রাজধানীর মিরপুর দুয়ারীপাড়া সরকারি কলেজের শিক্ষার্থী ছিলেন রিতা আক্তার (১৮)। বাবা ঢাকায় রিকশা চালিয়ে, মা বাসাবাড়িতে কাজ করে মেয়ের পড়াশোনার খরচ চালিয়ে যাচ্ছিলেন। সেই রিতা জুলাই আন্দোলনে ঘরে বসে থাকতে পারেননি। যোগ দেন আন্দোলনে। গত বছর ৫ আগস্ট তিনি যোগ দিয়েছিলেন ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ কর্মসূচিতে। কিন্তু মিরপুর এলাকায় পুলিশের গুলি ঝাঁঝরা করে দেয় তাকে। বাড়ি না ফেরায় দরিদ্র মা-বাবা তাকে হন্যে হয়ে খুঁজতে শুরু করেন। অবশেষে ওইদিন সন্ধ্যায় সোহরাওয়ার্দী মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে মরদেহ পান তারা। মা-বাবার চিৎকারে সেদিন কেঁপে উঠেছিল সোহরাওয়ার্দী হাসপাতালের মর্গ।
শুধু এ ঘটনাই নয়, জুলাই আন্দোলনে নিহত হয়েছেন ১১ জন নারী। এর মধ্যে শিক্ষার্থী, গৃহকর্মী থেকে শুরু করে বৃদ্ধা ও শিশু রয়েছে। সেই ১১ জনের মধ্যে ১০ জনের পরিচয় মিললেও এখন পর্যন্ত এক হতভাগ্য নারীর পরিচয় মেলেনি। কয়েক মাস ধরে তার লাশ পড়ে আছে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল মর্গে। বছর ঘুরে এলেও হাহাকার থামেনি শহিদদের পরিবারে। শিক্ষকরাও ভুলতে পারছেন না শহিদ ছাত্রীদের কথা।
মিরপুরের হজরত শাহ আলী মহিলা কলেজে ম্যানেজমেন্ট বিভাগে অনার্স তৃতীয় বর্ষের শিক্ষার্থী ছিলেন মেহেরুন নেছা তানহা। ১৯ জুলাই আন্দোলনে পুলিশের গুলিতে নিহত হন তানহার মামাতো ভাই রাব্বি। এ ঘটনার প্রতিবাদে ও বিচার চেয়ে আন্দোলনে যোগ দেন তানহা। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালালে আনন্দ মিছিলে যোগ দেন তানহা ও তার ছোট ভাই। মিছিল শেষে সন্ধ্যা ৭টায় বাসায় ফেরেন তানহা। বাসায় ফিরে নিজের রুমে ঢুকে ছোট ভাইকে কল করে জানান, নতুনবাজারের দিকে সংঘর্ষ হচ্ছে, সে যেন অন্য রাস্তা দিয়ে বাসায় ফেরে। এর মধ্যে জানালার সামনে দাঁড়াতেই একটা গুলি এসে লাগে তার শরীরে। মুহূর্তে মেঝেতে লুটিয়ে পড়েন তানহা। অভ্যুত্থানের দিন শহিদ হন তিনি। তখন থেকে তার পরিবারে চলছে হাহাকার, যা থামেনি আজও। তানহার মা আছমা আক্তার শিমুল কাঁদতে কাঁদতে বলেন, আমার মেয়ে (তানহা) সেদিন (৫ আগস্ট) গণভবন থেকে বাসায় এলেও ছেলেটা তখনো আসেনি। আমি আল্লাহর কাছে বলছিলাম আমার মেয়েটা সুুস্থভাবে ফিরেছে, যেন আমার ছেলেটাও ফিরে আসে। আমার ছেলে সুস্থভাবে ফিরেছিল ঠিকই, কিন্তু আমার মেয়েটা নিজের ঘরে বসেই শহিদ হয়।
মিরপুরের হজরত শাহ আলী মহিলা কলেজে ম্যানেজমেন্ট বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ আনোয়ার হোসেন বলেন, তানহা আমাদের বিভাগের ২০-২১ সেশনের শিক্ষার্থী ছিল। ঘটনার দিন ওর গুলিবিদ্ধ হওয়ার কথা শুনে আমরা বেশ কয়েকজন শিক্ষক ওর বাসায় যাই। রক্তাক্ত তানহাকে আজো আমরা ভুলতে পারি না। চোখ ভিজে যায় সব শিক্ষকের। এখনো আমরা ওর মা-বাবার সঙ্গে যোগাযোগ রাখি। সান্ত্বনা দেওয়ার চেষ্টা করি। নারী হিসেবে জুলাই অভ্যুত্থানের সর্বকনিষ্ঠ শহিদ ছয় বছরের শিশু রিয়া গোপ। বেঁচে থাকলে এ বছর সাত বছরে পা দিত ছোট্ট রিয়া। গত বছর ১৯ জুলাই নিজ বাসার ছাদে গুলিতে বাবার কোলে লুটিয়ে পড়ে সে এবং প্রমাণ করে দিয়ে যায় পৃথিবীর সবচেয়ে নিরাপদ স্থান নিজ বাবার কোলেও সে সময় নিরাপদ ছিল না।
