বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫,
৬ ভাদ্র ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২১ আগস্ট ২০২৫
শিরোনাম: ডেঙ্গুতে একদিনে ৫ জনের মৃত্যু      ‘আমি সিক্স পার্সেন্টে কাজ করেছি’, উপদেষ্টা আসিফের প্রেস সেক্রেটারির অডিও ফাঁস      আবারো সংঘর্ষে ঢাকা-সিটি কলেজের শিক্ষার্থীরা      রাজসাক্ষী হতে চান পুলিশের উপপরিদর্শক শেখ আফজালুল      গাজা সিটি দখলে অভিযান শুরু ইসরায়েলের, নিহত ৮১      গ্যাস সংকটে ঝুঁকিতে বিনিয়োগ-রফতানি      মনোনয়নপত্র জমাদানে উৎসবমুখর পরিবেশ      
বিবিধ
স্মৃতিতে থাকা বিলুপ্তপ্রায় ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র
বিবিধ ডেস্ক
প্রকাশ: শনিবার, ৩ মে, ২০২৫, ৯:৪০ পিএম আপডেট: ০৩.০৫.২০২৫ ৯:৪৮ পিএম
ছবি : সংগৃহীত

ছবি : সংগৃহীত

বাংলাদেশের গ্রামীণ সমাজে এক সময় ব্যবহৃত হতো নানা ধরনের ঐতিহ্যবাহী তৈজসপত্র— যেমন মাটির হাঁড়ি, কলস, শীল-পাটা, দাঁড়িপাল্লা, ঘানি, কাঠের পিঁড়ি, মোড়া, তামার গ্লাস, গামলা, ডোল ইত্যাদি। এগুলো শুধু দৈনন্দিন জীবনের উপকরণ ছিল না, বরং গ্রামীণ জীবনধারা, পরিবেশবান্ধব চিন্তা ও আত্মনির্ভরশীলতার প্রতীক ছিল। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তি, প্লাস্টিক ও ধাতব পণ্যের প্রসারে এই ঐতিহ্যবাহী জিনিসগুলো প্রায় হারিয়ে যেতে বসেছে। নতুন প্রজন্ম অনেকেই এসবের নাম-পরিচয় জানে না। অথচ প্রতিটি উপাদান ছিল আমাদের সংস্কৃতি, ইতিহাস ও জীবনের নিঃশব্দ সাক্ষ্য। এই ঐতিহ্যবাহী উপকরণগুলো শুধুই বস্তু নয়, বরং এগুলোর প্রতিটি বহন করে আমাদের নিজস্ব ইতিহাস, সংস্কৃতি এবং জীবনদর্শনের এক নিঃশব্দ কাহিনি।

কলস : কলস একসময় প্রতিটি ঘরের অপরিহার্য উপাদান ছিল। এটি মূলত মাটির তৈরি একটি জলাধার, যার মুখ ছোট এবং পেট গোলাকার। ঠান্ডা পানি রাখার জন্য কলসের ব্যবহার ছিল সবচেয়ে বেশি। গ্রামীণ মহিলারা কলসে করে পুকুর থেকে পানি এনে ঘরে রাখতেন। অনেক সময় এ কলসে রাখা ঠান্ডা পানি অতিথিকে পরিবেশন করা হতো, যা ছিল সৌজন্যের পরিচায়ক। কলসের ঢাকনি থাকত বাঁশের তৈরি বা কাপড় দিয়ে আবৃত। গ্রীষ্মের প্রচণ্ড গরমে যখন ফ্রিজ ছিল না, তখন কলসের পানি ছিল একমাত্র ঠান্ডা পানির ভরসা। কুমাররা বিশেষ কৌশলে চাকা ঘুরিয়ে কলস তৈরি করতেন এবং সেটি শুকিয়ে পোড়ানো হতো মাটির চুলায়। বিভিন্ন উৎসবে, যেমন— গোসলের সময় নববধূ বা নববধূকে বরণে, কলসের ব্যবহার হতো প্রতীকী অর্থে। তবে বর্তমানে কলসের স্থান নিয়েছে প্লাস্টিক বা স্টিলের বোতল এবং আধুনিক পানির ফিল্টার। ফলে এ ঐতিহ্যবাহী উপকরণটি এখন বিলুপ্তির পথে। এ যেন শুধুই একটি পাত্র নয়, বরং গ্রামীণ বাংলার এক আবেগ, এক সংস্কৃতি।

