বাংলাদেশের তৈরি পোশাক শিল্পকে ১০০ বিলিয়ন ডলারের রফতানি লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে সময়োপযোগী, অভিজ্ঞ ও সাহসী নেতৃত্বের প্রয়োজন বলে মন্তব্য করেছেন বিজিএমইএর আসন্ন নির্বাচনে সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার মো. আবুল কালাম।
বুধবার (২১ মে) সকালে রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে এক সংবাদ সম্মেলনে ১২ দফা নির্বাচনী ইশতেহার ঘোষণা করেন তিনি। এ সময় আবুল কালাম বলেন, আমি শুধু প্যানেল লিডার নই, আপনাদের সহকর্মী, পোশাক শিল্পের একজন অংশীদার। মাত্র ১২ হাজার ডলারের রফতানি দিয়ে যাত্রা শুরু করে আজ বাংলাদেশ বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রফতানিকারক।
ইশতেহারে উল্লেখযোগ্য ১২টি সুনির্দিষ্ট প্রস্তাব তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে এসএমই সাপোর্ট সেল গঠন করা।
ক্ষুদ্র ও মাঝারি কারখানার জন্য নীতিগত, আর্থিক ও কাঠামোগত সহায়তায় ‘এসএমই সাপোর্ট সেল’ চালুর প্রতিশ্রুতি দিয়ে প্যানেল লিডার মো. আবুল কালাম বলেন, তারা ভ্যাট, এইচএস কোড, অর্ডার বাতিল, বিলম্বিত পেমেন্ট ও চুক্তি সংক্রান্ত আইনি জটিলতা নিরসনে সরকারের সঙ্গে কাজ করবেন।
বিদ্যুৎ ও জ্বালানি নিরাপত্তা
সংকটকালে বিকল্প প্রণোদনার দাবি জানিয়ে আবুল কালাম বলেন, শিল্পের উৎপাদন অব্যাহত রাখতে উৎপাদন মৌসুমে গ্যাস-বিদ্যুতের নিশ্চয়তা দিতে হবে।
ইন্ডাস্ট্রি ৪.০ প্রস্তুতি ও গ্রিন ফান্ডিং ডেস্ক
সম্মিলিত পরিষদ পোশাক শিল্পর শ্রমিক ও ব্যবস্থাপকদের জন্য AI, IoT, ERP, ESG ও কোয়ালিটি কন্ট্রোলে প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করবে।
আবুল কালাম বলেন, সবুজ অর্থায়নের জন্য ‘গ্রিন ফান্ডিং ডেস্ক’ গঠন করে GCF, IFC সহ দেশীয় ও আন্তর্জাতিক উৎস থেকে সহজ শর্ত ও স্বল্প সুদে ঋণ প্রাপ্তিতে তারা সহায়তা করবেন।
পণ্য ও বাজার বহুমুখীকরণ
মার্কেট এক্সপ্যানশন ডেস্ক গঠন করে মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকায় বাজার সম্প্রসারণ ও ইউরোপ-আমেরিকার ওপর নির্ভরতা কমানোর উদ্যোগ থাকবে।
আঞ্চলিক বাণিজ্য সংস্থা ও চেম্বারগুলোর সঙ্গে MoU স্বাক্ষর, B2B মিশন, এক্সপো ও সোর্সিং ফেয়ার-এ অংশগ্রহণের মাধ্যমে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, আফ্রিকা ও দক্ষিণ আমেরিকার সম্ভাবনাময় বাজারে প্রবেশ নিশ্চিত করব। ইউরোপ ও আমেরিকার অতিনির্ভরতা কমিয়ে বৈশ্বিক বাণিজ্য ঝুঁকি হ্রাস করব।
