কিশোরগঞ্জের হাওরগুলোতে এখন চলছে পুরোদমে বোরো ধান কাটা। কৃষকরা সোনালী ফসল ঘরে তোলা নিয়ে ব্যস্ত সময় পার করছেন। এদিকে হাওরের আকাশে কালবৈশাখী মেঘের আনাগোনা। বজ্রপাতে ভয় আর উৎকণ্ঠা ছড়িয়ে পড়ছে হাওরগুলোতে। যেকোনো সময় ভারী বৃষ্টিপাত আর বন্যায় তলিয়ে যেতে পারে কষ্টের সোনালী ফসল। আর হাওরের সেই ফসল রক্ষায় প্রতিবছর সরকারিভাবে সংস্কার করা হয় ফসল রক্ষা বাঁধের। কিন্তু সেই ফসল রক্ষা বাঁধ আজ ঝুঁকিতে।
নদীমাতৃক বাংলাদেশের মোট আয়তনের ছয় ভাগের এক ভাগ জুড়ে রয়েছে হাওর-জলাভূমি। হাওরভূমি বাংলাদেশের জাতীয় উন্নয়নের অবিচ্ছেদ্য অংশ। হাওর এলাকার প্রায় ৬৭ শতাংশ জনগণ সরাসরি কৃষির উপর নির্ভরশীল। কিন্তু প্রতি বছরে অকাল বন্যা ও পাহাড়ি ঢলে হাওরে ব্যাপক ফসলহানি ঘটে।
হাওরের ফসল রক্ষার্থে পূর্বে স্থানীয় জনগণ সম্মিলিতভাবে বাঁধের ব্যবস্থা করলে স্বাধীনতার পরে বাংলাদেশ সরকারের ‘পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়’-এর উদ্যোগে বাঁধ নির্মাণ কার্যক্রম চালু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় প্রতিবছর কয়েক কোটি টাকা খরচ করে সরকারি উদ্যোগে হাওর এলাকাগুলোতে ডুবো বাঁধ (সাবমারজিবল এ্যামব্যাঙ্কমেন্ট) নির্মাণ করা হয়। এই বাঁধ দেওয়ার প্রধান উদ্দেশ্যে হচ্ছে হাওরের ফসল রক্ষার পাশাপাশি হাওরের জীব, পরিবেশ ও প্রতিবেশকে রক্ষা করা। কিন্তু কিশোরগঞ্জের হাওরে ঘটেছে এর উল্টো। জেলার ফসল রক্ষার বাঁধগুলো নিজেই পড়েছে ঝুকিঁতে।
সরেজমিনে কিশোরগঞ্জের ইটনা, মিঠামইন, অষ্টগ্রাম, বাজিতপুর, ভৈরব, তাড়াইল, নিকলী, করিমগঞ্জ ও কটিয়াদী উপজেলায় মেরামতকৃত বাঁধগুলো ঘুরে দেখা গেছে দায়সারা সংস্কার।
এগুলোর মধ্যে ইটনা উপজেলার কুনিয়ার হাওর, জিওলের হাওর, তেরালিয়ার হাওর, বাদলার হাওর মিঠামইনের কাজিরখলা বড় হাওর, নওগা হাওর অষ্টগ্রামের দেওঘর হাওর, খয়েরপুর হাওর, ভৈরবে জোয়ানশাহী হাওর, বাজিতপুরে হুমাইপুর হাওর, তাড়াইলে সোনাইর হাওর, করিমগঞ্জে বাদলা হাওর, কটিয়াদীতে বড় হাওরসহ নিকলীতে নোয়াগাঁও হাওর,সাপমারী হাওর, নুন্নীর হাওর, নোয়াপাড়া হাওরে ব্যপক অনিয়মের অভিযোগের সত্যতা মিলেছে।
দেখা গেছে বাঁধ নির্মাণের নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে দায়সারাভাবে বাঁধগুলোর পাশ থেকে গর্ত করে কাটা হয়েছে মাটি। আবার অনেক স্থানে নদী থেকে ভেকু মেশিনের মাধ্যমে কাদামাটি তুলে ফেলা হয়েছে বাঁধে। যার ফলে কাজ সমাপ্ত হওয়ার কিছুদিনের মধ্যে বাঁধগুলোর গোড়া থেকে মাটি ধসে পড়ার দৃশ্য লক্ষ্য করা যায়। অথচ নিয়ম অনুযায়ী দূর থেকে ড্রাম ট্রাকে মাটি এনে বাঁধ মেরামতের কথা। কিন্তু ইটনার জিওলের হাওরে একটি প্রকল্প ছাড়া কোথাও এই নিয়ম মানা হয়নি বলেও অভিযোগের সত্যতা মিলেছে। এতে করে শঙ্কা কাটছে না কৃষকদের।
স্থানীয় কৃষকরা বলছেন, টেক্সসই বাঁধ না হওয়ায় ঝুঁকিতে পড়তে পারে হাওরের অবশিষ্ট বোরো ধান। স্থানীয়দের অভিযোগ, পানি উন্নয়ণ বোর্ডের নজরদারির অভাবে এ বছর হাওরের গুরুত্বপূর্ণ ফসল রক্ষার বাঁধগুলো ঝুঁকিতে পড়েছে। এসব বাঁধ মজবুত না হওয়াতে বাঁধ করা আর না করা সমান। অযথা সরকারের কোটি কোটি টাকা ব্যয়ের কোনো প্রয়োজন ছিল না।
জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা যায়, কিশোরগঞ্জের ৯টি উপজেলায় প্রায় ২৩ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ ১২৯টি ফসল রক্ষা বাঁধ মেরামত প্রকল্প গত ২৮ ফেব্রুয়ারি সম্পন্ন হয়েছে।
এ বিষয়ে কিশোরগঞ্জ জেলা পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. সাজ্জাদ হোসেন বলেন, বাঁধ মেরামত কাজ সার্বক্ষণিক তদারকি করা হয়েছে। যেসকল উপজেলায় কাজের ত্রুটি বিচ্যুতির অভিযোগ পেয়েছি সেগুলো ঠিক করে দেওয়ার জন্য উপজেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে। আর আপনারা যেগুলোতে ত্রুটি পাবেন আমাদেরকে জানাবেন । আমরা সেগুলোও ঠিক করার ব্যবস্থা করবো।
জেলা প্রশাসক ফৌজিয়া খান বলেন, প্রতি বছরই আমরা বাঁধ নিয়ে এমন অভিযোগ পাই। এবার কাউকেই ছাড় দেয়া হবে না। অনিয়ম হলে দায়িদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
কেকে/ এমএস