বর্তমানে বাংলাদেশ এমন এক সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে যখন নিরাপত্তা ব্যবস্থা কঠোর করা সত্ত্বেও সারা দেশে সহিংসতার আশঙ্কাজনক বিস্তার দেখা যাচ্ছে। রাজধানী ঢাকা থেকে শুরু করে চট্টগ্রাম, রাজশাহী, খুলনা, রংপুর ও সিলেট পর্যন্ত কোথাও শান্তির নিশ্চয়তা নেই। প্রতিদিন সংবাদপত্রের পাতায় অগ্নিসংযোগ, বোমা বিস্ফোরণ, রাস্তায় গুলিবর্ষণ কিংবা ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানে হামলার খবর যেন এক বিভীষিকাময় বাস্তবতা হয়ে দাঁড়িয়েছে। এমন পরিস্থিতি জনমনে এক গভীর আতঙ্ক সৃষ্টি করছে, যেন দেশটি অদৃশ্য এক শক্তির দ্বারা অবরুদ্ধ হয়ে পড়েছে।
বাংলাদেশ পুলিশের ২০২৫ সালের জুন পর্যন্ত প্রকাশিত পরিসংখ্যান অনুযায়ী, চলতি বছরে দেশে রাজনৈতিক সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় প্রায় ৮১২টি মামলা দায়ের হয়েছে। শুধুমাত্র ঢাকাতেই গত ছয় মাসে ৯৭টি বোমা বিস্ফোরণ ও ৪৩টি বাসে অগ্নিসংযোগের ঘটনা রেকর্ড করা হয়েছে। এতে ১২৬ জন নিহত ও প্রায় ৭০০ জন আহত হয়েছেন। এসব পরিসংখ্যান শুধু কাগজে-কলমে সংখ্যা নয়, এর পেছনে রয়েছে শত শত পরিবারের আর্তনাদ, হারানো প্রিয়জনের শোক এবং নিরাপত্তাহীনতার গাঢ় ছায়া।
ঢাকা শহর বর্তমানে এক কঠোর নিরাপত্তা বলয়ে ঘেরা। প্রতিটি প্রবেশপথে চেকপোস্ট, সিসিটিভি মনিটরিং, গোয়েন্দা নজরদারি বাড়ানো হলেও হামলা ঠেকানো যাচ্ছে না। জনাকীর্ণ এলাকায় কিংবা যানজটে আটকে থাকা গাড়ির ভেতর বোমা নিক্ষেপের ঘটনাগুলো প্রমাণ করছে দুর্বৃত্তরা রাজধানীর নিরাপত্তা ব্যবস্থার দুর্বল জায়গাগুলো তাদের গভীর পর্যবেক্ষণে রয়েছে। সম্প্রতি মতিঝিল, ফার্মগেট ও শাহবাগ এলাকায় ঘটে যাওয়া হামলা শহরের সাধারণ নাগরিকদের আতঙ্কে ফেলে দিয়েছে।
বাংলাদেশ দীর্ঘদিন ধরে ধর্মীয় সম্প্রীতির এক অনন্য উদাহরণ হিসেবে পরিচিত। কিন্তু সাম্প্রতিক হামলার ধরন এ ঐতিহ্যকে নষ্ট করার এক গভীর ষড়যন্ত্রের ইঙ্গিত দেয়। ঢাকায় সেন্ট জোসেফ ও সেন্ট মেরি ক্যাথেড্রালের মতো গির্জায় হামলা, বরিশালে একটি মন্দিরে অগ্নিসংযোগ এবং কুমিল্লায় একটি আহমদিয়া উপাসনালয়ে ককটেল বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। এসব ঘটনা শুধু ধর্মীয় ঘৃণার প্রকাশ নয়, বরং জাতিগত ঐক্য ও স্থিতিশীলতা ভাঙার এক পরিকল্পিত অপচেষ্টা।
সহিংসতা এখন শুধু রাজধানিতেই সিমাবদ্ধ নেই। চট্টগ্রামের অক্সিজেন মোড় থেকে শুরু করে বগুড়ার সাতমাথা, সিলেটের আম্বরখানা, খুলনার রূপসা এবং বরিশালের নগরকেন্দ্র পর্যন্ত সংঘর্ষের আগুন ছড়িয়ে পড়েছে। অনেক জেলায় প্রশাসনিক ভবন ও সরকারি যানবাহন লক্ষ্য করে হামলা চালানো হচ্ছে। বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বিআইডিএস-এর ২০২৫ সালের এপ্রিলের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে ২০২৪ সালের তুলনায় এ বছর রাজনৈতিক সহিংসতা ৩২ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে।