মাটির হাঁড়ি : মাটির হাঁড়ি একসময় প্রতিটি রান্নাঘরের অঙ্গ ছিল। এর মাধ্যমে চাল রান্না, ভাত সংরক্ষণ এবং তরকারি তৈরি করা হতো। মাটির হাঁড়ির স্বাদ আলাদা, কারণ এটি খাদ্যকে প্রাকৃতিকভাবে রান্না করতে সহায়তা করে। হাঁড়ির ভেতরে থাকা খাদ্য দীর্ঘ সময় গরম থাকে এবং এতে কোনো রাসায়নিক বিক্রিয়া ঘটে না, যা স্বাস্থ্যসম্মত। মাটির হাঁড়ির একাধিক আকার ও ধরন থাকত— কোনোটি ভাত রান্নার জন্য, কোনোটি খিচুড়ি বা পায়েস তৈরির জন্য। বিশেষ করে উৎসব বা ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে মাটির হাঁড়ির ব্যবহার ছিল বেশি। বিয়ের খাওয়া, নবান্ন উৎসব, পহেলা বৈশাখ— সবখানেই মাটির হাঁড়ির উপস্থিতি ছিল স্বাভাবিক দৃশ্য। কুমাররা চাকা ঘুরিয়ে বিশেষ মাপ ও নকশার হাঁড়ি তৈরি করতেন। তবে এখন অ্যালুমিনিয়াম, স্টিল বা প্রেসার কুকারের প্রচলনের ফলে মাটির হাঁড়ির চাহিদা কমে গেছে। এটি শুধু স্বাস্থ্যসম্মত নয়, পরিবেশবান্ধবও বটে। বিলুপ্তপ্রায় এ তৈজসপত্রটিকে সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়া জরুরি।

মাটির দোনি :
ডেলা বা মাটির দোনি হচ্ছে এক ধরনের ছোট মাটির পাত্র, যা গৃহস্থালি জীবনে পানি, দুধ, ঘি বা দই পরিবেশনের কাজে ব্যবহার হতো। এটি দেখতে ছোট আকৃতির, গোলাকার ও মুখ খোলা ধরনের পাত্র। ডেলা মূলত অতিথি আপ্যায়নে ব্যবহৃত হতো, বিশেষ করে খেজুর রস পরিবেশনে। সকালে খেজুর গাছ থেকে রস নামানোর পর ডেলায় ভরে বাড়ির লোকজন খেতেন। গ্রামে এখনো কিছু জায়গায় ডেলার চল থাকলেও তা খুবই সীমিত। শিল্পায়নের সঙ্গে সঙ্গে এ প্রথাগত পাত্রটি হারিয়ে যাচ্ছে। স্টিল, কাঁচ বা প্লাস্টিকের ছোট বাটির আগমনে এর ব্যবহার কমে গেছে। অথচ এক সময় ডেলা ছাড়া গ্রামের কোনো বাড়িতে অতিথি আপ্যায়ন অসম্পূর্ণ মনে করা হতো। এটি শুধু একটি পাত্র ছিল না, ছিল এক ধরনের সৌন্দর্যচর্চা এবং আতিথেয়তার প্রতীক।

