নয়া বন্দোবস্তের স্লোগান দিয়ে নতুন রাজনৈতিক দল গঠন করেছিলেন জুলাই অভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীরা। তাদের গঠিত দল জাতীয় নাগরিক পার্টির (এনসিপির) মধ্য দিয়ে সুস্থ রাজনীতির আকাক্সক্ষা করেছিল জনগণ। তবে দল গঠনের ছয় মাস পেরোতেই পুরোনো রাজনৈতিক পথ নিল দলটি। প্রতিপক্ষের প্রতি বিদ্বেষপূর্ণ বক্তব্য, রাজনৈতিক শিষ্টাচারবহির্ভূত বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হচ্ছে দল। এর মধ্যে দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে রাজনৈতিক সহনশীলতা।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া শিক্ষার্থীদের ওপর দেশের মানুষের অনেক প্রত্যাশা রয়েছে। তাদের হাত ধরে দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি পরিবর্তন হতে পারে। কিন্তু তারা সহনশীলতার পথে না হেঁটে কোনো কোনো ক্ষেত্রে বেপরোয়া বক্তব্য দিচ্ছেন। তা দেশের রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য হুমকিস্বরূপ। এতে ফ্যাসিবাদী ঐক্যে ফাটল ধরতে পারে। বিশ্লেষকরা বলছেন, ক্ষমতার মোহে অন্ধ না হয়ে এনসিপির নেতাদের আরো প্রজ্ঞা ও আরো সহনশীলতা দেখাতে হবে।
শনিবার এনসিপির মুখ্য সংগঠক নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারী বলেছেন, ‘আগে আওয়ামী লীগের আমলে নারায়ণগঞ্জে বিখ্যাত গডফাদার শামীম ওসমান ছিল; এখন শুনছি কক্সবাজারে নব্য গডফাদার শিলং থেকে এসেছে। ঘের দখল করছে, মানুষের জায়গা-জমি দখল করছে, চাঁদাবাজি করছে। তার নাম না বললাম, আবার নাকি সে সংস্কার বোঝে না।’ কক্সবাজারে এনসিপি আয়োজিত পথসভায় বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য ও কক্সবাজার-১ আসনের সাবেক সংসদ সদস্য সালাহউদ্দিন আহমদের দিকে ইঙ্গিত করে তিনি এ কথাগুলো বলেন।
‘দেশ গড়তে জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচির’ অংশ হিসেবে শহরের লালদীঘির পাড়ের পাবলিক লাইব্রেরির শহিদ দৌলত ময়দানে আয়োজিত এই পথসভায় আরো উপস্থিত ছিলেন, এনসিপির আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আবদুল্লাহ, জ্যেষ্ঠ যুগ্ম সদস্যসচিব তাসনিম জারা প্রমুখ।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির এই সদস্যদের দিকে ইঙ্গিত করে নাসিরউদ্দিন পাটোয়ারী আরো বলেন, ‘কক্সবাজারের জনতা এ ধরনের সংস্কারবিরোধী, যে পিআর বোঝে না, রাজপথে তাদের ঠেকিয়ে দেবে ইনশআল্লাহ।’
নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর এমন বক্তব্যে উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে কক্সবাজার। ফুঁসে উঠেছেন কক্সবাজারের বিএনপি নেতারা। প্রতিবাদে বিক্ষোভ মিছিল করেছেন তারা। এ সময় ভাঙচুর করা হয়েছে চকরিয়ায় এনসিপির মঞ্চ। কুরুচিপূর্ণ বক্তব্যের প্রতিবাদে বিএনপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতাকর্মীরা দফায় দফায় মিছিল করে প্রতিবাদ জানান। পরিস্থিতি বেগতিক দেখে ঈদগাতে পূর্ব নির্ধারিত পথসভা বাতিল করেছে এনসিপি নেতারা। চকরিয়াতেও বিএনপি নেতাকর্মীদের প্রতিরোধের মুখে পড়ে এনসিপির মঞ্চ ভাঙচুর করেন বিএনপি নেতারা। খবর পেয়ে সেনাবাহিনী ঘটনাস্থলে উপস্থিত হয়ে লাঠিচার্জ করে বিএনপি নেতাদের সরিয়ে দেয়। চকরিয়ায় পূর্বনির্ধারিত সমাবেশ না করেই সেনাবাহিনীর পাহারায় চলে আসেন এনসিপি নেতারা।
