নৌকাবাইচ বাংলার লোকসংস্কৃতির একটি অংশ। এই জনপদে নৌকাবাইচ আনন্দ উৎসবে পরিণত হয়। এটি একই সঙ্গে উৎসব ও জনপ্রিয় একটি খেলা। তবে ঠিক কবে এদেশে নৌকাবাইচের প্রচলন হয়েছিল, তার সঠিক ইতিহাস এখনো জানা যায়নি।
সময়ের বিবর্তনে আর কালের পথপরিক্রমায় নদীমাতৃক বাংলার নৌকাবাইচের সংস্কৃতি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হলেও সাম্প্রতিক কয়েক বছর ধরে, হাজার বছরের গ্রাম-বাংলার প্রাচীন ঐতিহ্য বাঁচিয়ে রাখার লক্ষ্যে আবার তা জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। নদনদী, বিল-হাওরের এই দেশের লোক-ঐতিহ্য প্রাচীন এবং সমৃদ্ধ। গ্রাম-বাংলার ঐতিহ্যের অন্যতম অনুষঙ্গ নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতায় গতি ও কর্মোদ্যমের জন্য যে গান গীত হয়, তা লোকসাহিত্যের এক অমূল্য সম্পদ। নৌকাবাইচের গানকে সারিগান বা হাইড় বলা হয়।
নৌকাবাইচের জন্য নির্মিত হয় বিশেষ ধরনের নৌকা। অঞ্চলভেদে এগুলোর আকৃতি ও নাম বিভিন্ন। বাইচের নৌকার গঠন বৈশিষ্ট্যপূর্ণ। নৌকার সামনের গলুই খুব সুন্দর করে সাজানো থাকে। তাতে কখনো থাকে ময়ূরের মুখ, কখনো রাজহাঁস কিংবা অন্য কোনো পাখির মুখ। নৌকাটিতে উজ্জ্বল রঙের কারুকাজ করে বিভিন্ন নকশা তৈরি করা হয় দর্শকের সামনে যথাসম্ভব আকর্ষণীয় করার জন্য। নৌকা তৈরিতে শাল, কড়ই, গর্জন ইত্যাদি কাঠ ব্যবহার করা হয়। নদীতে নৌকাবাইচের আয়োজন করা হলে তীরে জমে যায় অসংখ্য লোক। আর হাওর-বাঁওড়ে নৌকাবাইচ উৎসবে হাজার হাজার মানুষ ডিঙি নৌকা নিয়ে জড়ো হয়। বিশাল হাওরে শুধু নৌকা আর নৌকা এবং দর্শনার্থীদের ভিড়।
করতালিমুখরিত ফুটবল খেলার মাঠের মতো নদী-হাওরের বুক জয়ধ্বনিতে ফেটে পড়ে। প্রতিযোগিতা শুরুর আগের দৃশ্যটি অত্যন্ত উপভোগ্য। শক্তি ও নৈপুণ্য প্রদর্শনীর মহড়া এবং নৌকাগুলোর ফেরির দৃশ্য হয় চমৎকার। গান চলছে, বাদ্যযন্ত্র বাজছে, সুঠামদেহী মাল্লারা ধুয়া ধরছে, গানের তালে তালে বৈঠা ঘুরিয়ে পেছন ভাগ ঠুকছে গোড়ায়, পানি উড়ছে ফেনার মতো, চারদিকে চলছে হাততালি। একসময় শুরু হয় প্রতিযোগিতা। সীমা বেঁধে দেওয়া হয়। যে নৌকা সীমা পেরিয়ে আগে যাবে, জয় হবে তার। চরম উত্তেজনা ছড়িয়ে পড়ে দর্শকের মাঝে। শুধু ঝপঝপ বৈঠার শব্দ আর মারো টান হেইও, আরও জোরে হেইও! সেই সঙ্গে বাদ্যযন্ত্রের ধ্বনি। সব মিলিয়ে চরম উত্তেজনাপূর্ণ এবং উপভোগ্য দৃশ্য।
বাহারি নৌকায় তালে তালমিলিয়ে চলছে মাঝি-মাল্লাদের বৈঠা। ঢোল, বাদ্যযন্ত্র বাজিয়ে জারি-সারি গান গাইছে তারা। নৌকায় করে ও নদীর তীরে দাঁড়িয়ে নানা বয়সের হাজারো উৎসুক দর্শনার্থী নৌকাবাইচ দেখতে এসেছেন। নৌকাবাইচে অংশ নেওয়া প্রতিযোগীদের হৈ-হুল্লোর, হর্ষধ্বনি, করতালী দিয়ে উৎসাহ দেন দর্শনার্থীরা।
এদিকে, আবহমান বাংলার ঐতিহ্যবাহী এই নৌকাবাইচ প্রতিযোগিতা বরিশালের উজিরপুর উপজেলার শিকারপুর-ইচলাদি গ্রামে সন্ধ্যা নদীতে অনুষ্ঠিত হয়েছে।
বৃহস্পতিবার (৩০ অক্টোবর) বিকেলে প্রধান অতিথির উদ্বোধনের মধ্য দিয়ে এই নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা শুরু হয়।