রাজনৈতিক দৃশ্যপটে যখন নির্বাচনের বৈধতা, সময় ও অংশগ্রহণ নিয়ে বিভক্তি তৈরি হয়, তখনই চরমপন্থি গোষ্ঠী ও অপরাধী নেটওয়ার্ক নিজেদের সুযোগ খুঁজে নেয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কিছু দুর্বলতা, নীতি নির্ধারণে অনিশ্চয়তা এবং প্রশাসনিক মনোযোগের ঘাটতি এই গোষ্ঠীগুলোর কার্যক্রমকে আরো সহজ করে দেয়। যখন গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা কমে তখন সমাজে সহিংসতা জন্ম নেয়।
বর্তমান সহিংসতার পেছনে রাজনৈতিক স্বার্থের পাশাপাশি রয়েছে অর্থনৈতিক স্বার্থের সংঘাতও। স্থানীয় পর্যায়ে চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল ও অবৈধ বাণিজ্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে গোষ্ঠীগত সংঘর্ষ ক্রমেই বাড়ছে। ২০২৫ সালের মে মাসে ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) এক জরিপে উঠে এসেছে, রাজনৈতিক আশ্রয়ে থাকা অপরাধচক্রগুলো বছরে প্রায় ৮০০ কোটি টাকারও বেশি অবৈধ অর্থ লেনদেন করে, যার একটি বড় অংশ ব্যবহার হয় সন্ত্রাস ও বিশৃঙ্খলা সৃষ্টিতে।
সহিংসতার সবচেয়ে ভয়াবহ দিক হলো -এর সামাজিক প্রভাব। মানুষ এখন অপরিচিত ব্যক্তিকে সন্দেহের চোখে দেখে, রাতে বের হতে ভয় পায়, এমনকি ধর্মীয় অনুষ্ঠানেও অংশগ্রহণে অনেকে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ছে। এর ফলে সমাজে পারস্পরিক আস্থা ও মানবিক বন্ধন ক্ষয়ে যাচ্ছে। সমাজবিজ্ঞানীদের মতে, দীর্ঘস্থায়ী ভয়ের সংস্কৃতি একটি জাতির মানসিক স্বাস্থ্য, কর্মস্পৃহা ও উৎপাদনশীলতা ধ্বংস করে দেয়।
যুব সমাজের একটি বড় অংশ হতাশ ও দ্বিধাগ্রস্ত। বেকারত্ব, দারিদ্র্য, সামাজিক বৈষম্য ও রাজনৈতিকভাবে ব্যবহার হয়ে তারা বিষাদ ও বিষণ্নতায় ভুগতে দেখা যাচ্ছে তাদের। এই হতাশা থেকে কিছু তরুণ গ্যাং কালচারে যুক্ত হওয়াসহ নানান অপরাধ কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে ফেলছে নিজে দেরকে। ২০২৫ সালের জুনে সিটিটিসির এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে গত দুই বছরে গ্রেফতার হওয়া নতুন চরমপন্থিদের ৬৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩০ বছরের মধ্যে। এটি ভয়াবহ উদ্বেগের যা আমাদের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তার জন্য বিপজ্জনক।
সহিংসতা ও সন্ত্রাসবাদের মামলাগুলোর বিচার প্রক্রিয়ার দীর্ঘসূত্রিতা এবং মামলার জট অপরাধ দমনে একটি বড় বাধা। অপরাধ প্রমাণিত হতে বছরের পর বছর লেগে গেলে অপরাধীদের মনে আইনের প্রতি ভয় কমে যায়। ২০২৫ সালের হিসাব অনুযায়ী, সন্ত্রাসবিরোধী ট্রাইব্যুনালগুলোতে কয়েক হাজার মামলা বিচারাধীন রয়েছে। দ্রুত বিচার নিশ্চিত করতে হলে বিশেষ ট্রাইব্যুনালগুলোর সংখ্যা বৃদ্ধি, বিচারক ও প্রসিকিউটরদের বিশেষ প্রশিক্ষণ প্রদান এবং ফরেনসিক রিপোর্টিং প্রক্রিয়াকে দ্রুত করা অপরিহার্য।