EPB, বিদেশি মিশন ও প্রবাসী নেটওয়ার্কের সঙ্গে যৌথভাবে নতুন ক্রেতা সংযোগ এবং সিনথেটিক, ব্লেন্ড ও আউটারওয়্যার পণ্যের রফতানি বৃদ্ধিতে উদ্যোগ নেওয়া হবে। আমদানি কাঁচামালের ওপর নির্ভরতা কমিয়ে নতুন পণ্যে প্রবেশ ও উচ্চ প্রবৃদ্ধির বাজারে অবস্থান সুদৃঢ় করবে।
LDC-পরবর্তী কৌশল
শুল্ক সুবিধা কমে যাওয়া ঠেকাতে স্মার্ট রাজস্ব নীতি ও প্রণোদনার মাধ্যমে রফতানি প্রবৃদ্ধি, কর্মসংস্থান ও মজুরি স্থিতিশীলতা নিশ্চিত করার পরিকল্পনা রয়েছে।
আবুল কালাম বলেন, এই নীতি স্মার্ট রাজস্ব ব্যবস্থা, ক্রেতা সহযোগিতা ও খাতভিত্তিক সহায়তার মাধ্যমে সব ধরনের কারখানা—বিশেষ করে এসএমই-কে বৈশ্বিক প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে সহায়তা করবে।
বাণিজ্য সহায়তা ও এনবিআর সংস্কার
বন্ড সুবিধা, গ্রিন চ্যানেল চালু, সোর্স ট্যাক্স হ্রাসসহ কাস্টমস-বন্ড-ভ্যাট ব্যবস্থার যুগোপযোগী সংস্কারের ঘোষণা দেওয়া হয়। তিনি বলেন, জরুরি রফতানির জন্য নন-বন্ডেড কারখানায় অস্থায়ী বন্ড সুবিধা
BGMEA–NBR–Customs যৌথ টাস্কফোর্স গঠন
ভ্যাট ও করের নিয়ম সরলীকরণ ভ্যাট ছাড় ও সোর্স ট্যাক্স হ্রাস BGMEA’র
বন্দরে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য গ্রিন চ্যানেল সুবিধা চালুর উদ্যোগ
UP অর্ডার সচল রাখা ও বন্ডেড সরবরাহকারীদের সমন্বয়
সোলার ও জ্বালানি-দক্ষ যন্ত্রপাতির আমদানিতে সবুজ প্রণোদনা
সিন্থেটিক, আউটারওয়্যারসহ নতুন পণ্যে বিশেষ সহায়তা প্যাকেজ
EPIC–ওয়ান স্টপ এক্সপোর্ট সাপোর্ট চালু
রফতানিতে নতুন উদ্যোক্তা, নারী নেতৃত্ব ও এসএমইদের জন্য তথ্যনির্ভর, প্রযুক্তিনির্ভর সেবা কাঠামো চালু করা হবে।
তিনি বলেন, বিজিএমইএতে রেজিস্ট্রেশন, কাস্টমস ও ডকুমেন্টেশনে সহায়তা রফতানি প্রস্তুতি ডেস্ক, বাজার, ক্রেতা মানদণ্ড ও ট্রেন্ডস বিশ্লেষণে নীতিনির্ধারণ পর্যবেক্ষণ সেল, উৎপাদন দক্ষতা পরিমাপ ও তথ্যভিত্তিক বিশ্লেষণে ডিজিটাল ফ্যাক্টরি টুলস এবং প্রযুক্তি গ্রহণে প্রতিষ্ঠানের জন্য কাস্টম গাইডলাইন দিতে স্মার্ট ফ্যাক্টরি রোডম্যাপ তৈরি করা হবে।
ইউনিফায়েড কোড অব কন্ডাক্ট চালু
কালাম বলেন, বিভিন্ন ক্রেতা অডিট একত্র করে একটি একক নীতিমালা তৈরি করা হবে যাতে এসএমই কারখানার কমপ্লায়েন্স সহজ হয়।
আমরা BGMEA অনুমোদিত একটি ‘Unified Code of Conduct’ চালু করব, যা আন্তর্জাতিক ক্রেতা, ILO ও অন্যান্য অংশীদারদের সঙ্গে যৌথভাবে প্রণয়ন করা হবে। এ উদ্যোগ বিশেষভাবে এসএমই কারখানার জন্য কমপ্লায়েন্স সহজ ও কার্যকর করে তুলবে।
আবুল কালাম বলেন, ভবিষ্যৎ সংকট ব্যবস্থাপনার জন্য শ্রমিক সেবা ফান্ডে বাধ্যতামূলক মাসিক সঞ্চয় ব্যবস্থা করা হবে।
