ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৭ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

জীবন নির্বাহে খরচ বাড়ায় নাভিশ্বাস

জাফর আহমদ
🕐 ১০:১৩ পূর্বাহ্ণ, অক্টোবর ২৫, ২০২১

জীবন নির্বাহে খরচ বাড়ায় নাভিশ্বাস

নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি পাওয়ায় দিশাহারা তৈরি পোশাক শিল্পের শ্রমিকসহ শ্রসজীবী মানুষ। যে হারে বেতন বা আয় বেড়েছে, নিত্যপণ্যের দাম বেড়েছে তার দ্বিগুন। ফলে প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে শ্রমিকদের চলা কঠিন হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে কম খেয়ে, খরচ কমিয়ে কোনো মতে চলতে হচ্ছে।

তিন বছরে নিত্যপণ্যের খরচ বৃদ্ধিজনিত কারণে ব্যয় বেড়েছে প্রায় দ্বিগুন। তিনবছরে চালের দাম বেড়েছে প্রায় ৫০ শতাংশ। সবজির দাম বেড়েছে দ্বিগুন। পেঁয়াজ, তেল, ডালের অস্বাভাবিক হারে বৃদ্ধি পাওয়া দামই স্থির হয়ে গেছে। পাশাপাশি করোনাকালীন সময়ে কর্মহারোনা ও বেতন হ্রাসের মতো পরিস্থিতি ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ পড়েছে। জীবন নির্বাহের খরচ নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে, সরকারের হিসেবেই তা উঠে এসে এসেছে। যদিও বাজারের প্রকৃত চিত্রের চেয়ে সরকারের হিসেবে কম প্রতিফলিত হয় বলে আলোচনায় আছে। তারপরও বাজার দর সরকারের প্রাক্কলিত লক্ষ্যের চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

চলতি বছরের মূল্যস্ফীতি লক্ষ্য আছে ৫.৪ শতাংশ। সেপ্টেম্বরে মূল্যস্ফীতি হয়েছে ৫.৬ শতাংশ। বাজারের ভয়াবহ চিত্র সরকারের হিসেবেই ফুটে উঠেছে এবং অব্যাহতভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়ছে। মূলত নিত্যপণ্যের দাম নাগালের বাইরে চলে যাওয়ার কারণে মূল্যস্ফীতি বেড়েছে। শ্রমজীবী মানুষ এ ব্যয় সামাল দিতে খাওয়া কমিয়ে দেওয়া বা অন্য খরচ কমিয়ে দিনাতিপাত করছে।

দেশের ৪৩টি খাতের প্রায় কোটি শ্রমজীবী মানুষ কর্মরত। এর মধ্যে তৈরি পোশাক শিল্পসহ কয়েকটি শিল্প খাতে ন্যূনতম মজুরি নির্দারিত হয়েছে। বাকি ৩২টি শিল্প খাতে ২০১৩ সালের পর নতুন কোনো মজুরি নির্ধারণ হয়নি। যেসব খাতের বেড়েছে তারাও বৃদ্ধি পাওয়া পণ্যমূল্য দিয়ে সামাল দিতে পারছে না। তৈরি পোশাক শিল্পে ২০১৮ সালে নতুন মজুরি নির্ধারিত হয়েছে। এরপর বার্ষিক ইনক্রিমেন্ট বেড়েছে ৫ শতাংশ হারে। কিন্তু জীবন নির্বাহের খরচ বেড়েছে দ্বিগুন হারে। ফলে নতুন বছর মানে নতুন কষ্ট।

এ বিষয়ে কথা হয় গাজীপুরের চন্দ্রাতে অবস্থিত লিবার্টি গার্মেন্টস কারখানার শ্রমিক আ. রউফের সঙ্গে। রউফ খোলা কাগজকে বলেন, নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে অসহায় অবস্থার সৃষ্টি হয়েছে। মাসের শুরুতে বেতন তুলে বাসাভাড়া আর দোকান বাকি পরিশোধ করার পর আর হাতে টাকা থাকে না। সারা মাস চলব কীভাবে, গ্রামের বাড়িতে বাবা-মার কাছেই বা কী পাঠাব, পরিবারের অন্যান্য খরচই বা কীভাবে নির্বাহ করব! শেষে বাধ্য হয়ে কম খেয়ে বা অন্য খরচ কমিয়ে দিয়ে চলতে হচ্ছে। বছরে ৫ শতাংশ হারে বেতন বাড়ে। কিন্তু বাড়ি ভাড়াই বাড়ে তার দ্বিগুন। বছর শেষ হওয়া মানেই জীবন নির্বাহের খরচ বাড়ছে, কষ্ট বাড়ছে।