ঢেউয়ের কলতান ও বৈঠার ছলাত ছলাত শব্দে উত্তাল হয়ে উঠেছিল উজিরপুরের সন্ধ্যার দুই পাড়। নদীর দুই পাড়ে হাজারো দর্শকদের করতালিতে পরিবেশ হয়ে উঠেছিল উৎসবমুখর। কার্তিকের বিকেলে গ্রাম বাংলার ঐতিহ্যবাহী নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতা উপভোগ করেন বরিশালের উজিরপুর উপজেলা সহ আশেপাশের এলাকা থেকে আসা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষ।
উজিরপুর উপজেলা প্রশাসনের ১ দিনব্যাপী এই আয়োজনকে ঘিরে আশপাশের গ্রামগুলোতেও উৎসবের আমেজ ছড়িয়ে পড়ে। ঐতিহ্যের এই নৌকাবাইচে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরিশালের জেলা প্রশাসক ও জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন বরিশালের পুলিশ সুপার মো. শরিফ উদ্দীন ও বাংলাদেশ জাতীয় জাদুঘরের জনশিক্ষা বিভাগের পরিচালক আসমা ফেরদৌসি। উজিরপুর উপজেলা প্রশাসন ও উন্নয়ন সংস্থা আভাস-এর আয়োজনে নৌকা বাইচ প্রতিযোহিতায় সভাপতিত্ব করেন উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আলী সুজা।
শিকারপুর কলেজের সামনের সন্ধ্যা নদী থেকে শুরু হয়ে বাইচ সমাপ্ত হয় সেক্টর কমান্ডার এম. এ. জলিল সেতুতে এসে। মোট ৬টি বাচারি নৌকা প্রতিযোগিতায় অংশ নেয়।
জানা যায়, বরিশালের ৫ জন বিখ্যাত ব্যাক্তি ও জুলাই শহীদদের নামে প্রতিটি নৌকার নামকরন করা হয়। নামগুলো হলো - শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক, কবি জীবনানন্দ দাশ, সেক্টর কমান্ডার বীর মুক্তিযোদ্ধা মেজর এম. এ জলিল, বীরশ্রেষ্ঠ ক্যাপ্টেন মহিউদ্দিন জাহাঙ্গীর, কবি সুফিয়া কামাল এবং জুলাই শহীদ। গোপালগঞ্জ ও মাদারীপুর জেলার কালিপদ তালুকদার, লাজারেজ ফলিয়া, কিরণ মৃধা, সঞ্জয় রায়, শংকর বাড়ৈ ও সৈকত রায় তাদের দল ও নৌকা নিয়ে প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করেছেন।
চ্যাম্পিয়ন ৩০ হাজার টাকা, ১ম রানারআপ ২০ হাজার টাকা ও ২য় রানার্সআপের জন্য ছিলো ১০ হাজার টাকার পুরস্কার। এছাড়াও নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণকারী সকলের জন্য ছিলো আকর্ষণীয় সান্ত্বনা পুরষ্কার।
নৌকাবাইচে চ্যাম্পিয়ন হয়েছেন শের-ই-বাংলা এ কে ফজলুল হক দল, ১ম রানারআপ হয়েছেন মেজর এম এ জলিল দল এবং ২য় রানারআপ হয়েছেন জুলাই শহীদ দল। প্রতিটি নৌকায় ৪০-৪৫ জন করে মাল্লা ছিলেন।
নৌকা বাইচ প্রতিযোগিতার সভাপতি উজিরপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার মো. আলী সুজা খোলা কাগজকে বলেন, বাংলার গ্রামীণ ঐতিহ্যের ধারক বলা যায় নৌকা বাইচকে। এটা দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে, আমরা উজিরপুরে এটাকে পুনরায় উজ্জীবিত করার চেষ্টা করছি এবং নৌকা বাইচ শুধু একটি প্রতিযোগিতা নয়, সবাই এটাকে উৎসবের আমেজ নিয়ে উদযাপন করে। যখন নৌকা বাইচ অনুষ্ঠিত হয় তখন নদী পাড়ের মানুষ ছাড়া-ও বিভিন্ন দূরদূরান্ত থেকে এই উৎসবটিকে উপভোগ করার জন্য সবাই এগিয়ে আসে।
তিনি আরও বলেন, উজিরপুরবাসীসহ যারা বিভিন্ন এলাকা থেকে নৌকাবাইচে এসে উৎসবের আমেজ নিয়ে উপভোগ করে প্রতিযোগিতাকে সাফল্যমন্ডিত করেছেন সকল দর্শনার্থীকে আমি স্বাগত জানাই।
কেকে/ আরআই