হাঁড়ি-পাতিল : হাঁড়ি-পাতিল মাটির কিংবা ধাতব তৈরি দুটি গুরুত্বপূর্ণ রান্নার পাত্র। হাঁড়ি সাধারণত গোলাকৃতি এবং ঢাকনাযুক্ত হয়, আর পাতিল হয় সমান তলায় অপেক্ষাকৃত চওড়া আকৃতির। এদের মূল ব্যবহার রান্না ও সংরক্ষণের কাজে। গ্রামাঞ্চলে একসময় প্রতিটি ঘরে একাধিক হাঁড়ি-পাতিল দেখা যেত, যেগুলো বিভিন্ন রান্নায় ব্যবহার হতো— ভাত, ডাল, তরকারি, পিঠা কিংবা পায়েস। বিশেষ অনুষ্ঠানে বড় হাঁড়িতে একসঙ্গে অনেকজনের খাবার রান্না হতো। এগুলো মাটির, পিতলের কিংবা কাঁসার হতো। পাতিলের ভিতর খাবার দীর্ঘ সময় গরম থাকত এবং বিশেষ স্বাদ থাকত যা আধুনিক পাত্রে অনুপস্থিত। কিন্তু এখন সেগুলোকে স্থান দিয়েছে অ্যালুমিনিয়াম, স্টেইনলেস স্টিল ও প্রেসার কুকার। হাঁড়ি-পাতিল শুধু রান্নার পাত্র ছিল না, ছিল এক ধরনের সংস্কৃতির বহিঃপ্রকাশ।

মাটির সরা :
সরা এক ধরনের চ্যাপ্টা ও পাটাতনের মতো মাটির পাত্র, যা সাধারণত রান্নাঘরে চুলার ওপরে কিংবা পূজায় ব্যবহৃত হতো। সরার উপরে বিভিন্ন ফল, ফুল, চাল, দুধ ইত্যাদি রেখে পূজা-অর্চনায় ব্যবহার করা হতো। পাশাপাশি বাড়ির ভিতরে পানি বা অন্যান্য তরল পদার্থ রাখতেও ব্যবহৃত হতো। গ্রামের মেয়েরা সারার ওপর হাত দিয়ে আলপনা আঁকতেন এবং উৎসব উপলক্ষে এসব সরা শোভা পেত গৃহের উঠোনে। এটি পরিবেশবান্ধব এবং মাটির গন্ধযুক্ত ঐতিহ্যের বহনকারী এক পাত্র। এখন যদিও কিছু ধর্মীয় উৎসবে সরা দেখা যায়, তবে আগের মতো করে নিয়মিত ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত হয়ে গেছে। এটি শুধুই একটি পাত্র নয়, বরং বাংলার নারীদের শিল্পচর্চারও নিদর্শন।

চালুনি : চালুনি একসময় গ্রামীণ ঘরের রান্নাঘরের অপরিহার্য উপাদান ছিল। এটি মূলত বাঁশ বা ধাতব পাত দিয়ে তৈরি হতো এবং বিভিন্ন আকারের ছিদ্রযুক্ত হতো, যার মাধ্যমে চাল বা মসুরির ডাল ছাঁকা হতো। চাল থেকে ময়লা, ধুলা বা ভাঙা দানা আলাদা করার জন্য চালুনির ব্যবহার ছিল বাধ্যতামূলক। বিশেষ করে ধান ভাঙার পর কুঁড়া বা খুদ বাদ দেওয়ার কাজে চালুনি ব্যবহৃত হতো। গ্রামীণ নারীরা বসে বসে ঘরের চালে চালুনি দিয়ে ধান বা চাল ছাঁকতেন— এ দৃশ্য ছিল খুবই চেনা। চালুনির আরেকটি রূপ ছিল হাতচালিত চালুনি, যা দিয়ে শাকসবজি বা মসলা ধোয়া যেত। আধুনিক কালের ইলেকট্রিক রাইস ক্লিনার, প্যাকেটজাত চাল কিংবা প্রক্রিয়াজাত ডাল ও মসুরের ভিড়ে আজ আর চালুনির ব্যবহার নেই বললেই চলে। শহরে তো নয়ই, গ্রামেও চালুনি এখন অতীত স্মৃতি। অথচ এই সরল উপকরণটি ছিল গ্রামীণ জীবনের অন্যতম প্রমাণ, যা প্রতিটি খাবারের মান নিশ্চিত করত। এটি শুধু একটি ছাঁকন যন্ত্র নয়, বরং ছিল পরিশ্রম, যত্ন ও পরিচ্ছন্নতার এক নিদর্শন।

