ভোর হলেই হাতে বস্তা, ব্যাগ এবং সঙ্গে বৈঠা নিয়ে টিনের তৈরী ছোট্ট নৌকা যোগে বেরিয়ে পড়েন বগনালের বিলে। দিনভর বিলের গভীরে বিচরণ করে কুড়ান শত শত জলজ শামুক রাখেন সঙ্গে থাকা বস্তায়। বস্তা ভরে গেলেই আবারো নৌকা যোগে রেখে যান তীরে। দিন শেষে কুড়ান এক থেকে দেড় বস্তা শামুক। বিক্রি করেন ৩শ টাকায় এই টাকা দিয়েই চলে পরিবারের সদস্যদের ভোরন পোষণ ও ছেলে মেয়েদের লেখা পড়ার খরচ। এই শামুকই তার জীবিকার প্রধান অবলম্বন।
বলছিলাম মাগুরার শালিখা উপজেলা সদর আড়পাড়া ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের নিতাই সরকারের কথা। শুধু নিতাই সরকার নয় বিল থেকে কুড়ানো শামুক বিক্রি করে জীবীকা চালান হেংলা পাতলা ষাটোর্ধ বয়সী কমলা রানী বিশ্বাসও। নিতাইয়ের মতো তিনিও শামুক কুড়ান শালিখা উপজেলার বগনাল বিল ও নরপতির খালের কিনারা দিয়ে।
স্থানীয়ভাবে জানা যায়, বর্ষা কিংবা শুষ্ক মৌসুম দুই সময়েই শামুক ধরা চলে। পানির নিচে বা কাদায় লুকিয়ে থাকা শামুক তারা হাত দিয়ে বা ছোট লাঠি দিয়ে খুঁজে তুলে নেয়। এরপর সেগুলো বাজারে নিয়ে বিক্রি করে। বস্তা প্রতি ৩শ টাকা মৌসুমভেদে দাম একটু ওঠানামা করে।
শামুক ক্রয় করেন মূলত মাছ ও হাঁসের খাদ্য ব্যবসায়ীরা। আবার কিছু শামুক সংগ্রহ হয়ে যায় চুন তৈরির কারখানায়, যেখানে খোলস পুড়িয়ে তৈরি হয় চুন। এইভাবে এক চক্রে শামুক হয়ে উঠেছে অনেক গরিব পরিবারের রোজগারের উৎস।
পেশাটি সহজ মনে হলেও এতে রয়েছে নানা কষ্ট। ঘণ্টার পর ঘণ্টা পানিতে ভিজে থাকতে হয়, তীব্র রোদে কিংবা বৃষ্টিতে কাজ বন্ধ থাকে না। অনেক সময় সাপে-কেঁচো বা ধারালো বস্তুতে আহত হন তারা। তবুও জীবনের প্রয়োজনে প্রতিদিন ভোরে নদী-খালের পাড়ে হাজির হন এই পরিশ্রমী মানুষগুলো।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, কেউ তালের ডুঙ্গা কেউবা টিনের তৈরী ছোট্ট নৌকা নিয়ে হাতে বৈঠা ও বস্তা নিয়ে ছুটছেন বিলের গভীরে। মাজা সমান পানিতে নেমে কুড়াচ্ছেন জলজ শামুক। রোদ বৃষ্টি উপেক্ষা করে সকাল থেকে বিকাল পর্যন্ত শামুক কুড়াচ্ছেন তারা। এমনি একজন জলজীবী শালিখা উপজেলার আড়পাড়া ইউনিয়নের বরইচারা গ্রামের নিতাই সরকার।
তার সঙ্গে কথা হলে তিনি বলেন, সামান্য একটু জমি আছে তা চাষ করে যে ফসল পাই তা দিয়ে মনিগের লেখাপড়া করানো যায় না। তাই সংসারের খরচ চালানোর জন্য বগনালের বিল থেকে শামুক কুড়াইয়ে পার্শ্ববর্তী জেলার শামুক বয়বসায়ীদের কাছে বিক্রি করে দিন শেষে ৩ শ টাকা পায়।
অপর একজন জলজীবী কমলা রানী বিশ্বাস, তিনি বলেন, চার মেয়ে এবং আমি দিয়ে পরিবারে পাঁচ জন সদস্য যাদের ভরণপোষণ এবং খাওয়া-দাওয়ার খরচ এই শামুক বিক্রি করেই চলে। কখনো কখনো শাপলা বিক্রি করি, আবার কখনো বিক্রি করি মাছ বিক্রি করি, কখনো বা পরের বাড়িতে কাজ করে কোনরকম বেঁচে আছি। তারপরও সৃষ্টিকর্তার আশীর্বাদে ভালোই আছি। জলাশয়ের শামুক, মাছ, শাপলা বিক্রি করে পাঁচ সদস্যের পরিবার চালান কমলা রানী বিশ্বাস তারপরেও জীবন নিয়ে যেন তার কোন অভিযোগ নেই।
শামুক এখন শুধু নদী-খালের প্রাণ নয়, বহু দরিদ্র পরিবারের জীবনের ভরসা। শামুকে খোঁজে এখন খাল- বিলে জীবীকার যুদ্ধ। মনের অজান্তেই এই ছোট জলজ প্রাণীর মধ্য দিয়ে ঘুরছে অনেকের জীবিকার চাকা।
কেকে/ এমএস