কথা বলতে না দেওয়ার অভিযোগ তুলে ঐকমত্য কমিশনের সংলাপ থেকে বের হয়ে আসেন কয়েকটি রাজনৈতিক দলের নেতারা। গতকাল বুধবার ঢাকার ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে ঐকমত্য কমিশনের দ্বিতীয় ধাপের সংস্কার আলোচনা চলাকালীন এক ঘটনা ঘটে। এ ছাড়া এদিনের বৈঠকে জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল (এনসিসি) গঠনের প্রস্তাবটি প্রাধান্য পেয়েছে। এ বিষয়ে নিয়ে বিএনপির সঙ্গে এনসিপিসহ কয়েকটি দলের মতবিরোধ সৃষ্টি হয়েছে।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশন জানায়, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, দুর্নীতি দমন কমিশনের চেয়ারম্যান এবং পাবলিক সার্ভিস কমিশনের সদস্যদের মতো গুরুত্বপূর্ণ সাংবিধানিক পদগুলোতে নিয়োগ তদারকি করতে স্বাধীন সংস্থা হিসেবে কাজ করবে এনসিসি। এর লক্ষ্য, নির্বাহী বিভাগের একতরফা কর্তৃত্ব সীমিত করা এবং প্রাতিষ্ঠানিক নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্য প্রতিষ্ঠা করা। জানা গেছে, উপস্থিত ৩০টি দলের অধিকাংশই এনসিসি গঠনের সমর্থন দিয়েছে।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ উল্লেখ করেন, তার দল চায় না যে এনসিসি গঠন করা হোক। কারণ, এর মাধ্যমে নির্বাহী শাখার কর্তৃত্ব ক্ষুণ্ন হবে। তিনি বলেন, আমরা বিশ্বাস করি, সংস্কারে বিচার বিভাগ ও নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করার দিকে জোর দেওয়া উচিত। তার পরামর্শ, নতুন সংস্থা তৈরির পরিবর্তে বিদ্যমান আইন সংশোধন করে বর্তমান সার্চ কমিটি ব্যবস্থাকে আরও শক্তিশালী ও স্বচ্ছ করা যেতে পারে।
এদিকে এনসিপি আহ্বায়ক নাহিদ ইসলাম বলেছেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠনের বিষয়ে কিছু দল পক্ষে আর কিছু দল বিপক্ষে। তবে যারা বিপক্ষে রয়েছেন, তাদের পক্ষ থেকে বিকল্প প্রস্তাব দিতে হবে। নাহিদ বলেন, জাতীয় সাংবিধানিক কাউন্সিল গঠন প্রক্রিয়ায় এনসিপির পূর্ণ সমর্থন রয়েছে। কারণ বিগত দিনে নির্বাচন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, দুদক ও মানবাধিকার কমিশনসহ বিভিন্ন সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠান দলীয় করণ করা হয়েছে। বিতর্কিত করা হয়েছে। বিশেষ করে নির্বাচন ব্যবস্থাকে ধ্বংস করা হয়েছে। একতরফা নির্বাচনের বিষয়ে কমিশন সব সময় সাফাই গেয়ে গেছে। আর গুম-খুনে বন্ধে মানবাধিকার কমিশন কোনো ভূমিকা রাখেনি। তিনি বলেন, আমরা চাই, এসব প্রতিষ্ঠানের নিয়োগে যেন সরকারের কোনো হস্তক্ষেপ না থাকা। জনগণের আকাক্সক্ষা বাস্তবায়নের জন্য এসব প্রতিষ্ঠানকে স্বচ্ছ রাখতে হবে।
গত মঙ্গলবারের বৈঠকে উপস্থিত না হলেও গতকাল যোগ দিয়ে এনসিসি গঠনে নিজেদের সমর্থন দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। তবে, এই কাউন্সিল থেকে রাষ্ট্রপতি ও প্রধান বিচারপতিকে বাদ দেওয়ার পরামর্শ দিয়েছে তারা।
এবি পার্টির সভাপতি মুজিবুর রহমান মঞ্জু বলেছেন, এনসিসি গঠনে সমর্থন দেওয়া একটি নৈতিক বাধ্যবাধকতা। আমরা যদি এনসিসির মতো জবাবদিহি ব্যবস্থা তৈরি না করি, তাহলে গণঅভ্যুত্থানের মূল চেতনার সঙ্গে বিশ্বাসঘাতকতা করা হবে।
জাতীয় ঐক্যমত্য কমিশনের ভাইস-চেয়ারম্যান অধ্যাপক আলী রীয়াজ বলেন, নির্বাহী কর্তৃপক্ষকে জবাবদিহি করার জন্য একটি ব্যবস্থা থাকা আবশ্যক। এটাই এনসিসি গঠনের উদ্দেশ্য। আমাদের এমন একটি ব্যবস্থা তৈরি করার সুযোগ রয়েছে, যেখানে ক্ষমতাসীনরা নিয়ন্ত্রণ ও ভারসাম্যের মধ্যে থাকবে।