দাঁড়িপাল্লা : দাঁড়িপাল্লা ছিল বাংলার এক সময়ের অন্যতম নির্ভরযোগ্য ও বহুল ব্যবহৃত ওজন পরিমাপক যন্ত্র। এটি সাধারণত দুটি পাত্র (পাল্লা) এবং একটি ভারসাম্য বজায় রাখা দণ্ড নিয়ে তৈরি হতো। মাঝখানে থাকত একটি কাঠ বা লোহার দণ্ড, যার দুই পাশে ঝুলিয়ে দেওয়া হতো পাল্লা দুটি। এক পাশে বসানো হতো ওজনের মানদণ্ড (যেমন : এক সের, আধা সের), অন্য পাশে বসানো হতো মাপা বস্তু— যেমন চাল, ডাল, গম, মসলা ইত্যাদি। দোকানে দোকানে দাঁড়িপাল্লা ছিল অনিবার্য। শুধু দোকান নয়, অনেক গৃহস্থ বাড়িতেও নিজেদের উৎপাদিত শস্য ওজনের জন্য দাঁড়িপাল্লা থাকত। এটি একাধারে গণনা, নির্ভুলতা ও স্বচ্ছতার প্রতীক হিসেবে ব্যবহৃত হতো। আজ ডিজিটাল ওজন যন্ত্র, ইলেকট্রনিক স্কেল কিংবা প্যাকেটজাত পণ্যের যুগে দাঁড়িপাল্লা বিলুপ্ত প্রায়। তবুও যারা এই যন্ত্রের ছন্দে বড় হয়েছেন, তারা জানেন এটি শুধু ওজন মাপার উপায় নয়, বরং এক ধরনের বিশ্বাসযোগ্যতার চিহ্নও ছিল। দাঁড়িপাল্লা ছিল ব্যবসায় সততার প্রতীক— যেখানে প্রতিটি সের ছিল পরিশ্রম আর ন্যায়ের মাপকাঠি।

শীল-পাটা : শীল-পাটা এক সময়ের প্রতিটি গৃহস্থ বাড়ির অপরিহার্য একটি উপকরণ ছিল। এটি মসলা বাটার জন্য ব্যবহৃত হতো এবং সাধারণত কালো পাথর বা গ্রানাইট দিয়ে তৈরি করা হতো। শীল হলো চ্যাপ্টা, গোল বা লম্বাটে একখণ্ড পাথর, যার ওপর রাখা হতো পাটা— এক ধরনের গোল বা বেলনাকার পাথরের দণ্ড। দুটি মিলে হাতের চাপে মসলা বাটতে ব্যবহার হতো। আদা, রসুন, হলুদ, মরিচ, ধনে ইত্যাদি হাত বাটা মসলার গন্ধ ও স্বাদ ছিল অতুলনীয়। এমনকি এখনো অনেক রাঁধুনি বলেন, শীল-পাটায় বাটানো মসলার স্বাদ রান্নায় আলাদা মাত্রা যোগ করে। শীল-পাটা শুধু একটি রান্নার যন্ত্র নয়, এটি ছিল নারীর শ্রম, নিষ্ঠা এবং স্বাদের প্রতি মমত্ববোধের প্রতীক। সকালে উঠে প্রথম কাজই ছিল শীল-পাটায় মসলা বাটা। আধুনিক যুগে ব্লেন্ডার, গ্রাইন্ডার ও প্যাকেটজাত মসলার সুবিধায় শীল-পাটার স্থান হারিয়ে গেছে। অনেক বাড়িতে এটি এখন শৌখিনভাবে রাখা হয়, স্মৃতি হিসেবে। কিন্তু যারা এর স্বাদ একবার পেয়েছেন, তারা জানেন— শীল-পাটা ছিল রান্নাঘরের হৃদয়, যা পরিশ্রম ও প্রেমে রান্নাকে প্রাণবন্ত করত।