রউফ বলেন, চাকরি এখন এমন হয়েছে স্বামী-স্ত্রী দুই সন্তানের সংসার চালাতে হলে দুজনকে কাজ করতে হবে। একজন চাকরি করে বা কাজ করলে কোনোভাবেই সংসার চলবে না। এই যে চাকরি করে সংসার চলছে না, এটা কারও কাছে বলে প্রতিকার হয় না, ভাগ্যের উপর ছেড়ে দিয়ে বসে থাকতে হচ্ছে।

মিরপুরের নির্মাণ শ্রমিক ইনামুল হকেরও এমন অবস্থা। তিনি বলেন, জিনিষপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে কষ্ট বেড়েছে, আর পারছি না। আগে যে বেতন পেতাম এখন সেই বেতনই পাচ্ছি। করোনার মধ্যে কাজ কমে গিয়েছিল। প্রাপ্ত বেতন দিয়ে চলছে না। জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে ওই টাকায় আগের জিনিষপত্র কিনতে পারছি না। আবার কঠিন কাজ হওয়ার কারণে পুরো মাস ধরে কাজ করা যায় না। সপ্তাহে একদিন কাজ না করলে সেইদিনই গায়ে বেঁধে যায়, খাওয়ার থাকে না। গ্রামে স্ত্রী, সন্তানের কাছে টাকা পাঠাতে পারি না। জিনিষপত্রের দাম না বাড়লে এই বেতনেই চলত, সমস্যা হচ্ছে জিনিসপত্রের দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে। প্রতিদিনই কোনো না কানো জিনিসপত্রের দাম বাড়ে, অসহ্য।

একই অবস্থা রাজধানীর সেগুনবাগিচার রিকসা চালক আমিরুলের। আমিরুলের হিসাব খুবই নিখুঁত। তিনি বলেন, জিনিসপত্রের দাম বেড়েছে, রোজগার বাড়েনি। রাজধানীতে কোথাও কোথাও খোলা ট্রাকে কম দামে চাল, ডাল, তেল বিক্রি হয়। অনেক বড় লাইন। কম দামের চাল, ডাল, তেল কিনে ৫০ টাকা বাঁচাতে অর্ধেক দিনের ভাড়া মারা বন্ধ হয়ে যায়, আয় কমে যায়। নিত্যপণ্যের দাম বেড়ে আকাশ ছোয়া। প্রাপ্ত মজুরি দিয়ে শ্রমজীবি মানুষের চলছে না। কোথাও জানিয়ে প্রতিকার চাইবে সে অবস্থাও নেই। শ্রমিকদের ওপর জুলুম চলছে।

শ্রমিকরা আর সহ্য করতে পারছে না বলেন মনে করেন বাংলাদেশ ট্রেড ইউনিয়ন কেন্দ্রের (টিইউসি) সভাপতি প্রবীন শ্রমিক নেতা সহিদুল্লাহ চৌধুরী। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, উদ্ভুত পরিস্থিতি শ্রমিকের বহন করার ক্ষমতা নেই। কিন্তু কিছু করারও নেই। আমরা শ্রমিক নেতৃবৃন্দ মজুরি পুনর্নির্ধারণের চেষ্টা করছি কিন্তু আশানুরূপ কিছু করতে পারছি না। আবার মজুরি বৃদ্ধি হলেও যে সমস্যার সমাধান করা যাবে সে অবস্থা নেই। শ্রমিকদের অসহনীয় অবস্থা বাড়ছেই। এই অসহনীয় অবস্থায় সরকার যদি ভর্তুকি মূল্যে দ্রততার সঙ্গে রেশনিং চালু না করে তাহলে পরিস্থিতি ভয়াবহ অবস্থা তৈরি হবে।

সহিদুল্লাহ চৌধুরী বলেন, এই নিয়ন্ত্রণহীন অবস্থায় থেকে উত্তরণে শুধু মজুরি বুদ্ধি করা সমস্যার একমাত্র সমাধান নয়। মজুরি বাড়লে জিনিষপত্রের দাম বাড়বে, আবারও শ্রমজীবী মানুষের কষ্ট বাড়বে। এ অবস্থায় উৎপাদনের প্রাণশক্তি শ্রমিককে যদি রক্ষা করতে হয় তাহলে ভর্তুকিমূল্যে রেশন চালু করতে হবে। সব কিছু লাগামহীন। এ জিনিসপত্রেরদাম বাড়বে, এ বিষয়ে অনেক কথা বলা হবে। কিন্তু কারও কিছু করার ক্ষমতা নেই। কোনো কাজ হবে না।

 
Electronic Paper