বরিশাল জেলার বানারীপাড়া উপজেলায় সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা ২০০ বছরের ঐতিহ্য নদীর ভাসমান ধান-চালের হাট বিলীন হয়ে যাচ্ছে। একসময় এই হাটের বিস্তৃতি বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর মাঝখানে চলে যেত। ক্রেতা ও ব্যবসায়ীরা ক্রয়-বিক্রয়ের জন্য নদীর তীর থেকে এক নৌকা থেকে অন্য নৌকায় চড়ে নদীর মাঝে পৌছে যেতো।
বানারীপাড়া ফেরীঘাট ও লঞ্চঘাট সংলগ্ন নদীর পূর্ব পাড়ে সকাল থেকে দুপুর পর্যন্ত ধান-চাল বেচা কেনায় ব্যস্ত থাকতেন ব্যবসায়ীরা। আর দুপুরের পর সন্ধ্যা নদীর পশ্চিম পাড়ে নাজিরপুর বরাবর নদীতে ভাসমান নৌকায় বসতো ধান বিক্রির হাট। বানারীপাড়ায় এখন পূর্বের মতো ধান নিয়ে নৌকার সারি আর কার্গো বা লঞ্চে চাল বোঝাই করতে দেখা যায় না। দিন-রাত মিল বাড়ীর ঘরের রাইস মিলের শব্দ এখন আর তেমন শোনা যায় না। ধান-চালের ব্যবসায় কুটিয়ালদের ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে।
বানারীপাড়ার বন্দরের উত্তর পারে শতাধিক চালের আড়তের মধ্যে এখন চালু রয়েছে হাতে গোনা কয়েকটি। এ কারণে সন্ধ্যা নদীতে ভাসমান ধান-চালের হাটে ক্রেতা-বিক্রেতা নেই বললেই চলে। এখন আর খুঁজে পাওয়া যায় না সেই ঐতিহ্যবাহী মলঙ্গার বালাম, কাজলা চাল। একসময় বানারীপাড়ার ঐতিহ্যবাহী বালাম চাল মানুষের খুব প্রিয় ছিল। ধান-চালের জন্য বিখ্যাত হওয়ায় ওই সময় জোরালো কন্ঠে বানারীপাড়ার মানুষ নিজের পরিচয় দিয়ে গর্ববোধ করতেন।
কুটিয়াল, শ্রমিক, কয়াল (ওজনকারী), ক্রেতাদের পদচারণায় উত্তরপাড় বন্দর বাজার রাত-দিন জমজমাট থাকতো। সপ্তাহে শনি ও মঙ্গলবার মূল হাট এবং রোব ও বুধবার গালার হাট বসত। বাকি তিন দিন চাল ওঠানো আর দেশের বিভিন্ন মোকামে পাঠানোর কাজে ব্যস্ত থাকতো ব্যবসায়ীরা।
জমজমাট ধান-চালের ব্যবসায় বন্ধ হয়ে যাওয়ায় উপজেলার শত শত মানুষ বেকার হয়ে পড়েছেন।
স্থানীয়রা জানান, অনেকে এলাকা ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন উপজেলায় গিয়ে কুটিয়াল ব্যবসায় করছেন। অনেক কুটিয়াল ঢাকার বুড়িগঙ্গায় খেয়া পারা পারের কাজ করছেন।
ধান-চালের পুরনো আড়ৎদার আ. রশিদ সরদার ও আ. সত্তার জানান, দক্ষিণের জেলা পটুয়াখালী, বরগুনা, পিরোজপুরের বিভিন্ন উপজেলা থেকে ধান কিনে বানারীপাড়ায় এনে বিক্রি করতেন ব্যবসায়ীরা। বিশেষ এক ধরনের নৌকায় করে নিয়ে আসা ধান বানারীপাড়া, স্বরূপকাঠি ও মীরের হাটে বিক্রি করতো। সে ধান কিনে কুটিয়ালরা সিদ্ধ-শুকনা করে ডিজেল রাইস মিলে ছাঁটাই করে চাল তৈরি করতেন। অন্যদিকে, বানারীপাড়ায় প্রাকৃতিকভাবে চাষ করা ফসল ধান, পরিমাণ মতো সিদ্ধ-শুকনা করে ঢেকি ছাঁটার মতো স্থানীয় মিলে বাজারজাত করতেন ব্যবসায়ীরা।
আড়ৎদার আ. গাফফার সরদার জানান, ধান কেনা থেকে শুরু করে বেপারী, মাঝি-মাল্লা, কয়াল (ওজনকারী) শ্রমিকরা সিদ্ধ, শুকনা করার জন্য নারী শ্রমিক দ্বারা মিলে চাল ঝাড়ুনির কাজ করতেন। এরপর কুটিয়াল তার কোষা নৌকার মধ্যে ডোলায় ১৫-২০ মন চাল বোঝাই করে হাটে বা গালায় নিয়ে যেতো।
খেজুরবাড়ির কুটিয়াল আনিস ফকির ও সৈয়দকাঠী দিদিহারের আব্দুল হক জানান, তারা সবাই কুটিয়াল ব্যবসায়ের সাথে জড়িত ছিলেন।
কুটিয়ালরা জানান, এহন আগের হেই জৌলাস (জৌলুস) নাই। বানারীপাড়ার ধান-চালের পুরনো ঐতিহ্যবাহী ব্যবসায়কে ফিরিয়ে আনতে হলে দরকার প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও পৃষ্ঠপোষকতা। বালাম চালের ঐতিহ্য ফিরিয়ে আনতে ধান গবেষণা কেন্দ্র বিশেষ ভূমিকা পালন করতে পারে।
সাধারণ মানুষের চাওয়া-পাওয়া বানারীপাড়ার ২০০ বছরের এই ঐতিহ্য ও বেকারদের কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে যেনো একটি ধান গবেষণা কেন্দ্র গড়ে ওঠে। ধান গবেষণা কেন্দ্র হলে বিশেষ ভূমিকায় হয়তো পুরনো ঐতিহ্য ধরে রাখা সম্ভব বলে আশা প্রকাশ করেছেন এলাকাবাসী।
এ বিষয়ে দায়িত্বপ্রাপ্ত একাধিক উপজেলা নির্বাহী অফিসার ঐতিহ্যবাহী ধান-চালের হাট রক্ষার্থে বিবৃতি দিয়েছেন, বানারীপাড়ার ধান চালের হাট একটি ঐতিহ্যবাহী বাজার ছিলো। বানারীপাড়ার প্রসিদ্ধ মোকাম ধান-চালের হাট অব্যবস্থাপনার কারণে হয়তো বিলুপ্তির পথে, তবে কুটিয়াল,আড়ৎদার ব্যবসায়ী ও প্রশাসনের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নিলে বরিশালের বানারীপাড়ার সন্ধ্যা নদীর বুক চিরে গড়ে ওঠা ঐতিহ্যবাহী ধান-চালের হাটটি রক্ষা করা সম্ভব।
কেকে/ এমএ