ঘানি : ঘানি বাংলার গ্রামীণ অর্থনীতির এক শক্তিশালী প্রতীক। এটি ছিল একটি কাঠের বা লোহার বড় মেশিন, যার মাধ্যমে তিল, সরিষা, নারকেল বা চিনাবাদাম থেকে তেল নিষ্কাশন করা হতো। ঘানির প্রধান অংশ ছিল একটি ভারী কাঠের চক্র, যা গরু বা মহিষ দিয়ে ঘোরানো হতো। তেল নিষ্কাশনের এই প্রক্রিয়ায় কোনো কেমিক্যাল বা গরম করার প্রক্রিয়া থাকত না, ফলে ঘানির তেল ছিল একেবারে বিশুদ্ধ এবং স্বাস্থ্যকর। বিশেষ করে সরিষার তেল— যা রান্না, মাথায় ব্যবহার, বা চিকিৎসায় ব্যবহৃত হতো— তা ঘানিতেই তৈরি হতো। ঘানি ছিল এক ধরনের সামাজিক ব্যবসার কেন্দ্রও। গ্রামের ঘানি ঘিরে চিরাচরিত বন্ধুত্ব, বিনিময়, আস্থা গড়ে উঠত। তবে আধুনিক তেল কারখানা, বিদ্যুৎচালিত মেশিন ও কেমিক্যাল প্রক্রিয়ায় তৈরি তেলের যুগে ঘানির স্থান আজ শুধুই ইতিহাস। আজ এটি আর ব্যবহৃত হয় না বললেই চলে, শুধু কোথাও কোথাও প্রদর্শনী বা লোকজ উৎসবে এটি দেখা যায়। অথচ ঘানি ছিল নির্ভেজাল খাবার আর আত্মনির্ভরশীলতার এক অনন্য প্রতীক— একটি প্রকৃতি ও পরিশ্রমনির্ভর জীবনের স্মারক।

কাঠের পিঁড়ি : কাঠের পিঁড়ি একসময় গ্রামীণ বাংলাদেশে প্রতিটি ঘরের একটি অপরিহার্য বস্তু ছিল। এটি সাধারণত মেহগনি, সেগুন বা অন্য টেকসই কাঠ দিয়ে তৈরি হতো এবং নিচু ও চৌকো আকারে নির্মিত হতো। বাড়িতে বসে খাওয়ার সময়, ছোটখাটো কাজ করতে কিংবা অতিথি আপ্যায়নে এটি ব্যবহার হতো। কখনো কখনো পিঁড়ির ওপর বসেই ছেলে-মেয়েরা পড়াশোনা করত। নারীরা ঘরের কাজ বা রান্নার সময় নিচু হয়ে বসার সুবিধার্থে পিঁড়ি ব্যবহার করতেন। অনেকে নামাজ আদায় করতেও এটি ব্যবহার করতেন। কাঠের কারিগরেরা এসব পিঁড়িতে নানা নকশা ফুটিয়ে তুলতেন, যা পিঁড়িকে শুধু গৃহস্থালির বস্তু নয়, বরং শৈল্পিক একটি অনুষঙ্গেও পরিণত করত। তবে বর্তমানে চেয়ারের প্রচলন, প্লাস্টিকের বসার সরঞ্জাম এবং ফ্লোরে বসার অভ্যাস কমে যাওয়ার ফলে পিঁড়ির ব্যবহার প্রায় বিলুপ্ত। এমনকি নতুন প্রজন্ম অনেকেই ‘পিঁড়ি’ শব্দটির অর্থও জানে না। এটি শুধু বসার আসন ছিল না, ছিল সাদামাটাভাবে জীবনের প্রতিচ্ছবি— একটি সময়ের সরলতা, আভিজাত্যহীন স্বাচ্ছন্দ্যের প্রতীক।