বৈষম্যের অভিযোগ তুলে বেরিয়ে যায় সিপিবিসহ কয়েকটি দল
বৈষম্যের অভিযোগ তুলে সপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, গণফোরামের সাধারণ সম্পাদক ড. মিজানুর রহমান এবং ১২ দলীয় জোটের সমন্বয়ক শাহাদাত হোসেন সেলিম ঐকমত্য কমিশনের বৈঠক থেকে বেরিয়ে যান। তবে কেউ কেউ পরবর্তী সময়ে ঐকমত্য কমিশনের আশ্বাসে বৈঠকে যোগ দেন।
জামায়াতের নায়েবে আমির ডা. আব্দুল্লাহ মো. তাহেরের বক্তব্যকে কেন্দ্র করে ঐকমত্য কমিশনের সভায় এই উত্তেজনা হয় বলে জানা যায়। অভিযোগের বিষয়ে রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, বৈঠকে বৈষম্য হয়েছে। জামায়াতের তিনজন বলেছে, আমাদের একজন বললেও বাধাগ্রস্ত করেছে। এ বিষয়ে মিজানুর রহমান এবং শাহাদাত হোসেন সেলিমসহ আমরা প্রতিবাদ করেছি। ঐকমত্য কমিশন এটা নোট করেছে, তাই আমরা যাচ্ছি।
শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, আমরা যখন কথা বলেছি, তখন আমাদের থামিয়ে দেওয়া হয়। জামায়াতে ইসলামীর অপ্রাসঙ্গিক কথা বলছিল তখন আমি বললাম- এটা প্রাসঙ্গিক নয়। তখন তিনি বলেছেন, আপনি কতজন লোককে প্রতিনিধিত্ব করেন।
‘আশ্বস্ত করায়’ বৈঠকে ফিরেছে জামায়াত
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস ফোন করে ‘নিরপেক্ষ থাকবেন বলে আস্বস্ত করায়’ জামায়াতে ইসলামী জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে যোগ দিয়েছে বলে জানিয়েছেন দলটির নায়েবে আমির সৈয়দ আবদুল্লাহ মোহাম্মদ তাহের। পাশাপাশি ইউনূস নিরপেক্ষতা হারিয়েছেন অভিযোগ তুলে তিনি বলেছেন, ‘ঐকমত্য কমিশন এখন ইফ, যদিতে আছে, কিন্তুতে যাবে কিনা আল্লায় জানে।’
এর আগে গত মঙ্গলবার জাতীয় ঐকমত্য কমিশনের বৈঠকে জামায়াতে ইসলামীর কোনো সদস্য অংশ নেননি। পরে জাময়াতের পক্ষ থেকে বলা হয়, তারা বৈঠকটি ‘বয়কট’ করেছে। গত ৩ জুন লন্ডনে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের বৈঠকের পরে যে যৌথ ঘোষণা প্রকাশ করা হয় তা ‘যথাযথ’ হয়নি বলে মনে করছে জামায়াত।
ঐকমত্য কমিশনের সংলাপে না আসার কারণ তুলে ধরে জামায়াতের নায়েবে আমির বলেন, ‘আমাদের আপত্তি হলো, এখানে ভালো হইত, তিনি টেলিভিশনে (জাতির উদ্দেশ্যে ভাষণ) কথা বলেছিলেন, এখন বাংলাদেশে এসে সেটাকে রিভাইস করতে পারতেন। কিন্তু সেটা উনি করেন নাই। আমরা বিস্ময়ের সাথে দেখলাম, তিনি একটি দলের সাথে যৌথ বিবৃতি দিয়েছেন। এটা পৃথিবীর ইতিহাসে আছে কিনা আমাদের জানা নাই। আমরা মনে করি এটা নজিরবিহীন ছিল, শুধু জামায়াতে ইসলামী নয়, সকল দলই বিব্রত হয়েছে। যৌথ বিবৃতিতে আমাদের আপত্তি, বিএনপির ব্যাপারে আমাদের কোনো বক্তব্য নেই।’
প্রধান উপদেষ্টা ফোন করার কারণে জামায়াত সংলাপে এসেছে জানিয়ে তাহের বলেন, ‘এর মধ্যে আমাদের সাথে অন্তর্বর্তী সরকারের অনেকে কথা হয়েছে। কাল (মঙ্গলবার) দুপুরে মাননীয় প্রধান উপদেষ্টা আমাদের মাননীয় আমিরের সাথে ফোনে কথা বলেছেন। আমরা আমাদের কথা বলেছি, উনি উপলব্ধি করেছেন। উনি আস্বস্ত করেছে, ওনার সরকার নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবে। কোরো বিশেষ দল বা গোষ্ঠীর প্রতি ঝুঁকে যাওয়া না, তারা নিরপেক্ষ ভূমিকা পালন করবেন। ওনার সাথে কথা বলার পরিপ্রেক্ষিতে আমরা আবার আজকে আসার সিদ্ধান্ত নিই।’
কেকে/এআর