ডেঙ্গু প্রতিরোধ ও পরিচ্ছন্ন নগর গড়ার অঙ্গীকার নিয়ে এক বছর আগে চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেন বিএনপি নেতা ডা. শাহাদাত হোসেন। তবে মেয়রের প্রথম বছরটিকে নিয়ে নগরে চলছে মিশ্র মূল্যায়ন।
শহরের বিভিন্ন শ্রেণি–পেশার মানুষ এবং নগর পরিকল্পনাবিদরা বলছেন, জলাবদ্ধতা কমাতে তার উদ্যোগ চোখে পড়ার মতো হলেও ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণ, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা ও প্রশাসনিক স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে প্রত্যাশিত ফল আসেনি।
সিভিল সার্জন কার্যালয়ের তথ্য বলছে, গত এক বছরে চট্টগ্রামে ডেঙ্গুতে মারা গেছেন ৪০ জন। আক্রান্ত হয়েছেন ৫ হাজার ২৩ জন। নগরবাসীর অভিযোগ, ডেঙ্গু নিয়ন্ত্রণে মাঠপর্যায়ে সমন্বিত উদ্যোগের অভাব ছিল।
এর পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের বর্জ্য সংগ্রহ ও সৌন্দর্যবর্ধনের কাজ দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে হস্তান্তর করা নিয়ে প্রশ্ন উঠেছে। শুধু বাসা-বাড়ি থেকে বর্জ্য সংগ্রহে বছরে নগরবাসীর ৫০০ কোটি টাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের পকেটে যাবে।
২০২১ সালের ২৭ জানুয়ারি নির্বাচনে মেয়র নির্বাচিত হয়েছিলেন নগর আওয়ামী লীগের যুগ্ম সম্পাদক রেজাউল করিম চৌধুরী। তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন বিএনপির ডা. শাহাদাত হোসেন। ভোটে কারচুপির অভিযোগ তুলে ফল বাতিল চেয়ে ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি নির্বাচনী ট্রাইব্যুনালে মামলা করেন তিনি। গতবছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর সেই মামলার রায়ে ওইবছরের ১ অক্টোবর শাহাদাতকে মেয়র ঘোষণা করেন নির্বাচনী ট্রাইব্যুনাল। একই বছরের ৩ নভেম্বর মেয়র হিসেবে শপথ নেন তিনি। দুইদিন পর ৫ নভেম্বর মেয়র হিসেবে সিটি করপোরেশনের দায়িত্ব নেন। দায়িত্ব নেওয়ার একবছর পর মেয়র হিসেবে ডা. শাহাদাতের সাফল্য-ব্যর্থতার হিসেব কষছেন নগরবাসী।
প্রশাসনে দন্দ্ব ও বিতর্কিত সিদ্ধান্ত
মেয়র শাহাদাত দায়িত্ব নেওয়ার পর সিটি করপোরেশনের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা ও স্থানীয় সরকার উপদেষ্টার সঙ্গে দ্বন্দ্ব তৈরি হয়। ঠিকাদারের কাছ থেকে ঘুষ নিয়ে বরখাস্ত প্রকৌশলীকে স্বপদে বহাল করা এবং পরীক্ষায় ফেল করা এক প্রকৌশলী ও দুদকে অভিযুক্ত কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেওয়ার ঘটনাও সমালোচিত হয়েছে। এসব ঘটনায় করপোরেশনের অভ্যন্তরীণ শৃঙ্খলা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বলে অভিযোগ রয়েছে কর্মকর্তাদের।
এ ছাড়া দলীয় নেতাকর্মীদের তদবিরে অফিস পরিচালনা ব্যাহত হওয়ায় ক্ষোভ রয়েছে কর্মকর্তা-কর্মচারী পর্যায়েও। প্রতিশ্রুতি ছিল অফিস সময় দলের নেতাদের সাক্ষাৎ দেওয়া হবে না—কিন্তু বাস্তবে তার উল্টো চিত্রই দেখা যাচ্ছে।
বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক চুক্তি নিয়ে প্রশ্ন
উন্মুক্ত পরিসর রক্ষার দাবি থাকলেও বিপ্লব উদ্যানে বাণিজ্যিক ব্যবহারের অনুমতি দিয়ে আগের মেয়রদের নীতিই অনুসরণ করেছেন বর্তমান মেয়র—এ অভিযোগ পরিবেশবিদদের। তাদের মতে, নগরের উন্মুক্ত স্থান সংকটের মধ্যে এই সিদ্ধান্ত জনস্বার্থের বিরুদ্ধে গেছে।
জলাবদ্ধতা কমায় স্বস্তি
তবে নগরবাসীর বড় অংশ স্বীকার করছেন, এ বছর আগের তুলনায় জলাবদ্ধতার ভোগান্তি অনেক কম ছিল। চসিকের হিসাব অনুযায়ী, প্রকল্পের বাইরে ১১ কোটি টাকা ব্যয়ে ১৯টি খাল থেকে আবর্জনা সরানো হয়েছে। এ উদ্যোগেই জলাবদ্ধতার চাপ কমেছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
এ ছাড়া দীর্ঘদিন দখলে থাকা প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়ন্ত্রণ ফিরে পাওয়া, সিটি করপোরেশনের ৬১৭ জন অস্থায়ী কর্মীকে স্থায়ী করা, শিক্ষার্থীদের জন্য স্বাস্থ্য কার্ড চালু, ওয়ার্ড পর্যায়ে মাঠ সংস্কার—এসব উদ্যোগে মেয়র প্রশংসিত হয়েছেন।
মেয়র ও বিশ্লেষকদের মতামত
মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন বলেন, ‘জলাবদ্ধতা নিয়ন্ত্রণে আমরা দৃশ্যমান অগ্রগতি আনতে পেরেছি। বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় নতুন উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। মনোরেলসহ বড় প্রকল্প বাস্তবায়নের দিকে অগ্রসর হয়েছি।’
অন্যদিকে পরিকল্পিত চট্টগ্রাম ফোরামের সভাপতি অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান বলেন, ‘প্রথম দিকে মেয়রের মধ্যে দৃঢ়তা দেখা গেলেও এখন দলীয় চাপের কাছে তিনি নমনীয় হয়ে পড়েছেন। জনস্বার্থকে অগ্রাধিকার দিতে হলে এই অবস্থান বদলাতে হবে।’
কেকে/এজে