গামলা ও ডোল : গামলা ও ডোল একসময় গ্রামীণ জীবনধারার অঙ্গ ছিল। গামলা সাধারণত অ্যালুমিনিয়াম বা পিতল দিয়ে তৈরি হতো, আর ডোল হতো পিতলের বা টিনের পাত দিয়ে। গামলা ব্যবহৃত হতো মূলত রান্নার আগে চাল-ডাল ধোয়া, মাছ পরিষ্কার, শাকসবজি কাটা, অথবা অতিথিদের পানিতে হাত ধোয়ার সময়। ডোলের ব্যবহার ছিল পানির পাত্র হিসেবে, বিশেষ করে গোসল বা রান্নার সময় পানি আনার কাজে। অনেকে ডোল দিয়ে বাড়ির কুয়ো বা পুকুর থেকে পানি তুলতেন। গামলা-ডোলের এ সাধারণ ব্যবহারগুলোই ছিল সেই সময়ের দৈনন্দিন কাজের অবিচ্ছেদ্য অংশ। গৃহস্থ বাড়িতে এদের অস্তিত্ব ছিল বহু বছর ধরে, কিন্তু এখন এগুলোর স্থান দখল করেছে প্লাস্টিক বা স্টিলের আধুনিক পাত্র। এমনকি অনেক ক্ষেত্রেই ইলেকট্রনিক যন্ত্র, ওয়াটার ফিল্টার বা পাইপলাইনের জলের সুবিধার কারণে গামলা বা ডোলের প্রয়োজনীয়তাও কমে গেছে। তবে এখনো কিছু গ্রামীণ এলাকায় এদের দেখা মেলে। গামলা-ডোল শুধু উপকরণ ছিল না, বরং এগুলোয় ফুটে উঠত গৃহস্থালির কর্মব্যস্ততা, পরিচ্ছন্নতা আর আত্মনির্ভরতার এক প্রাচীন ধারার বহিঃপ্রকাশ।

লাঙল ও জোয়াল : লাঙল ও জোয়াল ছিল প্রাচীন কৃষি ব্যবস্থার মূল ভিত্তি। এই দুটি উপকরণ ছাড়া ফসল উৎপাদনের কল্পনাই করা যেত না। লাঙল একটি কাঠ ও লোহার সমন্বয়ে তৈরি যন্ত্র, যা গরুর সাহায্যে চালিয়ে জমি চাষ করা হতো। জোয়াল ছিল দুটি গরুর ঘাড়ে বসিয়ে তাদের নিয়ন্ত্রণে সাহায্যকারী কাঠের ফ্রেম, যা লাঙলের সঙ্গে যুক্ত থাকত। গ্রামীণ কৃষকের প্রধান সহযোগী ছিল এই লাঙল-জোয়াল। জমি চাষের সময় সকালে সূর্য ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই কৃষক জোয়াল গরুর ঘাড়ে তুলে, লাঙল হাতে মাঠে নামতেন। এটি শুধু কৃষি নয়, পরিশ্রম, সময়ানুবর্তিতা ও প্রকৃতির সঙ্গে নিবিড় সম্পর্কের প্রতীক ছিল। তবে আধুনিক যুগে ট্রাক্টর, পাওয়ার টিলার, ডিস্ক প্লাউ ইত্যাদি যন্ত্র এসে লাঙল-জোয়ালের জায়গা দখল করে নিয়েছে। ফলে এই উপকরণগুলো আজ কেবল স্মৃতির অংশ, কিছু এলাকায় নান্দনিক প্রদর্শনীর বিষয় মাত্র। অথচ এ সরল যন্ত্র দুটি দিয়েই গড়ে উঠেছিল বাংলাদেশের কৃষিভিত্তিক অর্থনীতি। লাঙল ও জোয়াল ছিল কৃষকের গর্ব, তার অস্ত্র— যার সাহায্যে সে তার জীবিকার পথ তৈরি করত।