অর্থনৈতিক বৈষম্য এবং সমাজে সুযোগের অভাব সহিংসতা ও অস্থিরতা সৃষ্টির মূল কারণ। ধনী-দরিদ্রের ক্রমবর্ধমান ব্যবধান, ন্যায্য মজুরির অভাব এবং সম্পদ বণ্টনে অসমতা যুব সমাজকে বিক্ষুব্ধ করে তুলছে। এই ক্ষোভকে উগ্রবাদী গোষ্ঠীগুলো সহজে তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডায় ব্যবহার করছে। এই সমস্যা মোকাবিলায় সরকারের উচিত হবে বৈষম্য হ্রাস, কর্মসংস্থানের সমসুযোগ সৃষ্টি করা এবং সুবিধাবঞ্চিত এলাকাগুলোতে সুষম উন্নয়ন নিশ্চিত করা।
সরকারি সংস্থাগুলো একের পর এক অভিযান চালালেও স্থায়ী সমাধান দেখা যাচ্ছে না। পুলিশ, র্যাব ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলো শত শত সন্দেহভাজনকে আটক করেছে, তবুও নতুন নতুন গোষ্ঠী আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকদের মতে, শুধুমাত্র শক্তি প্রয়োগে নয়, বরং গোড়ার সামাজিক কারণ চিহ্নিত করে তার সমাধান না করলে সহিংসতার মূলোৎপাটন সম্ভব নয়।
সহিংসতা মোকাবিলার নামে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগগুলো আন্তর্জাতিক পর্যবেক্ষণে রয়েছে। নিরাপত্তা বিশ্লেষকরা বলছেন, শুধুমাত্র আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের প্রতি শ্রদ্ধাশীল হয়েই সহিংসতা দমন করা সম্ভব। কপ-৩০ বা অন্যান্য বৈশ্বিক মঞ্চে এ বিষয়গুলো দেশের ভাবমূর্তির ওপর প্রভাব ফেলছে। বাহিনীর অভ্যন্তরীণ জবাবদিহিতা ও নিরীক্ষা প্রক্রিয়া জোরদার করলে এই সংকট থেকে উত্তরণ সম্ভব।
সহিংসতার পাশাপাশি দেশে ছড়িয়ে পড়েছে তথ্যযুদ্ধ। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে গুজব, ভুয়া ভিডিও, ঘৃণামূলক পোস্ট মুহূর্তেই মানুষের মনে বিভ্রান্তি সৃষ্টি করছে। একটি ছোট ঘটনা বড় রূপ নিচ্ছে, যা বাস্তব পরিস্থিতিকে আরো অস্থিতিশীল করে তুলছে। ২০২৫ সালের প্রথম প্রান্তিকে তথ্য মন্ত্রণালয়ের প্রতিবেদনে বলা হয়, গত এক বছরে অনলাইনে প্রচারিত ভুয়া সংবাদ ও বিভ্রান্তিকর পোস্টের সংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪১ শতাংশ।
আধুনিক সহিংসতা ও উগ্রবাদ প্রচারের প্রধান মাধ্যম হলো সাইবার স্পেস। চরমপন্থি গোষ্ঠীগুলো এনক্রিপ্টেড মেসেজিং অ্যাপস ও সামাজিক মাধ্যম ব্যবহার করে সদস্য সংগ্রহ, পরিকল্পনা তৈরি ও ঘৃণামূলক কনটেন্ট ছড়ায়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে সাইবার ফরেনসিক সরঞ্জাম ও প্রশিক্ষিত জনবলের অভাব থাকায় এই ভার্চুয়াল জগৎ নিয়ন্ত্রণ করা কঠিন হচ্ছে। সরকারের উচিত হবে ডিজিটাল নজরদারির সক্ষমতা বাড়ানো, কিন্তু একই সঙ্গে নাগরিকের ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার সুরক্ষিত রাখা। সাইবার স্পেসকে নিরাপদ না করতে পারলে সহিংসতা নির্মূল করা যাবে না।
