সীমান্তের কাঁটাতারের বেড়া! মানচিত্রের ওপর টানা এই রেখাটিই দুই দেশের ভৌগোলিক বিভাজন। কিন্তু মানুষের হৃদয়ের বাঁধনকে কি তা কখনও আটকাতে পারে? পারে না।
রোববার (১৯ অক্টোবর) ধরলা নদীর নির্মল জলধারার তীরে তাই রচিত হলো সেই চিরায়ত আবেগের গল্প—যেখানে সীমান্ত কেবল একটি রেখা, আর ধর্ম শুধু মিলনের সেতু।
লালমনিরহাটের দুর্গাপুর ও মোগলহাট এবং ভারতের কোচবিহারের মোগলহাট সীমান্তের ৯২৭ নম্বর পিলারের কাছে প্রতি বছর বসে এই ব্যতিক্রমী ‘সীমান্ত মিলন মেলা’। ৫০ বছরের ঐতিহ্যে ঋদ্ধ এই মেলা কেবল পূজা-অর্চনা নয়, যেন দুই বাংলার আত্মার মিলনক্ষেত্র। যদিও মাঝখানে কয়েক বছর সেটি বন্ধ রেখেছিল ভারতের সরকার।
এই মেলার প্রাণকেন্দ্রে রয়েছে শ্রীশ্রী মা বৃদ্ধেশ্বরী দেবীর পূজা। আর সেখানেই এক অনন্য দৃষ্টান্ত: মন্দিরের পুরোহিত আসেন সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশ থেকে, আর পূজারীর দায়িত্ব পালন করেন ভারতের ভক্তরা। ধর্মীয় আচারে এই পারস্পরিক নির্ভরতাই যেন দুই দেশের মানুষের অটুট বন্ধনের প্রতীক।
বাংলাদেশের পুরোহিত বিকাশ চন্দ্র চক্রবর্তী বলেন, ‘প্রতি বছর হাজার হাজার ভক্ত আসেন। এই মন্দির প্রাঙ্গণ হয়ে ওঠে দুই দেশের ভক্তদের মিলন মেলা। এটা শুধু পূজা নয়, এটা দুই দেশের মানুষের কাছে এক প্রাণের উৎসব।’
ভারতের পূজারী জ্যোতিষ চন্দ্র রায় এর কথায় ধ্বনিত হলো একই সুর, ‘পুরোহিত বাংলাদেশে, পূজারী ভারতে—এর চেয়ে বড় সম্প্রীতির প্রতীক আর কী হতে পারে? দুই দেশের মানুষ মিলেই এই মন্দিরের সব কাজ পরিচালনা করে, সব সহযোগিতা করে।’
এদিন ২০ হাজারের বেশি ভক্ত ও দর্শনার্থীর সমাগম হয়েছিল ধরলা পাড়ে।
এই মিলন মেলার সবচেয়ে করুণ ও মধুর দৃশ্যটি ধরা পড়ল দুই বোনের সাক্ষাতে। প্রায় ১০ বছর ধরে ভিসা ও সীমান্তের বেড়াজালে বিচ্ছিন্ন ছিলেন তারা। বাংলাদেশের শুসিলা রানী (৬০) ও ভারতের নিয়তি রানী (৫০)। কাঁটাতারের বেড়ার কাছে একে অপরকে দেখতে পেয়েই আর কথা বলার শক্তি ছিল না তাদের। দুইজন দুইজনকে বুকে জড়িয়ে ধরে শুধু কাঁদছিলেন, আর তাদের সেই অশ্রুতেই যেন ১০ বছরের বিরহের গাথা লেখা হয়ে গেল।
লালমনিরহাটের আদিতমারী উপজেলার শুসিলা রানী বলেন, ‘মোবাইল ফোনে কথা হয়। কিন্তু মন ভরে না। বুকটা ফেটে যায়। আজ বোনের দেখা পেয়া মনটা জুড়ি গ্যালো।’
বড় বোন এনেছিলেন বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী ইলিশ মাছ ও টাঙ্গাইলের শাড়ি। ছোট বোন নিয়তি রানী নিয়ে এসেছিলেন মিষ্টি, মসলা ও শাড়ি। উপহার বিনিময়ের সময়ও তাদের চোখ থেকে ঝরেছে ভালোবাসার অনর্গল অশ্রুধারা।’
ভারতের কোচবিহারের নিয়তি রানী দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন, ‘৩০ বছর আগোত হামরা ভারতে চলি আসি। বাংলাদেশে খালি দিদি আছে। ১০ বছর পর দিদির সাথে দ্যাখা হওয়াতে মনটা হালকা হয়া গ্যাইল।’
মেলায় আসা সাধারণ মানুষের কাছে এই দিনটি বছরের শ্রেষ্ঠ দিন। লালমনিরহাটের মোগলহাটের প্রশান্ত সেন বলেন, ‘এ মেলায় হিন্দু-মুসলমান সবাই আসে। ভিসা বন্ধ থাকায় এখন এই মেলাই একমাত্র দেখা করার সুযোগ।’
রংপুরের সুধীর চন্দ্র গুপ্ত বলেন, ‘এক বছর ধরে ভারতে যেতে পারি নাই। এখানে এসে আত্মীয়দের বুকে জড়িয়ে ধরেছি। সীমান্তের এই মেলায় কাঁদে সবাই, কিন্তু সেই কান্নায় থাকে আনন্দের সুর। এটা শুধু আবেগ নয়, এটা সীমান্ত পেরোনো প্রেমের এক অফুরন্ত চিত্র। সূর্যোদয়ের সঙ্গে শুরু হওয়া পূজা আর মেলা সূর্যাস্তের আগে শেষ হয়। বিজিবি এবং বিএসএফের কঠোর নজরদারির মধ্যেও এক দিনের জন্য সীমান্তের বিভেদ ভুলে, ধর্মের ভেদাভেদ ঘুচিয়ে এক হয় দুই বাংলার মানুষ।’
লালমনিরহাট ১৫ বিজিবির অধিনায়ক মেজর মেহেদী ইমাম বলেন, ‘এটি দীর্ঘদিন থেকে হয়ে আসছে। আমরা ওই সময় সীমান্তে টহল বৃদ্ধি রেখেছিলাম।’
কেকে/এমএ