মোড়া : মোড়া বাংলাদেশের ঐতিহ্যবাহী বসার আসনের একটি অংশ। এটি সাধারণত বাঁশ, বেত, কখনো-কখনো কাঠ দিয়ে তৈরি হতো। মোড়া সাধারণত বৃত্তাকার ও নিচু হয়, তবে অনেকে চতুর্ভুজ বা আয়তাকার মোড়াও তৈরি করতেন। গ্রামীণ ঘরে মোড়া ছিল বহুবিধ ব্যবহারের উপকরণ— খাওয়ার সময়, গল্প করার সময় কিংবা অতিথি আপ্যায়নে মোড়াই ছিল প্রিয় আসন। অনেক সময় নারীরা রান্নার সময় বা হাতের কাজ করতে করতে মোড়ায় বসতেন। মোড়ার একটি সৌন্দর্য ছিল এর হাতের তৈরি বুনন। নানা কারুকার্য ও রঙিন সুতো দিয়ে মোড়াকে করে তোলা হতো দৃষ্টিনন্দন। আজকের দিনে স্টিল, প্লাস্টিক বা সোফার আধিপত্যে মোড়ার স্থান কমে এসেছে। শহরের ঘরবাড়িতে মোড়া প্রায় অদৃশ্য, আর গ্রামে তার ব্যবহারও হ্রাস পেয়েছে। কেউ কেউ এখন শখ করে বা ঐতিহ্য রক্ষায় বাড়িতে মোড়া রাখেন। কিন্তু এটা এক সময়ের প্রতিদিনের জীবনযাপনের একটি নীরব সাক্ষী, যেখানে সরলতা, ব্যবহারিকতা আর গৃহস্থালি নান্দনিকতা মিলেমিশে ছিল।

তামার কলস বা গ্লাস : তামার কলস বা গ্লাস একসময় সুপেয় পানি সংরক্ষণের অন্যতম ভরসা ছিল। ঘরের কোণে রাখা থাকত একটি চকচকে তামার কলস, যার মুখে থাকত মাটির ঢাকনা। এ কলসে ভরা হতো কুয়া বা পুকুর থেকে আনা পানি, আর তা ব্যবহার করা হতো পানীয় হিসেবে। তামা দিয়ে তৈরি গ্লাসে পানি পান করাকে সুস্থতার প্রতীক মনে করা হতো। আয়ুর্বেদ ও প্রাচীন চিকিৎসা মতে, তামার পাত্রে সংরক্ষিত পানি শরীরের জন্য উপকারী। শুধু পান করার উপকরণ হিসেবে নয়, এটি ছিল সামাজিক মর্যাদারও প্রতীক। অনেক পরিবার তামার তৈরি সাজসজ্জার জিনিস হিসেবেও এগুলো সংরক্ষণ করত। আজকের দিনে প্লাস্টিক, সিরামিক বা স্টিলের আধিপত্যে তামার জিনিসপত্র উঠে গেছে। তামা এখন ব্যয়বহুল, আর গৃহস্থালি ব্যবহারেও কম সুবিধাজনক হওয়ায় এর ব্যবহার অনেকটাই কমে গেছে। তবে এটি ছিল পরিবেশবান্ধব, স্বাস্থ্যকর এবং টেকসই এক উপাদান। তামার কলস বা গ্লাস আজ শুধু স্মৃতিতে— একটি সময়ের সৌন্দর্য ও স্বাস্থ্যবোধের পরিচায়ক।

কেকে/এএম



মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

ব্র্যাক ব্যাংকের আস্থা অ্যাপে মিলবে মেটলাইফের বিমা সুবিধা
শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের কৃষি সংস্কার ও খাদ্য নিরাপত্তার অভিযাত্রা
ভূমি অভিযোগ গ্রহণ ও নিস্পত্তিতে নাগরিকদের মতামত জানতে হবে: সিনিয়র সচিব
‘বিচার ও সংস্কার এড়িয়ে নির্বাচন দিলে কাঙ্ক্ষিত গণতন্ত্র আসবে না’
ডোমারে ফেনসিডিলসহ মাদক বিক্রেতা গ্রেফতার

সর্বাধিক পঠিত

ভারতে আ.লীগের কার্যক্রম বন্ধের আহ্বান, অভিযোগ অস্বীকার নয়াদিল্লির
গ্যাস সংকটে ঝুঁকিতে বিনিয়োগ-রফতানি
মনোনয়নপত্র জমাদানে উৎসবমুখর পরিবেশ
‘আমি সিক্স পার্সেন্টে কাজ করেছি’, উপদেষ্টা আসিফের প্রেস সেক্রেটারির অডিও ফাঁস
মেঘনায় স্বেচ্ছাসেবক দলের প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী পালন

বিবিধ- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close