কক্সবাজারের চকরিয়া উপজেলা সদর থেকে প্রায় ১৫ কিলোমিটার দূরত্বে বরইতলী-পেকুয়া-মগনামা (বানৌজা) সড়ক লাগোয়া অবস্থিত হারবাং ইউনিয়নের বড়বিল। এ বিলের দক্ষিণে পাশ্ববর্তী বরইতলী ইউনিয়ন। বরইতলী ইউনিয়নের মছনিয়াকাটা ও হারবাং ইউনিয়নের ডবলতলী গ্রামের বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে এ বড়বিলের অবস্থান। এ বিলের আয়তন ও পরিমাণ সম্পর্কে স্থানীয়দের কোন ব্যাক্তির কাছে জানা নেই। তবে উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর সূত্রে জানা গেছে, প্রায় ১ হাজার ২০০ হেক্টর জমি নিয়ে এ বড়বিল বিস্তীর্ণ এলাকা নিয়ে প্রাকৃতিক ভাবে গড়ে উঠেছে।
পুরো বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টি ও হারবাং ছড়ার পানিতে বড়বিলটি পরিপূর্ণ ডুবে থাকে। বছরের অধিকাংশ সময় এ বিল জলবদ্ধতায় নিমজ্জিত থাকায় পুরো বিল জুড়ে লাল, সাদা ও বেগুনি রঙয়ের তিন ধরনের শাপলা জন্মে সমারোহ হয়ে উঠে। বিলের ভেতরে যত এগুতে থাকবে ততোই দেখা মিলবে সাদা শাপলা ফুলের সমারোহ। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে বেশ জনপ্রিয়। এ শাপলা বিক্রি করে প্রায় ৫০টি পরিবার দীর্ঘ এক যুগর অধিক সময় ধরে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।
সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের পুরো এই বড় বিলের ৭০ শতাংশ জমি অথৈ পানিতে তলিয়ে আছে। দুরন্ত কিশোর-কিশোরীরা বিলে মাছ ধরছে। আগাছা পরিস্কার করে অনেকেই নৌকা নিয়ে বিলের গহিনে যাচ্ছে। বিল থেকে শাপলা তুলে জমা করছে নৌকায়। কেউ কেউ বড়বিল থেকে শাপলা তুলে অনেকেই বাজারে বিক্রি করার জন্য সড়কের পাশে স্তুপ করে রেখেছে। ঠিক কত বছর ধরে বিলে শাপলা জন্মাতে শুরু করেছে সঠিকভাবে সে তথ্য কেউ দিতে না পারলেও স্থানীয় কয়েকজন ব্যক্তি বলেন, তাদের জন্মের পর থেকেই এ বিলে শাপলা ফুল ফুটতে দেখছেন তারা।
বড়বিল থেকে শাপলা তুলে স্থানীয় বাজার ও চট্রগ্রাম বিভাগীয় বিভিন্ন শহরে বিক্রি করে বিলের পাশ্ববর্তী এলাকার অসংখ্য পরিবার জীবন জীবিকা নির্বাহ করছেন। বিল সংলগ্ন গ্রামের একাধিক ব্যক্তিরা জানান, বছরের ছয় মাস তারা অনেকেই এই বিলের শাপলার ওপর নির্ভরশীল। এদের কেউ শাপলা তুলে, কেউবা বিল থেকে মাছ শিকার করে বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন আসছেন এলাকার অন্তত ৫০টি পরিবার। বিলে আষাঢ় থেকে শুরু করে ভাদ্র মাস পর্যন্ত শাপলা ফুল পাওয়া যায়।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, উপজেলার বড়বিলের জমির মালিকদের দুঃখ কোনো অবস্থাতে লাঘব হচ্ছে না। প্রায় ৭০০শত হেক্টরের বিলের চাষাবাদ বন্ধ রয়েছে বহু বছর ধরে। ১০ বছর আগে বাংলাদেশ কৃষি উন্নয়ন করপোরেশনের (বিএডিসি) অর্থায়নে দুটি খাল খনন করেও জলাবদ্ধতা নিরসন করা যায়নি। হারবাং ইউনিয়নের দুঃখ হিসেবে খ্যাত বড়বিল জলাবদ্ধতার কারণে আমন ও বোরো মৌসুমে চাষের আওতায় আনা যাচ্ছে না। অথচ এ বিশাল বিলটি জলাবদ্ধতার কবল থেকে রক্ষা করা গেলে প্রতিবছর আট হাজার ৬০০ মেট্রিক টন ধান উৎপাদন করা যেত।
এদিকে, ডিসেম্বর মাসে শুরুর দিকে শীতের মৌসুমে যখন পানি একটু কমে যায় তখন সব শাপলা মরে যায়। ফলে আমন ও বোরো চাষ করা সম্ভব হয় না। বোরো মৌসুমে সামান্য চাষাবাদ হলেও আগাম বৃষ্টিতে বেশির ভাগ এলাকা পানির নিচে তলিয়ে থাকে।
হারবাংয়ের এ বড়বিল থেকে প্রতিদিন শাপলা ফুল বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন উপজেলার হারবাং ইউনিয়নের ৫নম্বর ওয়ার্ডের ডবলতলী এলাকার শাহ আলম, কাসেম, শাহাব উদ্দিন, কালাম। তারা এ প্রতিবেদককে বলেন, সারাদিন কৈ ফোটা রোদ কিংবা মুষলধারে বৃষ্টি, যাই হোক না কেন তাদের বিলে যেতে হয়। শাপলা তুলেই বাজারে বিক্রি করে সংসারের ব্যয়ভার নির্বাহ করতে হয়। তা না হলে তাদের সংসার চলে না।
তারা আরও বলেন, দীর্ঘ ১২বছর ধরে বিল থেকে নিয়মিত শাপলা তুলে বাজারে ও চট্রগ্রাম বিভাগীয় শহরে গাড়ীযোগে গিয়ে বিভিন্ন পয়েন্টে সবজি হিসেবে শাপলা বিক্রি করে আসছে। সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত ৩০০-৪০০ তোড়া (গাদা) শাপলা তোলা হয়। প্রতি তোড়াতে ৪০টি শাপলা থাকে। এক তোড়া (গাদা) ৩০টাকা করে বিক্রি করা হয়। এই শাপলা ফুল বিক্রি করে দৈনিক ৭০০-১০০০টাকা পর্যন্ত আয় হয়।
চকরিয়া উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের কৃষি কর্মকর্তা শাহনাজ ফেরদৌসী কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, শাপলা আসলে কোন কৃষি পণ্যের আওতাভুক্ত পড়েনা। এটি প্রাকৃতিক ভাবে কৃষি জমি, পুকুর কিংবা ডোবাতে জন্মে নেয়। তবে এ বিষয়ে আমাদের কোন পরামর্শ দেয়ার সুযোগ হয়ে ওঠে না। আমরা চেষ্টা করি কৃষকদের সব সময় সহায়তা করার। সাধারণত শাপলা তিন প্রকারের হয়ে থাকে-তৎমধ্যে সাদা, লাল ও বেগুনি রঙয়ের। সাদা ফুল বিশিষ্ট শাপলা সবজি হিসেবে ও লাল রঙ্গের শাপলা ঔষধি কাজে ব্যবহৃত হয়। শাপলা খুব পুষ্টি সমৃদ্ধ সবজি। সাধারণত শাক-সবজির চেয়ে এর পুষ্টিগুণ অনেক বেশি বলে তিনি জানান।
কেকে/ আরআই