শান্তিপূর্ণ গ্রামীণ জীবনের জন্য একসময় মাগুরার শালিখা ছিল পরিচিত। সকালবেলা পাখির ডাক, বিকালে শিশুদের হাসির শব্দ আর নিস্তব্ধ রাতে জোনাকির আলো। এমনই ছিল এখানকার জীবনের সুর। কিন্তু সেই সুর এখন হারিয়ে যাচ্ছে কর্ণ বিদারক হর্ন, মাইক ও যান্ত্রিক শব্দের গর্জনে। শালিখার আড়পাড়া, শতখালী, গঙ্গারামপুরসহ প্রায় প্রতিটি এলাকায় শব্দ দূষণ এখন নিত্যদিনের সঙ্গী হয়ে উঠেছে।
দিনের শুরু থেকেই শুরু হয় শব্দের দাপট। সকালবেলা স্কুলগামী শিক্ষার্থীরা যখন পথে নামে, তখনই শুরু হয় অটোরিকশা, মোটরসাইকেল ও পিকআপভ্যানের হর্ণের প্রতিযোগিতা। সাথে আড়পাড়া বাজারের বিভিন্ন ব্যবসায়য়ীদের নিয়মবহির্ভূত মাইকিং যোগ করছে বাড়তি মাত্রা। দোকানপাটের পাশে উচ্চস্বরে চলা সাউন্ড সিস্টেম, লাউডস্পিকার ও যানবাহনের অবিরাম আওয়াজে শান্তভাবে কথা বলাও কঠিন হয়ে পড়ছে। সন্ধ্যার পর বিভিন্ন পন্যের প্রচারণা পাশাপাশি পিকাপ এবং মাইক্রোর অনুমোদনহীন হর্নে অতিষ্ঠ এলাকাবাসী। মানুষ নয়, শব্দই যেন এখাকার শালিখার নিয়ন্ত্রক শক্তি।
শব্দ দূষণ এখন শুধু একটি বিরক্তিকর বিষয় নয়, বরং এটি মানুষের শারীরিক ও মানসিক স্বাস্থ্যের জন্যও মারাত্মক হুমকি। বাংলাদেশ পরিবেশ সংরক্ষণ আইন অনুযায়ী, জনবসতিপূর্ণ এলাকায় ৫৫ ডেসিবেল ও বাণিজ্যিক এলাকায় ৭০ ডেসিবেলের বেশি শব্দ উৎপন্ন করা অপরাধ। কিন্তু শালিখার কোথাও এ আইনের প্রয়োগ দেখা যায় না। প্রশাসনের তদারকির অভাব ও সাধারণ মানুষও সচেতনতার অভাব হেতু দিন দিন শব্দ দূষণ বাড়ছে বলে মনে করেন স্থানীয় সচেতন মহল। অকারণে হর্ণ বাজানো কিংবা অনুমতি ছাড়া মাইক ব্যবহার এখন যেন নিত্যদিনের সাধারণ ঘটনা।
আড়পাড়া সরকারি আউডিয়াল হাই স্কুলের শিক্ষার্থী আরাফ, রিথী জানায়, শব্দ দূষণে কারণে আমাদের ক্লাসে মনোযোগ ধরে রাখা কঠিন হয়ে পড়ে। পাশ দিয়ে যানবাহন গেলেই এমন শব্দ হয় যে পড়াশোনায় মন বসে না। এছাড়াও বিভিন্ন পণ্যের বিজ্ঞাপনের মাইকের আওয়াজে খুবই বিরক্ত লাগে।
উপজেলা সদর আড়পাড়া ইউনিয়নের আন-নূর একাডেমির প্রধান শিক্ষক মুনীর বিন ওয়াজিদ আড়পাড়া বাজার (শালিখা থানা শহর)-কে কেন্দ্র করে অনেকগুলো শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, অফিস ও স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্র গড়ে উঠেছে। তবে এখানে যখন- তখন মাইকিং দ্বারা শব্দ দূষণের যন্ত্রণায় এই শিক্ষা, স্বাস্থ্য, ও অফিসের স্বাভাবিক কর্মকাণ্ড বিঘ্নিত হচ্ছে।
আড়পাড়া বাজারের ওষুধ ব্যবসায়ী শফিকুল ইসলাম বলেন, সারাদিন হর্ন আর মাইকের আওয়াজে মাথা ধরে যায়। ব্যবসা করার মতো পরিবেশও থাকে না।
নিয়ন্ত্রণহীন গাড়ির হর্ন আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হচ্ছে। পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষা করার জন্য এই শব্দ দূষণেরে উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা উচিত। আর এটা আইনের মাধ্যমেই সম্ভব।
উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা সাইমুম নেছা বলে, শব্দ দূষণ এক প্রকার নিরব ঘাতক। দীর্ঘদিন অতিরিক্ত শব্দে অবস্থান করলে মানুষের শ্রবণশক্তি নষ্ট হতে পারে। পাশাপাশি হৃদরোগ, অনিদ্রা, উচ্চ রক্তচাপ, মনোযোগ হ্রাস এবং মানসিক অস্থিরতা দেখা দেয়। শিশুরা পড়াশোনায় মনোযোগ হারায়, বয়স্করা ক্রমেই খিটখিটে হয়ে ওঠে।
উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাঝে মাঝে মাইকবিহীন বিয়ে বা সভা-সমাবেশের নির্দেশ দেওয়া হলেও বাস্তবে তা কার্যকর হয় না। নিয়মিত মনিটরিংয়ের অভাব ও অভিযান না থাকায় শব্দ দূষণের মাত্রা যেন ক্রমেই বাড়ছে। শব্দ দূষণ রোধে এখনই কার্যকর পদক্ষেপ না নিলে পরিস্থিতি আরো ভয়াবহ হতে পারে বলেও দাবি স্থানীয়দের।
কেকে/এআর