সবুজ শিল্পায়ন
সার্কুলার ইকোনমি, নবায়নযোগ্য জ্বালানি ও ডিকার্বনাইজেশনের জন্য কারখানাভিত্তিক রোডম্যাপ ও অর্থায়নের সুযোগ বাড়ানো হবে।
সার্কুলার ইকোনমি
সার্কুলার ইকোনমি বাস্তবায়নে একটি পুর্ণাঙ্গ গাইডলাইন প্রণয়ন করা হবে এবং সকল প্রকার নীতি সহায়তা প্রণয়ন করা হবে।
আবুল কালাম বলেন, সৌর প্রযুক্তিতে বিনিয়োগে দেশি ও বিদেশি উৎস থেকে সহজ লভ্য ঋণের নিশ্চিত করা ও শেয়ারড মডেলেরুফটপ সোলার ব্যবস্থা করা।
এ ছাড়া এনার্জি অডিট, দক্ষতা উন্নয়ন ও কারখানাভিত্তিক ডিকার্বোনাইজেশন রোডম্যাপ প্রণয়নে সহায়তা এবং জ্বালানি সাশ্রয়, বর্জ্যহ্রাস, ক্লাইমেট অ্যাকশন ও ESG সমন্বয়ে সার্টিফিকেশন ও ব্র্যান্ডিং সহায়তা প্রদান করা হবে।
Made in Bangladesh–প্রিমিয়াম এডিশন
বাংলাদেশের ব্র্যান্ডিংয়ে প্রিমিয়াম পণ্যের প্রচারণা, ডিজাইন-ভিত্তিক প্রদর্শনী ও ভিজ্যুয়াল ব্র্যান্ডিং সাপোর্টে আমরা ‘Made in Bangladesh–প্রিমিয়াম এডিশন’ নামে একটি গ্লোবাল ব্র্যান্ডিং ক্যাম্পেইন চালু করব, যেখানে বাংলাদেশকে কেবল সস্তা উৎপাদনের দেশ নয়, বরং আধুনিক, টেকসই ও মূল্য নির্ভর সোর্সিং ডেস্টিনেশন হিসেবে পরিচিত করা হবে।
প্রিমিয়াম ক্রেতাদের জন্য কাস্টমাইজড কনটেন্ট তৈরি ও প্রচার, সদস্যদের জন্য ব্র্যান্ড বিল্ডিং সাপোর্ট–ফটোশুট, ক্যাটালগ, ভার্চুয়ালশোরুম তৈরি করা এবং হাই-এন্ড নিটওয়্যার, আউটারওয়্যার ও সার্কুলার কালেকশন নিয়ে ডিজাইনভিত্তিক প্রদর্শনী করা হবে।
এতে বাংলাদেশের রফতানি ভাবমূর্তি ও বাজার অবস্থান আরো শক্তিশালী করবে বলে মনে করেন সম্মিলিত পরিষদের প্যানেল লিডার।
অ্যাপারেল ডিপ্লোম্যাসি ও এক্সিট পলিসি
তিনি বলেন, আমরা নির্বাচিত হলে একদিকে GSP সুবিধা আদায়ের জন্য কূটনৈতিক প্রচেষ্টা, অন্যদিকে দায়িত্বশীলভাবে কারখানা বন্ধের সুযোগ ও পুনর্বিনিয়োগে সহায়তা থাকবে।
প্যানেল লিডার বলেন, এটি শুধু একটি নির্বাচনী ইশতেহার নয়, এটি হলো সময়োপযোগী ও বাস্তবমুখী রোডম্যাপ, যা পোশাক শিল্পকে একটি স্মার্ট ও ফিউচার ফিট শিল্পে রূপান্তর করবে।
এ ছাড়া অনুষ্ঠানের শুরুতে বিজিএমইএর সাবেক সভাপতি ও সম্মিলিত পরিষদের নির্বাচনের প্রধান সমন্বয়ক ফারুক হাসান তাদের নেতৃত্বে তৈরি পোশাক শিল্পের জন্য তাদের বিভিন্ন অর্জন তুলে ধরেন।
পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউট অব বাংলাদেশের অর্থনীতিবিদ হাসনাত আলম সামগ্রিক অর্থনীতি ও তৈরি পোশাক শিল্পের ওপর একটি প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন।
কেকে/এএম