শিক্ষাব্যবস্থায় নৈতিকতা, সহনশীলতা এবং বহু-সাংস্কৃতিক মূল্যবোধের চর্চার অভাবও সহিংসতা বাড়াতে সাহায্য করছে। ধর্মীয় বা রাজনৈতিক ভিন্নমতের প্রতি অসহনশীলতা যুব সমাজের মধ্যে বিভাজন সৃষ্টি করছে। শিক্ষাব্যবস্থাকে এমনভাবে পুনর্গঠন করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, সমালোচনামূলক চিন্তা এবং পারস্পরিক শ্রদ্ধাবোধ ও সহনশীলতা নিয়ে বেড়ে উঠতে পারে। স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে শান্তি ও সহনশীলতার সংস্কৃতি তৈরি করাই পারে চরমপন্থাকে প্রতিহত করতে।
দেশে যখন রাজনৈতিক সহিংসতা ও নিরাপত্তাহীনতা বেড়ে যায়, তখন তার প্রভাব আন্তর্জাতিক অঙ্গনেও পড়ে। বিদেশি বিনিয়োগকারীরা দ্বিধাগ্রস্ত হন, পর্যটন খাতে নেতিবাচক প্রভাব পড়ে, এবং আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংগঠনগুলো উদ্বেগ প্রকাশ করে। ২০২৫ সালের বিশ্বব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, সহিংসতার কারণে দেশে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগের প্রবাহ গত বছরের তুলনায় ১৮ শতাংশ কমেছে। এটি বাংলাদেশের অর্থনীতির জন্য এক বিপজ্জনক ইশারা।
সহিংসতার ঘটনায় ভুক্তভোগী এবং প্রত্যক্ষদর্শীর সুরক্ষা নিশ্চিত করা না গেলে অপরাধীরা বারবার পার পেয়ে যায়। বাংলাদেশে সাক্ষী বা ভুক্তভোগী প্রায়শই অপরাধী বা তাদের প্রভাবশালীদের পক্ষ থেকে হুমকির সম্মুখীন হন, ফলে তারা আদালতে সাক্ষ্য দিতে সাহস পান না। এর ফলস্বরূপ, মামলার নিষ্পত্তির হার কমে আসে এবং অপরাধীরা উৎসাহিত হয়। সরকারকে অবশ্যই সাক্ষী সুরক্ষা আইন প্রণয়ন ও তা কার্যকর করতে হবে এবং ভুক্তভোগীদের জন্য যথাযথ পুনর্বাসন ও মানসিক সহায়তার ব্যবস্থা করতে হবে।
বর্তমান পরিস্থিতি মোকাবিলায় প্রয়োজন রাজনৈতিক দলগুলোর পারস্পরিক আস্থা, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা এবং আইনের শাসন নিশ্চিত করা। শুধু নিরাপত্তা বাহিনীর কঠোরতা নয়, সমাজের প্রতিটি স্তরে শান্তি ও সহনশীলতার সংস্কৃতি গড়ে তোলাই একমাত্র উপায়। শিক্ষা, গণমাধ্যম ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানগুলোকে সহিংসতাবিরোধী সচেতনতায় ভূমিকা রাখতে হবে। একই সঙ্গে স্থানীয় পর্যায়ে তরুণদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থান ও প্রশিক্ষণ কর্মসূচি বাড়াতে হবে, যাতে তারা বিভ্রান্তির পথে না যায়।
বাংলাদেশের মানুষ সহিংসতা নয়, শান্তি চায়। তারা চায় নিরাপদ রাস্তা, নিশ্চিত বিচার, এবং এমন এক সমাজ যেখানে ভিন্নমত থাকলেও সহনশীলতা বজায় থাকে। ইতিহাস সাক্ষী যে, এই জাতি বারবার সংকট থেকে উঠে দাঁড়িয়েছে, স্বাধীনতা অর্জন করেছে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ জয়ে সক্ষমতা দেখিয়েছে। তাই এখন সময় এসেছে সহিংসতার রাজনীতি পরিহার করে ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি ও উন্নয়নের পথে এগিয়ে যাওয়ার। জাতির এ সংকটময় মুহূর্তে একমাত্র গণতন্ত্র, মানবতা ও ন্যায়বোধই পারে বাংলাদেশকে আবারো আলোর পথে ফিরিয়ে নিতে।
লেখক : তরুন কলাম লেখক
কেকে/এআর