মওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। ব্রিটিশ ভারতের অন্যতম তৃণমূল রাজনীতিবিদ মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী জন্মগ্রহণ করেন ১২ ডিসেম্বর ১৮৮০ সিরাজগঞ্জের সয়া-ধানগড়া গ্রামে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী পরিবারে। পিতার নাম হাজি শরাফত আলী খাঁ, মাতার নাম মজিরন বিবি। ১৯৪৭-এ পাকিস্তান ও ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সৃষ্টিতে। গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছেন। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস ‘স্বরাজ্য পার্টি’ গঠন করলে মওলানা ভাসানী সেই দলকে সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মওলানা ভাসানী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তাধারার। মওলানা ভাসানী মজলুম জননেতা হিসেবে পরিচিত ছিলেন।
ঘটনাবহুল তার দীর্ঘ জীবন। তাকে কাছ থেকে দেখেছেন এমন অনেকের স্মৃতিচারণে উঠে এসেছে তার জীবনের অনেক অজানা দিক। সৈয়দ আবুল মকসুদের লেখা বই ‘ভাসানী কাহিনি’ থেকে জানা যায় তার অনেক অজানা কাহিনি। এ বইয়ের প্রতিটি পাতায় ভাসানীর জীবনের খণ্ড খণ্ড চিত্র গল্পের আদলে ফুটে উঠেছে।
শুধু গল্পের আদলে লেখাগুলো লেখেননি, বরং বয়ানদাতার পরিচয় এবং তখনকার পরিচয় তুলে ধরার পাশাপাশি তিনি ভাসানীর সঙ্গে কীভাবে সম্পর্কযুক্ত ছিলেন সেটাও অনুসন্ধান করেছেন। যার ফলে গল্পগুলো শুধু আর গল্প থাকেনি, হয়ে উঠেছে প্রামাণ্য দলিল।
মওলানা ভাসানী একাধারে ছিলেন পীর ও রাজনৈতিক নেতা, যদিও অন্যদের সঙ্গে তার তফাৎ ছিল এই যে তিনি কৃষকদের অধিকার নিয়ে কথা বলতেন। পাশাপাশি উঠে এসেছে মওলানার অনাড়ম্বর জীবনের নানা অজানা কাহিনি। উঠে এসেছে মওলানার অসাম্প্রদায়িক মনোভাবের গল্প। কিন্তু নীতির প্রশ্নে কখনো আপোস করেননি তিনি। মওলানা একদিকে যেমন রাজনীতি সচেতন ছিলেন অন্যদিকে ছিলেন সমাজ সংস্কারক। উনি ঠিকই উপলব্ধি করেছিলেন সমাজের অর্ধেক নারীকে অশিক্ষিত রেখে সমাজের উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই নারী শিক্ষার পাশাপাশি তাদেরকে ঘোড়ায় চড়াসহ বিভিন্ন প্রশিক্ষণের কথাও বলেছেন। এ বইয়ে ঘুরেফিরে এসেছে মওলানার আটপৌরে জীবনবোধের গল্প। যা পড়লে মনেই হয় না যে এসব কোনো রাজনৈতিক নেতার জীবনের গল্প, বরং মনে হয় গ্রামের কোনো সাধারণ কৃষকের গল্প। পাশাপাশি এসেছে মওলানার ভাষা এবং রাজনৈতিক জ্ঞান ও প্রজ্ঞার গল্প। মওলানা বাংলার পাশাপাশি দরকার হলে হিন্দি ও উর্দু ভাষাতেও বক্তব্য দিতেন, এমনকি তাকে দেখা যায় বিদেশি প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইংরেজিতেও আলাপ করতে। সবকিছু ছাপিয়ে এসেছে মওলানার আন্তরিকতার গল্পগুলো। মানুষকে আপ্যায়ন না করে ছাড়তেন না কখনো, দরকার হলে নিজ হাতে রান্না করে খাওয়াতেন।
