উত্তরাঞ্চলের বৃহৎ জনপদ গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ। তিস্তা নদীবিধৌত এই উপজেলায় ১৫টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভায় বসবাস প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের। অথচ আধুনিক চিকিৎসাসেবার জন্য এই বিপুল জনগোষ্ঠীর একমাত্র নির্ভরযোগ্য আশ্রয় ‘সুন্দরগঞ্জ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স’ এখন নিজেই চিকিৎসা সংকটে ধুঁকছে।
সরকারি এই হাসপাতাল যেন নিজেই একটি অসুস্থ শরীর—জরুরি শুশ্রূষার অপেক্ষায়। চিকিৎসক ও জনবল সংকটে ন্যুব্জ এই প্রতিষ্ঠান কার্যত চলছে সীমাহীন পরিশ্রমে থাকা চারজন চিকিৎসকের কাঁধে। বহির্বিভাগ, ইনডোর, জরুরি বিভাগ—সবকিছুই সামলাতে হচ্ছে এই চারজনকে, যার ফলে প্রতিদিনই তাদের কাজ করতে হচ্ছে চরম মানসিক ও শারীরিক চাপের মধ্যে।
৫০ শয্যার এই হাসপাতালে প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৫০০ রোগী চিকিৎসা নিতে আসেন। অথচ ২৩টি অনুমোদিত মেডিকেল অফিসার পদের বিপরীতে মাত্র ৭ জন কর্মরত আছেন, যার মধ্যে ২ জন প্রেষণে, ১ জন মাতৃত্বকালীন ছুটিতে। কার্যত মাত্র ৪ জন চিকিৎসক দিয়ে সামলানো হচ্ছে পুরো স্বাস্থ্যসেবা—যা এককথায় অসম্ভবের চেষ্টার নামান্তর।
এছাড়া ৩১৬টি অনুমোদিত পদের মধ্যে ১১৭টি পদই শূন্য—শতকরা প্রায় ৩৭ ভাগ! চিকিৎসক, নার্স, ফার্মাসিস্ট, এমনকি অ্যাম্বুলেন্স চালকও নেই পর্যাপ্ত। অপারেশন থিয়েটার অচল, ইনডোরে থাকা রোগীরা পাচ্ছেন না সঠিকভাবে চিকিৎসাসেবা।
সেখানে দায়িত্ব পালনকারী চার চিকিৎসক দিনরাত পরিশ্রম করে রোগীদের সেবা দেওয়ার চেষ্টা করছেন। কিন্তু একজন চিকিৎসকের পক্ষে দিনে ১২-১৫ ঘণ্টা ডিউটি করে শতশত রোগী দেখা কল্পনারও অতীত। বহু চিকিৎসক না থাকায় একাধিক ওয়ার্ড ও বিভাগ সামলাতে গিয়ে এই চারজন হয়ে পড়েছেন কর্মপরিসীমার বাইরে।
বহির্বিভাগে সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা শতশত রোগীর মুখে বারবার ফিরছে এক প্রশ্ন—‘ডাক্তার কই?’
জরুরি বিভাগে এক বৃদ্ধা রোগী ছটফট করছিলেন। তার মেয়ে আয়েশা বেগম বলেন, ‘সকাল থেকে বসে আছি। ডাক্তার নেই। যারা আছেন, তাদের দিকেই সবাই ছুটছে। তারা একাই কতজনকে দেখবেন?’
উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক বাবুল আহমেদ বলেন, ‘প্রায় সাড়ে আট লাখ মানুষের চিকিৎসা দিতে মাত্র চারজন চিকিৎসক– এটা অমানবিক। তারা অমানুষিক পরিশ্রম করেও রোগীদের যথাযথ সেবা দিতে পারছেন না। দ্রুত চিকিৎসক ও জনবল নিয়োগ জরুরি।’
সুন্দরগঞ্জ উপজেলা জামায়াতে ইসলামীর আমীর শহিদুল ইসলাম সরকার মঞ্জু বলেন, ‘এত বড় জনগোষ্ঠীর জন্য চারজন চিকিৎসক– এটা চরম দুর্ভাগ্যজনক। চিকিৎসা মানুষের মৌলিক অধিকার। রোগীরা যেমন সেবা পাচ্ছেন না, চিকিৎসকেরাও হিমশিম খাচ্ছেন। শূন্য পদে নিয়োগ দিয়ে দ্রুত সংকট নিরসনে দল-মত নির্বিশেষে সবাইকে সোচ্চার হতে হবে।’
এ বিষয়ে উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা ডা. দিবাকর বসাক জানান, 'বর্তমানে মাত্র ৪ জন চিকিৎসক ২৪ ঘণ্টা জরুরি বিভাগ, ইনডোর রোগী ও বহির্বিভাগের সেবা প্রদান করছেন। একেকজন চিকিৎসককে টানা ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করতে হচ্ছে, যা অত্যন্ত কষ্টকর এবং পর্যাপ্ত সেবা নিশ্চিত করা সম্ভব নয়।'
তিনি আরো বলেন, 'বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের ১১টি পদের মধ্যে ৯টি পদ শূন্য, এর মধ্যে গাইনী বিশেষজ্ঞের পদও শূন্য, ফলে সিজার অপারেশন বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, উপসহকারী কমিউনিটি মেডিকেল অফিসার ও ফার্মাসিস্টের পদও শূন্য, যা চিকিৎসা সেবা প্রদানকে আরো কঠিন করে তুলেছে।'
আরো বলেন, ‘এম্বুলেন্স ড্রাইভারের পদ ১৮ মাস ধরে শূন্য, পরিচ্ছন্নতা কর্মী, ওয়ার্ড বয়, আয়া, ওটি বয়, ইলেক্ট্রিশিয়ান পদও শূন্য রয়েছে। এই জনবল সংকটের কারণে সহায়ক সার্ভিসগুলো দিতে সমস্যা হচ্ছে। পদায়ন হলে সুন্দরগঞ্জের সাধারণ মানুষ উন্নত সেবা পাবে।’
কেকে/ এমএস