২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ফ্যাসিস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন এবং ক্ষমতার নাটকীয় পটপরিবর্তনের পর ভারতের সঙ্গে বাংলাদেশের দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে নাটকীয় পরিবর্তন এসেছে। প্রায় এক বছর ধরে দুদেশের মধ্যে সম্পর্ক খুব একটা আশানুরূপ অবস্থায় পৌঁছাতে পারেনি।
তবে দিল্লিতে অনেকে বিশ্বাস করেন, দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক এখান থেকেও আবার ঘুরে দাঁড়াতে পারে–যদি আবার দুই দেশ অপরের বিশেষ প্রয়োজনকে যথাযথ গুরুত্ব দেয়। যেমন ভারতের বেশি দরকার নিরাপত্তার নিশ্চয়তা আর বাংলাদেশের তিস্তার পানির ন্যায্য বণ্টন।
উভয় দেশ যদি পরস্পরের এই অগ্রাধিকারটা উপলব্ধি করতে পারে, তাহলে সম্পর্কে অগ্রগতি হওয়া সম্ভব বলেই অনেকে মনে করেন অনেকেই। পররাষ্ট্রনীতির বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক শ্রীরাধা দত্ত বলেন, আমরা (বাংলাদেশের) সব জায়গায় দেখি, সোশ্যাল মিডিয়াতে বা অন্য কোথাও–অসম্ভব একটা অ্যান্টি-ইন্ডিয়া রেটোরিক চলে।
তিনি বলেন, এটা তো নিশ্চয়ই সেখানে ইয়ুথরাই করে, কারণ ওদের মধ্যে একটা বিতৃষ্ণা তৈরি হয়েছে। তো সেই জায়গাটা আমাদের পক্ষে বোধহয় একদম স্বাভাবিক করা ... কঠিন, কিন্তু বোধহয় অসম্ভব নয়।
তার যুক্তি হলো, বাংলাদেশের কাছে যেহেতু সবচেয়ে স্পর্শকাতর ইস্যু পানি–সেখানে নদীর সম্পদের ন্যায্য হিস্যা নিশ্চিত করতে পারলেই সম্পর্কে ম্যাজিক ঘটানো সম্ভব।
যেমন ধরুন তাদের কিছু কিছু কনসার্ন আছে, আমি যেটা বিশ্বাস করি–যেমন ওয়াটার। এটাতে কেন ইন্ডিয়া প্রোগ্রেস করেনি, কেন এটা নিয়ে কথা বলতে রাজি হয়নি? সেই জায়গাগুলো যদি একটু দেখা যেত তাহলে আমার মনে হয় ওদের কাছেও কিছু ইতিবাচক বার্তা পাঠাতে পারতাম।
এটা তো সত্যি, আমাদের সিকিওরিটি আমাদের কাছে প্রায়োরিটি, কিন্তু ওদের কাছে তো পানির ভাগাভাগি বা ওয়াটার শেয়ারিংটা প্রায়োরিটি। সেটাতে আমরা একদমই কিছু করিনি।
আর যখন চায়না একটা প্রোপোজাল দিল তিস্তার ম্যানেজমেন্টের, তাতে রেগে গিয়ে বললাম না না ওটা আমরা করব। কিন্তু আমরা কি এগিয়েছিলাম? তাও তো করিনি, না, বেশ হতাশার সুরেই বলেন শ্রীরাধা দত্ত।
অর্থনৈতিক স্বার্থই কি রূপালি রেখা?
এই জটিল বিতর্কে আর একটা মতবাদ হচ্ছে- অর্থনৈতিক স্বার্থ এবং বাণিজ্যিক বাস্তবতাই দুই প্রতিবেশীকে আবার কাছাকাছি আনতে পারে – যেটা অন্য আর কোনো ফ্যাক্টর সেভাবে পারবে না।
আগামী বছর বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত (এলডিসি) দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উন্নীত হচ্ছে–কিন্তু এই ‘প্রোমোশনে’র সঙ্গে সঙ্গেই কোটাসহ বেশ কিছু পুরোনো বাণিজ্য সুবিধা বাতিল হতে যাচ্ছে, অবধারিতভাবে আসতে চলেছে নতুন বেশ কিছু চ্যালেঞ্জ। ভারতে কোনো কোনো বিশেষজ্ঞর বক্তব্য, এই কঠিন সময়ে বাংলাদেশের সবচেয়ে বেশি দরকার ভারতকে।
অর্থনীতিবিদ প্রবীর দের কথায়, সামনের বছর অর্থাৎ ২০২৬ সালে বাংলাদেশ এলিভেট করছে ডেভেলপিং কান্ট্রি হিসেবে। এখন সেই ‘থ্রাস্ট’ ওদের দরকার একটা ... সেই থ্রাস্টটা পেতে গেলে ... মানে একটা ফ্লাইটকে, প্লেনকে টেক-অফের সময় ওপরে উঠতে গেলে যেমন একটা থ্রাস্ট দরকার, এখানেও ঠিক তাই।
আগামী বছরের ডেভেলপিং কান্ট্রিতে ওনারা এলিভেট করার পর সেখান থেকে যদি তারপরে ফ্লাই করতে হয়, মানে লং টাইম অ্যাজ আ ডেভেলপিং ইকোনমি তাহলে বাংলাদেশের দরকার ইন্ডিয়াকে, ভারতবর্ষকে। তো এছাড়া কে ওনাদের হেল্প করতে পারবে? অন্য কোনো কান্ট্রি তো সেভাবে পারবে না।
ভারতের এই সম্ভাব্য সহযোগিতার দৃষ্টান্ত দিতে গিয়ে তিনি টেনে আনছেন মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্রবন্দরের কথা। ধরুন, ওনারা যে পোর্টটা তৈরি করছেন মাতারবাড়িতে, একটা বড় ডিপ সি পোর্ট ... সেই পোর্টটায় বড়জোর ৩৫ শতাংশ নিজেদের কার্গো যাবে আর ৬৫ শতাংশ দরকার ইন্ডিয়া থেকে কার্গো।
প্রবীর দে বলেন, একইভাবে আরো যেসব প্রকল্পের কথা তারা ভাবছেন অন ইকোনমিক ফ্রন্ট আর কানেক্টিভিটি সেগুলোতেও ইন্ডিয়াকে খুব ভালোভাবে দরকার। তারা যদি এটা উপলব্ধি করেন এবং সে অনুযায়ী এংগেজ করেন, তাহলে রিলেশনশিপ আবার ‘কামব্যাক’ করতেই পারে।
ফলে এ মুহূর্তে দ্বিপাক্ষিক সম্পর্কে যে শৈত্য বা ফ্রিজ চলছে সেটা সাময়িক, আগামী দিনে কেটে যেতে বাধ্য, এমনটাও দিল্লিতে অনেকেরই বিশ্বাস। আর তার কারণটাও খুব সহজ, শেষ পর্যন্ত দুজনেরই দুজনকে খুব বেশি করে দরকার।
কেকে/এএস