শক্তিমান লেখক আহমদ ছফা ‘মওলানা ভাসানী’ বলেছেন, ‘বাঙলার কৃষক সমাজের সত্যিকার নেতা ছিলেন মরহুম মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী। মওলানা সাহেব কৃষক সমাজের একেবারে ভেতরে গাছের মতো বেড়ে উঠেছিলেন। গাছের বেড়ে ওঠার জন্য যেটুকু আলো, জল, হাওয়ার প্রয়োজন কৃষক সমাজের দাবিগুলোকে অনেকটা সেই চোখেই দেখতেন তিনি। পারিপার্শ্বিক পরিস্থিতি তাকে রাজনীতির দিকে ধাবিত করেছে। তার ছিল এক অনন্য সংবেদনশীল সহজাত প্রবৃত্তি। মওলানার প্রথম জীবনের রাজনীতি থেকে শুরু করে জীবনের একেবারে শেষ পর্যায়ের বিভিন্ন ঘটনা এ বইয়ে স্থান পেয়েছে। যেমন মওলানার প্রথম জীবনের রাজনীতি সম্পর্কে বলা হয়েছে, ‘...বঙ্গভঙ্গ আন্দোলনের শেষ দিকে তিনি সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোর সঙ্গে যুক্ত হন। মওলানা ভাসানী তার রাজনৈতিক জীবনে সবসময়ই সাধারণ জনমানুষের অধিকারের জন্য লড়েছেন।
আর শোষকবিরোধী বিভিন্ন বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের পাশাপাশি ওয়াজ মাহফিলেও শোষকবিরোধী বক্তব্য দিতেন। তাই উনার ওয়াজ মাহফিলে সব ধর্মের এবং সব বর্ণের শ্রোতাদের সমাবেশ ঘটত। মওলানা বাস্তবজীবনে ইসলামের নিয়মকানুন পালন করলেও মনেপ্রাণে ছিলেন পুরোপুরি অসাম্প্রদায়িক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠাতাদের একজন হয়েও মওলানা কিন্তু জিন্নাহর দ্বিজাতি তত্ত্বের সমর্থক ছিলেন না। পশ্চিম পাকিস্তানের লোকেরা বাংলা ভাষার সঙ্গে নামাজ তথা ধর্মের সাংঘর্ষিক একটা ব্যাখ্যা পাকিস্তান সৃষ্টির পর থেকেই দেওয়ার চেষ্টা করে আসছিল। একবার পশ্চিম পাকিস্তানের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে মওলানার কথা হলে তিনি বলেন, ‘ধর্মের সঙ্গে ভাষার কোনো সম্পর্ক নাই। ধর্ম এক জিনিস আর ভাষা আর একটি জিনিস। একটির সঙ্গে অন্যটিকে যারা মেশায় তারা অসৎ ও মতলববাজ।
মওলানা সাম্প্রদায়িকতাবাদীদের বিরুদ্ধে বলেছেন, ‘যেসব মুসলমান হিন্দুদের বিধর্মী মনে করে, তাদের ক্ষতি করতে চায়, আমি তাদের বলি তোমরা কারা? খুব বেশি হইলে চার-পাঁচ পুরুষ আগে তোমরা কারা ছিল? তোমাদের বাপ-দাদার বাপ-দাদারা ছিলেন হয় হিন্দু নয় নমঃশূদ্র। এ দেশের হিন্দু আর মুসলমানের একই রক্ত।
তবে নিজে বৈষয়িক না হয়েও অনেককে বৈষয়িক উপদেশ দিতেন। মওলানা সম্পর্কে পশ্চিমবঙ্গের লেখক তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় লিখেন, ‘আসলে তিনি সোজা-সরল ধরনের মানুষ। মনে যা ভাবেন মুখে তাই বলেন। খোলামেলা মানুষ। তাতে ভুল বোঝাবুঝির সৃষ্টি হয়।
‘ভাসানী কাহিনি’ বইয়ের মুখবন্ধে লেখক সৈয়দ আবুল মকসুদ লিখেন, ‘জাতীয় জীবনের রাজনীতির অঙ্গনে মওলানা ভাসানী আজ অবহেলিত। দুর্বৃত্তায়িত রাজনীতির পৃষ্ঠপোষকদের কাছে তার প্রয়োজন ফুরিয়ে গেছে। ১৯২৩ সালে চিত্তরঞ্জন দাস ‘স্বরাজ্য পার্টি’ গঠন করলে মওলানা ভাসানী সেই দলকে সংগঠিত করতে ব্যাপক ভূমিকা পালন করেন। রাজনৈতিক সংগঠক হিসেবে মওলানা ভাসানী ছিলেন অত্যন্ত দূরদর্শী এবং বিচক্ষণ চিন্তাধারার।
১৯৩০ সালে আসামের ধুবড়ী জেলার ব্রহ্মপুত্র নদের ভাসান চরে তিনি প্রথম কৃষক সম্মেলন আয়োজন করেন। এই সম্মেলনের পর তিনি সর্বমহলে ভাসানীর মওলানা নামে পরিচিতি লাভ করেন। মূলত এরপর থেকেই তার নামের শেষে ‘ভাসানী’ উপাধি যুক্ত হয়। ভাসান চরের সফল সম্মেলনের পর কৃষক-মজদুর মহলে মওলানা ভাসানী হয়ে উঠেন এক অবিসংবাদিত নেতা। প্রগাঢ় স্বদেশপ্রেম, প্রগতিশীল আদর্শ ও প্রতিবাদী চেতনার আলোকবর্তিকা মজলুম জননেতা মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী ১৯৭৬ সালের ১৭ নভেম্বর ৯৬ বছর বয়সে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে মৃত্যুবরণ করেন।
লেখক : কবি ও প্রাবন্ধিক
কেকে/এমএ