সীমান্তে ভারতীয় আগ্রাসন দিন দিন বেড়েই চলছে। তাদের অপতৎরতার তালিকায় ফের যুক্ত হলো সীমান্ত হত্যা। গত বছরের ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর প্রকাশ্যে বাংলাদেশ বিরোধী অবস্থান নেয় ভারত। তার প্রভাব পড়ে সীমান্তে নানা উসকানি, পুশইন চালিয়ে যেতে থাকে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)। এরই ধারাবাহিকতায় ফেনী সীমান্তে গুলি করে দুই বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে ভারতের রাষ্ট্রীয় বাহিনীটি।
গত বৃহস্পতিবার রাতে পরশুরাম উপজেলার বাঁশপদুয়া সীমান্তে দুই বাংলাদেশিকে গুলি করে হত্যা করেছে বিএসএফ। এ সময় আহত হয়েছেন আরো দুজন। চাঁপাইনবাবগঞ্জ সীমান্তেও গুলি চালিয়েছে বিএসএফ। এতে দুজন আহত হন। এ ছাড়া দেশের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে আরো ২৬ জনকে পুশইন করা হয়েছে।
পরশুরাম সীমান্তে নিহতরা হলেন লিটন (৩২) ও মো. মিল্লাত হোসেন (২১)। গুলিবিদ্ধ হয়ে মো. আফছার (৩০) নামে একজন চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। গত বৃহস্পতিবার রাত ১২টার দিকে উপজেলার বাসপদুয়া সীমান্ত এলাকায় এ ঘটনা ঘটে। বিজিবির ফেনী ব্যাটালিয়ন (৪ বিজিবি) অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন গণমাধ্যমকে এসব তথ্য নিশ্চিত করেছেন। নিহত লিটন পরশুরাম পৌরসভার বাসপদুয়া এলাকার গাছি মিয়ার ছেলে। আর মিল্লাত একই এলাকার ইউছুফ মিয়ার ছেলে। আহত আফছার তাদের প্রতিবেশী মৃত এয়ার আহম্মদের ছেলে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার রাতে গুথুমা বিওপির আওতাধীন ২১৬৪/৩এস পিলার অতিক্রম করে ভারতের অভ্যন্তরে তারকাঁটা বাউন্ডারির কাছে যান লিটন, মিল্লাত ও আফছার। তখন তাদের লক্ষ্য করে বিএসএফের সদস্যরা গুলি ছোড়েন। এ সময় গুলিবিদ্ধ লিটনকে ভারতে নিয়ে যায় বিএসএফ।
গুরুতর আহত অবস্থায় স্থানীয়রা মিল্লাত ও আফছারকে উদ্ধার করে প্রথমে পরশুরাম উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ও পরে ফেনী জেনারেল হাসপাতালে নেন। সেখানে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মিল্লাতের মৃত্যু হয়।
বিজিবি ৪ ফেনী ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ মোশারফ হোসেন বলেন, বিএসএফের গুলিতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক গুলিবিদ্ধ হওয়ার খবর পেয়ে বিজিবির সদস্যরা তাৎক্ষণিক ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেছেন। নিহত ব্যক্তির মরদেহ ময়নাতদন্তের জন্য ফেনী জেনারেল হাসপাতালের মর্গে রাখা হয়েছে। তিনি আরো বলেন, ‘কেন এবং কোন অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে তারা এত রাতে সীমান্তের শূন্য লাইন অতিক্রম করেছেন, এ বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য সংগ্রহের কাজ চলমান। এ ঘটনায় বিজিবির পক্ষ থেকে বিএসএফকে প্রতিবাদলিপি পাঠানো হবে। কোনো অবস্থাতেই বর্ডারে এ রকম ফায়ারিং (গুলিবর্ষণ) কাম্য নয়।’
এদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার শিংনগর সীমান্তে বিএসএফের গুলিতে বাংলাদেশি দুই যুবক আহত হয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। গত বৃহস্পতিবার ভোর চারটার দিকে সিংনগর বিওপির সীমান্তে এ ঘটনা ঘটে। গুলিবিদ্ধরা হলেন মনাকষা ইউনিয়নের সাহাপাড়া মুন্সিপাড়ার পন্ডিতপাড়ার আরিফুল ইসলাম হানিফের ছেলে সেলিম (২৫) ও মুন্নাপাড়া তারাপুরের সুলতানের ছেলে সুমন (২৮)।
স্থানীয়দের দাবি, গত বৃহস্পতিবার ভোরে ১০ জনের একটি দল শিংনগর সীমান্তের ১৬৪/৫ এর ১ এস পিলার এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে যান। এ সময় বিএসএফের ৭১ ব্যাটালিয়নের দৌলতপুর ক্যাম্পের সদস্যরা তাদের লক্ষ্য করে গুলি ছোড়ে। এতে গুলিবিদ্ধ হন দুই বাংলাদেশি যুবক। এ সময় সঙ্গীরা গুলিবিদ্ধ দুজনকে উদ্ধার করে সারা দিন লুকিয়ে রেখে বিকেলে রাজশাহী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করেন।