চকরিয়া উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক এনামুল হক বলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমদ এ অঞ্চলের মাটি ও মানুষের নেতা। ওনাকে নিয়ে এনসিপি নেতা নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বিষোদ্গারমূলক বক্তব্য দিয়েছে, তা প্রত্যাহার করে জাতির কাছে ক্ষমতা চাইতে হবে।’
প্রত্যক্ষদর্শী স্থানীয় ব্যবসায়ীরা বলেন, দুপুর থেকে এনসিপির পক্ষে মঞ্চ তৈরি করে মাইকিং করা হচ্ছিল। হঠাৎ বিকাল পৌনে চারটার দিকে কিছু লোক লাঠিসোঁটা নিয়ে মঞ্চে হামলা করেন। এনসিপির মাইকিং করা লোকজনকে তাড়িয়ে দেন।
এনসিপির নেতাকর্মীরা বলেন, বিকাল পৌনে চারটার দিকে ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা চকরিয়া জনতা শপিং সেন্টার চত্বরে বানানো ট্রাক মঞ্চটি ভেঙে ফেলেন। এ সময় সমাবেশের ব্যানার ছিঁড়ে ফেলেন ও ট্রাকের কাচ ভাঙচুর করেন। তাৎক্ষণিক সেনাবাহিনী সমাবেশস্থলে পৌঁছে হামলাকারীদের ধাওয়া দেয়।
এনসিপির চকরিয়া উপজেলা সংগঠক খাইরুল বাশার বলেন, ছাত্রদল ও বিএনপির নেতাকর্মীরা লাঠিসোঁটা নিয়ে সমাবেশের মঞ্চ ভাঙচুর করেছেন। ব্যানার ছিঁড়ে ও ট্রাকের কাচ ভাঙচুর করেছেন। পরে বিএনপির নেতাকর্মীরা সমাবেশস্থল দখল করে নিয়ে স্লোগান দেন। চকরিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সংঘর্ষ এড়াতে পুলিশ ও সেনাবাহিনী সতর্ক অবস্থানে রয়েছে। পরিস্থিতি এখন পুলিশের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে। মঞ্চ ভাঙচুরের বিষয়টি এখনো আমরা জানি না।’
এনসিপির কেন্দ্রীয় কমিটির যুগ্ম মুখ্য সংগঠক ইমন সৈয়দ বলেন, ‘চকরিয়ায় আমাদের সমাবেশ ছিল। কিন্তু বিএনপির নেতাকর্মীরা মঞ্চ ভাঙচুর করেছেন। এ কারণে সেখানে অনুষ্ঠান হয়নি। আমাদের নেতা-কর্মীরা চকরিয়ায় অবস্থান করেননি। আমরা বর্তমানে (বিকাল ৫টা ৫ মিনিটে) লামা-থানচি সড়কের ফাসিয়াখালী এলাকায় অবস্থান করছি। আমাদের কেন্দ্রীয় নেতাকর্মীরাও সঙ্গে আছেন। এখানে বিএনপির নেতাকর্মীদের একটা জটলা রয়েছে। আমরা আতঙ্কিত অবস্থায় আছি।’
এদিকে এনসিপির সমাবেশে সালাহউদ্দিন আহমদকে ইঙ্গিত করে দেওয়া বক্তব্যের প্রতিবাদে গতকাল শনিবার সন্ধ্যায় শহরের প্রধান সড়কের ঘুমগাছতলায় পুরোনো শহিদ মিনার চত্বরে প্রতিবাদ সমাবেশ করেছে জেলা ছাত্রদল। সমাবেশে বক্তব্য দেন জেলা ছাত্রদলের সদ্য সাবেক সভাপতি শাহাদাত হোসেন, সাধারণ সম্পাদক ফাহিমুর রহমান, ছাত্রদলের নেতা মিজানুল আলম, সাইফুর রহমান প্রমুখ। এরপর প্রধান সড়কে বিক্ষোভ মিছিল করেন ছাত্রদলের নেতাকর্মীরা। এ সময় এনসিপির নেতাদের বিরুদ্ধে নানা স্লোগান দেওয়া হয়।
সমাবেশে ছাত্রদলের নেতা শাহাদত হোসেন বলেন, ‘সালাহউদ্দিন আহমদ কক্সবাজারের গর্ব। তার বিরুদ্ধে কটূক্তি মানে সমগ্র জেলার মানহানির শামিল। যারা এ ধরনের মন্তব্য করে, তারা কক্সবাজারবাসীর ভালো চায় না।’ ফাহিমুর রহমান বলেন, ‘আমরা রাজনীতিতে ভিন্নমতকে শ্রদ্ধা করি, কিন্তু কুরুচিকর ভাষা কখনো গ্রহণযোগ্য নয়। নাসীরুদ্দীন পাটওয়ারীর বক্তব্য শুধু অশোভন নয় বরং উদ্দেশ্যপ্রণোদিত এবং উসকানিমূলক। তাকে প্রকাশ্যে ক্ষমা চাইতে হবে।’
কেকে/ এমএস