গাজার ওপর ইসরায়েলি অবরোধ চলছে দীর্ঘ সময় ধরে। ২০০৭ সালে হামাস গাজায় নিয়ন্ত্রণ নেওয়ার পর থেকে শুরু হওয়া এ অবরোধ আজও বহাল আছে। ইসরায়েলের দাবি, অস্ত্র প্রবেশ রোধ করাই এর উদ্দেশ্য। বাস্তবে খাদ্য, ওষুধ, জ্বালানি অত্যাবশ্যক জিনিসপত্রও সীমিত করা হয়েছে। ফলে গাজা পরিণত হয়েছে এক দীর্ঘস্থায়ী সিস্টেমিক কয়েদখানায়।
এ দীর্ঘ অবরোধকে রুখে দিতে ২০২৫ সালের জুলাই মাসে গাজা যুদ্ধ চলাকালীন শুরু হয় ফ্রিডম ফ্লোটিলা কোয়ালিশন, গ্লোবাল মুভমেন্ট টু গাজা এবং মাগরেব সুমুদ ফ্লোটিলা প্রমুখ সংগঠনের সমন্বয়ে গ্লোবাল সমুদ ফ্লোটিলা। এতে অংশ নেয় ৫০টিরও বেশি নৌযান ও ৪৪টিরও বেশি দেশের হাজারো অংশগ্রহণকারী; যা ইতিহাসের সবচেয়ে বড় নাগরিক-নেতৃত্বাধীন বহর।
২০১০ সালের আগে ইসরায়েলি অবরোধ ভাঙার কিছু প্রচেষ্টা সফল হলেও এরপর থেকে জাহাজগুলো ইসরায়েলি বাহিনীর হাতে আটক বা আক্রমণের শিকার হয়েছে। সর্বশেষ ২০২৫ সালের মে, জুন ও জুলাইয়ে কয়েকটি জাহাজে ড্রোন হামলার ঘটনা ঘটে। সেপ্টেম্বরে ফ্লোটিলার ওপর তিনটি ড্রোন হামলার খবর পাওয়া যায়। ফ্লোটিলার যাত্রা এক প্রকার রাজনৈতিক টাইমলাইনও তৈরি করেছে। আগস্টের শেষের দিকে যাত্রা শুরুর পর বিভিন্ন দেশে সমর্থনসভা হয়েছে। সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি বহর ভূমধ্যসাগর অতিক্রম করে গাজার দিকে এগোয়। ১ অক্টোবর রাতেই একটি জাহাজ গাজার উপকূলীয় জলসীমায় প্রবেশ করে।
২ অক্টোবর ভোরে ইসরায়েলি নৌবাহিনী অভিযান চালায়। যোগাযোগব্যবস্থা জ্যামিং করা হয়, ক্যামেরা বন্ধ করে দেওয়া হয়। ভিডিওতে দেখা গেছে, হেলমেট ও নাইট ভিশন গগলস পরা সেনারা নৌযানে প্রবেশ করছে, ফ্লোটিলার আরোহীরা হাত উঁচু করে বসে আছেন।
আয়োজকদের সর্বশেষ তথ্য অনুযায়ি, অন্তত ৩৯টি নৌযান আটক হয়েছে। ৩১৭ জন কর্মীকে বন্দি করা হয়েছে, যাদের মধ্যে রয়েছেন স্পেন, ইতালি, তুরস্ক, ব্রাজিল, যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানি, সুইডেন, যুক্তরাজ্য, ফ্রান্সসহ ৩৭টি দেশের নাগরিক রয়েছে। বন্দি হয়েছেন পরিবেশকর্মী গ্রেটা থুনবার্গও। ইসরায়েল জানিয়েছে, আটক ব্যক্তিদের আশদোদ বন্দরে নিয়ে যাওয়া হবে এবং তাদের ইউরোপে ফেরত পাঠানো হবে।
ঘটনার আন্তর্জাতিক প্রতিক্রিয়া তীব্র। তুরস্ক একে ‘সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড’ আখ্যা দিয়েছে এবং ২৪ তুর্কি নাগরিকের ঘটনায় তদন্ত শুরু করেছে। মালয়েশিয়ার প্রধানমন্ত্রী আনোয়ার ইব্রাহিম বলেছেন, এটি ‘মানবিকতার ওপর আঘাত’। কলম্বিয়ার প্রেসিডেন্ট গুস্তাভো পেত্রো আরো এগিয়ে গিয়ে ইসরায়েলি কূটনীতিকদের বহিষ্কার করেছেন ও মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি বাতিল করেছেন। ইউরোপীয় দেশগুলোর প্রতিক্রিয়া বিভক্ত। কেউ ইসরায়েলের নিরাপত্তা উদ্বেগকে গুরুত্ব দিচ্ছে, আবার অনেকে বলছে মানবিক সহায়তার বৈধ পথ বন্ধ করা অগ্রহণযোগ্য।
আন্তর্জাতিক আইন বলছে, মানবিক সহায়তাবাহী বেসামরিক জাহাজ আটকানো আন্তর্জাতিক মানবিক আইন লঙ্ঘন হতে পারে। জাতিসংঘ সনদ ও সমুদ্র আইনে বলা আছে, বেসামরিক জনগোষ্ঠীর মৌলিক চাহিদা পূরণের পথ রুদ্ধ করে অবরোধ বৈধ হয় না। গাজার ক্ষেত্রে ঠিক সেটিই ঘটছে। গ্লোবাল সুমুদ ফ্লোটিলা হয়তো গাজায় পৌঁছাতে পারেনি, কিন্তু এর প্রতীকী শক্তি বিশ্বকে নতুন করে ভাবাবে।
প্রশ্ন জেগেছে একবিংশ শতাব্দীতে মানবিক সহায়তার নৌযান আটকানোর যৌক্তিকতা কোথায়? গাজার ২০ লাখ মানুষের দীর্ঘ দুর্ভোগকে আর কত দিন রাজনৈতিক অপযুক্তির আড়ালে চাপা রাখা হবে? আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের এখন নৈতিক দায় তৈরি হয়েছে। আটক কর্মীদের দ্রুত মুক্তি এবং গাজার জন্য একটি স্থায়ী মানবিক করিডর নিশ্চিত করা জরুরি। শুধু বিবৃতি বা নিন্দা নয়, কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। কারণ মানবতার প্রশ্নে পৃথিবী নীরব থাকলে সেই নীরবতাই হয়ে উঠবে সবচেয়ে বড় অপরাধের সাক্ষী।
কেকে/ এমএস