তবে বর্ডার গার্ড বাংলাদেশের (বিজিবি) পক্ষ থেকে শুধু সেলিম নামে একজনের গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা জানানো হয়েছে। এ বিষয়ে বিজিবির ৫৩ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল ফাহাদ মাহমুদ রিংকু এক খুদে বার্তার মাধ্যমে করে জানান, এ ব্যাপারে সিংনগর বিওপির পক্ষ থেকে দৌলতপুর ক্যাম্পের বিএসএফের সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। তবে তারা গুলি করার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন।
দুই জেলার সীমান্ত দিয়ে ২৬ জনকে পুশইন
এদিকে পুশইনও থেমে নেই ভারতের। বাংলাদেশের প্রতিবাদ ও আন্তর্জাতিক সমালোচনা সত্ত্বেও অবৈধভাবে নাগরিকদের ঠেলে পাঠাচ্ছে ভারত। গতকাল শুক্রবার ভোরে মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে নারীসহ পাঁচজনকে বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। গতকাল ভোরে উপজেলার সীমান্তবর্তী কুমারশাইল এলাকা থেকে বিজিবির টহল দল তাদের আটক করে। বিজিবি ও স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, গতকাল ভোর সোয়া পাঁচটার দিকে জেলার বড়লেখা উপজেলার লাতু বিওপির সীমান্তবর্তী কুমারশাইল পাহাড়ি এলাকায় বিজিবির একটি টহল দল নারীসহ পাঁচজনকে ঘোরাঘুরি করতে দেখে। পরে তাদের আটক করা হয়। এই পাঁচজনের মধ্যে পুরুষ চারজন ও নারী একজন।
আটক ব্যক্তিরা জিজ্ঞাসাবাদে বলেছেন, দুজন সাত দিন আগে এবং তিনজন তিন থেকে পাঁচ দিন আগে কাজের উদ্দেশ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়া, যশোর, ময়মনসিংহ ও মৌলভীবাজার জেলার সীমান্ত এলাকা দিয়ে অবৈধভাবে ভারতে গিয়েছিলেন। বিএসএফ গত বৃহস্পতিবার রাতে তাদের বাংলাদেশে ঠেলে পাঠিয়েছে। তারা মুন্সীগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নারায়ণগঞ্জ ও রাজশাহী জেলার বাসিন্দা বলে জানিয়েছেন।
বিজিবি ৫২ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মোহাম্মদ আরিফুল হক চৌধুরী আজ জানান, আটক ব্যক্তিদের পরিচয় নিশ্চিত সাপেক্ষে তাদের বিরুদ্ধে যথাযথ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে।
এদিকে শেরপুরের নালিতাবাড়ী উপজেলার নাকুগাঁও সীমান্ত দিয়ে নারী, শিশুসহ ২১ জন রোহিঙ্গাকে ঠেলে পাঠিয়েছে বিএসএফ। গত বৃহস্পতিবার রাত সোয়া একটার দিকে উপজেলার হাতিপাগাড় বিজিবি ক্যাম্পের আওতাধীন নাকুগাঁও সীমান্ত এলাকা দিয়ে তাদের ঠেলে পাঠায় ভারতের কিলাপাড়া বিএসএফ ক্যাম্পের সদস্যরা। পরে বিজিবির টহল দল ওই ২১ জনকে আটক করে স্থানীয় একটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে রাখেন। তাদের মধ্যে প্রাপ্তবয়স্ক ৫ পুরুষ ও ৫ নারী এবং ১১ জন অপ্রাপ্তবয়স্ক ও শিশু।
বিজিবি সূত্রে জানা গেছে, আটক ব্যক্তিরা ছয়টি পরিবারের সদস্য। তারা ২০১৭ সালে কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা শরণার্থী ক্যাম্প থেকে পালিয়ে অবৈধভাবে ভারতের জম্মু-কাশ্মীরে যান, সেখানে তারা শ্রমিক হিসেবে হোটেল ও বাসাবাড়িতে কাজ করতেন। এক মাস আগে ভারতীয় পুলিশের অভিযানের সময় গ্রেফতার হন। পরে তাদের বিএসএফের কাছে হস্তান্তর করে দেশটির পুলিশ।
বিষয়টি নিশ্চিত করে ময়মনসিংহ ব্যাটালিয়ন ৩৯ বিজিবির অধিনায়ক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মেহেদি হাসান বলেন, আটক ব্যক্তিদের বিষয়ে আরও তথ্য যাচাই-বাছাই এবং পরবর্তী কার্যক্রমের প্রক্রিয়া চলছে। এর আগে ১১ জুলাই একই উপজেলার পানিহাতা সীমান্ত দিয়ে শিশুসহ ১১ নারী-পুরুষকে ঠেলে পাঠায় বিএসএফ।
কেকে/ এমএস