা, শাহেন শাহ ও সাগর।
বুধবার (২২ অক্টোবর) দিবাগত রাত সাড়ে ৩টার দিকে এ ঘটনা ঘটে।
গুরুতর আহত অবস্থায় জাহিদকে উদ্ধার করে ঢাকা মেডিকেল কলেজ (ঢামেক) হাসপাতালে নিয়ে গেলে কর্তব্যরত চিকিৎসক ভোরে তাকে মৃত ঘোষণা করেন।
ঢামেক হাসপাতাল পুলিশ ফাঁড়ির ইনচার্জ পরিদর্শক মো. ফারুক ঘটনার সত্যতা নিশ্চিত করে জানান, নিহতের মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে এবং বিষয়টি সংশ্লিষ্ট থানাকে অবগত করা হয়েছে।
নিহতের স্বজনদের বরাতে জানা গেছে, জাহিদ মোবাইল সার্ভিসিংয়ের দোকানে কাজ করতেন। ঘটনার রাতে বন্ধুদের সঙ্গে বাইরে বের হলে দুই গ্রুপের সংঘর্ষের মাঝে পড়ে যান। এ সময় তার পায়ের কাছে ককটেল বিস্ফোরণ হলে তিনি গুরুতর আহত হন। পরে তাকে ট্রমা সেন্টার হয়ে ঢামেকে নেয়া হলে চিকিৎসক মৃত ঘোষণা করেন।
১৪ মাসে নিহত অন্তত ৯ জন:
জেনেভা ক্যাম্পে গত ১৪ মাসে মাদক ব্যবসায়ীদের সংঘর্ষে অন্তত ৮ থেকে ৯ জন নিহত হয়েছেন। তাদের মধ্যে রয়েছেন— জাহিদ, সনু, শাহআলম, শাহনেওয়াজ, শিশু সাজ্জাদ, রাজা, শাহেন শাহ ও সাগর।
এলাকাবাসীর দাবি, প্রায় প্রতিনিয়তই ক্যাম্পে মাদক কারবারীদের দফায় দফায় সংঘর্ষ, গোলাগুলি ও ককটেল বিস্ফোরণের ঘটনা ঘটছে। এতে সাধারণ মানুষ আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছে।
দফায় দফায় সংঘর্ষ চলছেই:
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বুনিয়া সোহেল গ্রুপ এবং পিচ্চি রাজা-চুয়া সেলিম গ্রুপের মধ্যে আধিপত্যের লড়াই চলছে দীর্ঘদিন ধরে। সম্প্রতি দুইদিন আগে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী ক্যাম্প এলাকা থেকে ৩২টি ককটেলসহ বেশ কয়েকজনকে আটক করেছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তথ্যমতে, গত বছরের ৫ আগস্টের পর থেকে এখন পর্যন্ত ক্যাম্পে অন্তত ৫০টি সংঘর্ষের ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তি গ্রেফতার হয়েছে।
সক্রিয় চারটি গ্রুপ:
মোহাম্মদপুর জেনেভা ক্যাম্পে বর্তমানে সক্রিয় রয়েছে চারটি বড় মাদক ব্যবসায়ী গ্রুপ—বুনিয়া সোহেল গ্রুপ (৬০–৭০ জন সদস্য), চুয়া সেলিম গ্রুপ (৫০–৬০ জন সদস্য), পিচ্চি রাজা গ্রুপ (৩০–৪০ জন সদস্য) এবং নবগঠিত ‘শান্তি বাহিনী’ (৫০–৬০ জন সদস্য)।
সব গ্রুপের সদস্যরাই একাধিক মাদক মামলা ও অন্যান্য অপরাধে জড়িত বলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সূত্রে জানা গেছে। কেউ কেউ গ্রেফতার হয়ে জামিনে বেরিয়ে পুনরায় একই কর্মকাণ্ডে লিপ্ত হয়েছেন।
স্থানীয়দের আতঙ্ক ও দাবি:
নিরবচ্ছিন্ন সংঘর্ষ, ককটেল বিস্ফোরণ ও গুলির শব্দে আতঙ্কে দিন কাটাচ্ছেন ক্যাম্পের সাধারণ মানুষ। তারা বলছেন, “রাত হলে মনে হয় যুদ্ধ শুরু হয়। বাচ্চা নিয়ে ঘর থেকে বের হওয়া যায় না।”
স্থানীয়রা দ্রুত মাদক চক্রের বিরুদ্ধে কঠোর অভিযান ও স্থায়ী শান্তি প্রতিষ্ঠার জন্য সরকারের কার্যকর পদক্ষেপ কামনা করেছেন।
মাদক ব্যবসায়ীদের দৌরাত্ম্য কমছে, অভিযান অব্যাহত:
তেজগাঁও বিভাগের মোহাম্মদপুর জোনের সহকারী পুলিশ কমিশনার (এসি) মো. আব্দুল্লাহ আল মামুন খোলা কাগজকে বলেন, “গতকালকের ঘটনায় জাহিদ নামে এক যুবক নিহত হওয়ার পরপরই আমরা ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠিয়েছি। এখন পর্যন্ত দুইজনকে আটক করা হয়েছে। গতকাল রাত থেকে জেনেভা ক্যাম্প এলাকায় অভিযান চলমান রয়েছে।”
মাদক ব্যবসায়ী চক্র সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, “এই এলাকায় চার থেকে পাঁচটি গ্রুপ সক্রিয় রয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে গ্রেফতার অভিযান অব্যাহত আছে।”
তিনি আরও জানান, “গত ৫ আগস্টের পর থেকে এ পর্যন্ত সংঘর্ষে ৮–৯ জন নিরীহ মানুষ নিহত হয়েছে। তবে সম্প্রতি এই সংখ্যা কিছুটা কমে এসেছে। গত আট মাসে দুইজন নিহত হয়েছেন। আশা করছি, এভাবে পরিস্থিতি আরও স্বাভাবিক হবে।”
এসি মামুন বলেন, “এখানে মূলত মাদক ব্যবসার আধিপত্য বিস্তারকে কেন্দ্র করেই সংঘর্ষের ঘটনা ঘটে থাকে। আমরা এসব চক্রের বিরুদ্ধে নিয়মিত অভিযান চালাচ্ছি। ইতোমধ্যে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী শত শত মাদক ব্যবসায়ীকে গ্রেফতার করেছে। আমাদের অভিযান চলমান থাকবে।”
কেকে/ এমএ