উত্তরার মাইলস্টোন স্কুলের দশম শ্রেণির শিক্ষার্থী ছিল ষোড়শী নাইমা সুলতানা। ১৯ জুলাই বিকেলে নিজ বাসার বারান্দায় পুলিশের ছোড়া এলোপাতাড়ি গুলির শিকার হয় নাইমা। নিমেষে মাথা এফোঁড়-ওফোঁড় হয়ে যায় নাইমার। সবাই মিলে হাসপাতালে পৌঁছার আগেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ে নাইমা।
সাভার এলাকার এইচএসসি পরীক্ষার্থী নাফিসা হোসেনও যোগ দিয়েছিলেন আন্দোলনে। ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পালিয়ে যাওয়ায় উচ্ছ্বসিত হয়ে তার বাবাকে ফোনে জানিয়েছিলেন। কিন্তু বাবার সঙ্গে ফোনে কথা বলার কিছুক্ষণ পর পুলিশের গুলিতে তার জীবন প্রদীপ নিভে যায়। রাজধানীর শান্তিনগরে ১৪ তলা ভবনের সাত তলায় গৃহকর্মীর কাজ করতেন ১৮ বছর বয়সি লিজা। ১৮ জুলাই ওই বাসার বারান্দায় দাঁড়িয়ে আন্দোলন দেখতে গিয়ে গুলিবিদ্ধ হন তিনি। ২২ জুলাই হাসপাতালে তার মৃত্যু হয়।
গত বছর ২০ জুলাই বিকালে চিটাগাং রোডে নিজের বাসার পাশে হৈচৈ শুনে বারান্দায় গিয়ে উঁকি দেন সুমাইয়া আক্তার। বারান্দায় গ্রিলের পাইপ ভেদ করে গুলি এসে লেগেছিল তার মাথায়। ওই গুলিতে শেষ তার জীবন। তিনি ছিলেন আড়াই বছর বয়সি এক শিশুসন্তানের জননী।
১৯ জুলাই দুপুরে রাজধানীর সায়েন্সল্যাব এলাকায় দুই ভাতিজাকে নিয়ে আন্দোলন দেখতে ছাদে গিয়েছিলেন নাছিমা আক্তার (২৪)। ছাদে গিয়েই গুলিবিদ্ধ হন নাছিমা ও তার এক ভাতিজা। হাসপাতালে নিয়ে যাওয়ার পর ভাতিজা বেঁচে গেলেও নাসিমা চলে গেছেন না-ফেরার দেশে।
পাঁচ ছেলে-মেয়ে নিয়ে শনির আখড়ায় থাকতেন শাহিনূর বেগম (৫৭)। গত বছর ২২ জুলাই ফজরের নামাজ আদায় করে হাঁটতে বের হন তিনি। কিন্তু আর ফেরা হয়নি বাসায়। গুলিবিদ্ধ অবস্থায় প্রায় ঘণ্টাখানেক রাস্তায় পড়ে ছিলেন। যে ব্যক্তি তাকে উদ্ধার করে, তিনি প্রথমে শনির আখড়ার একটি হাসপাতালে এবং পরে ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে নিয়ে যান। খবর পেয়ে তার মেয়েরা যান ঢাকা মেডিকেলে। চিকিৎসক বলেন দ্রুত অস্ত্রোপচার লাগবে। কিন্তু সে সময় এই শহিদ নারীর জন্য হাসপাতালে কোনো আইসিইউ পাওয়া যায়নি।
মায়া ইসলামের (৬০) ছোট্ট নাতি তার বাবার সঙ্গে আইসক্রিম কিনতে গিয়েছিল দোকানে। নাতিকে আনতে এগিয়ে যান তিনি। বাসার গলিতে ঢোকার সময় গুলি লাগে নাতির গায়ে। একই গুলি মায়া ইসলামের তলপেট ভেদ করে চলে যায়। দাদি-নাতি দুজনকেই নিয়ে যাওয়া হয় বনশ্রীর একটি হাসপাতালে। নাতি বেঁচে গেলেও গুলিবিদ্ধ হওয়ার এক দিন পর ২০ জুলাই শহিদ হন মায়া ইসলাম।
মানবাধিকারকর্মী এলিনা খান বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানে আমাদের অনেক মা-বোন শহিদ হয়েছেন। তারা সবাই কোনো না কোনো মায়ের সন্তান। আবার কেউ ছিলেন সন্তানের মা। যে বৈষম্য বিলোপে এত আত্মত্যাগ, সেই বৈষম্যের শিকার যেন তারা বা তাদের পরিবার না হয়। আজ তাদের পরিবার যদি যোগ্য সম্মান না পায়, তা হবে শহিদদের প্রতি অসম্মান। যেসব মা তাদের সন্তান রেখে শহিদ হয়েছেন, সেই সন্তানরা যাতে অবহেলিত না হয়, রাষ্ট্রকে সে দায়িত্ব নিতে হবে।
কেকে/এএম