ভারতের রাজধানী দিল্লি লাগোয়া হরিয়ানার শহরের গুরুগ্রাম থেকে পশ্চিমবঙ্গের অন্তত ছয়জন বাসিন্দাকে বাংলাদেশি সন্দেহে আটক করে পুলিশ। আটককৃতদের পরিবারের অভিযোগ, তাদের ওপর শারীরিক নির্যাতন চালাচ্ছে পুলিশ।
মঙ্গলবার (২২ জুলাই) এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানিয়েছে বিবিসি বাংলা।
আটককৃত ছয়জনই পশ্চিমবঙ্গের মালদা জেলার বাসিন্দা এবং এদের ধর্মীয় পরিচয় এরা মুসলমান। এরা সবাই পরিযায়ী শ্রমিক এবং সাত-আট বছর ধরে গুরুগ্রামে থাকতেন। বিষয়টি নিশ্চিত করেছে পশ্চিমবঙ্গের পরিযায়ী শ্রমিকদের একটি সংগঠন।
আটকের বিষয়টি স্বীকার করলেও বিবিসিকে এ ব্যাপারে বিস্তারিত তথ্য দেয়নি গুরুগ্রাম পুলিশ। এ ছয়জন আটক হওয়ার ব্যাপারে মালদা জেলার যুগ্ম শ্রম কমিশনারের কাছে লিখিত অভিযোগও জমা পড়েছে।
হরিয়ানার এ ঘটনা এমনই দিনে সামনে এসেছে, যেদিন কলকাতায় পশ্চিমবঙ্গের মুখ্যমন্ত্রী মমতা ব্যানার্জী অভিযোগ করেছেন, দেশের বিভিন্ন রাজ্যে বাংলাভাষীদের ওপরে নির্যাতন হচ্ছে, গ্রেফতার করা হচ্ছে।
দিল্লি, উত্তর প্রদেশে, গুজরাট, রাজস্থান, মহারাষ্ট্র এবং ওড়িশা রাজ্যে গত কয়েক মাস ধরে বাংলাদেশি সন্দেহে বহু বাংলাভাষীকে আটক করা হচ্ছে, যারা আসলে পশ্চিমবঙ্গের বাসিন্দা। আবার ভারতের বেশ কয়েকজনকে বাংলাদেশে পুশইন করে দেওয়া হয়েছে। অবশ্য পরে পরিচয় নিশ্চিত হওয়ার পরে ভারতে ফিরিয়ে আনা হয়েছে।
পশ্চিমবঙ্গের যে বাসিন্দাদের গুরুগ্রামে আটক করা হয়েছে, তারা মালদা জেলার চাঁচল– এক নম্বর ব্লকের বাসিন্দা বলে দাবি করেছে তাদের পরিবার। গত শুক্রবার রাতে সাদা পোশাকের পুলিশ তাদের ঘরে এসে পরিচয়পত্র যাচাই করতে আসে বলে জানাচ্ছেন ধৃতদের এক আত্মীয় মামনি খাতুন।
তিনি বলেন, যাদের আটক করেছে, তার মধ্যে আমার দুই মামা আর দুই দাদা আছে। সেদিন রাতে তখন কারও খাওয়া হয়ে গিয়েছিল, কেউ খেতে বসেছিল। সাদা পোশাকের পুলিশ এসে আমাদের আধার কার্ড দেখতে চায়। এরপরে তারা বলে যে থানায় যেতে হবে আঙুলের ছাপ নেবে বলে। কিছুক্ষণের মধ্যেই ছেড়ে দেবে, এ আশ্বাস দিয়ে গাড়িতে করে নিয়ে যায়।
আটককৃতদের সোমবার পর্যন্তও ছেড়ে দেওয়া হয়নি। প্রাথমিকভাবে গুরুগ্রামের সেক্টর ১০-এ থানার পুলিশ তাদের আটক করেছিল। পরের দিন তাদের বাদশাহপুর থানায় নিয়ে যাওয়া।
মামনি খাতুন বলেন, ‘আমরা রোববার রাত সাড়ে ১০টা পর্যন্ত ওই থানায় ছিলাম। কিন্তু আমাদের সঙ্গে দেখা করতে দেয়নি। একবার ওদের নিয়ে গেল মেডিকেল পরীক্ষা করা হবে বলে। কোথায় যে নিয়ে গেছে, তা বলেনি। রাত পর্যন্ত তাদের থানায় ফেরত আনেনি।’
‘পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ’ -এর সাধারণ সম্পাদক আসিফ ফারুক বলেন, ‘পুলিশ আমার কাছে মেনে নিয়েছে যে ওই ছয়জনকে তারা আটক করেছে। আমি রোববার বাদশাহপুরের অ্যাসিস্ট্যান্ট পুলিশ কমিশনারকে ফোন করেছিলাম। তিনি অবশ্য এটাও বলেছেন যে ওদের গ্রেফতার করা হয়নি।’
বিবিসি বাদশাহপুর থানার ওসি, অ্যাসিস্ট্যান্ট কমিশনার এবং তারও ঊর্ধ্বতন অফিসর ডেপুটি কমিশনারকে একাধিকবার ফোন করার চেষ্টা করেছে। তবে বিস্তারিত কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি তাদের কাছ থেকে।
মামনি খাতুন এবং পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চের আসিফ ফারুক দুজনেই জানিয়েছেন, আটককৃতদের ওপরে শারীরিক নির্যাতন হচ্ছে। মামনি খাতুন বলেন, ‘আমার আত্মীয়দের একজনের কাছে ফোন আছে। চার্জ শেষ হয়ে বন্ধ হওয়ার আগে দুই একবার কথা বলতে পেরেছি। ওদের মারধর করা হয়েছে। আর দিনে একবার মাত্র খেতে দিয়েছে।’
আসিফ ফারুক বলেন, আটককৃতদের দিয়ে থানার কাজ করাচ্ছে পুলিশ। এমনকি পুলিশ সদস্যদের পোশাকও পরিস্কার করতে হচ্ছে তাদের। একে তো বেআইনিভাবে আটক করে রেখেছে, তারওপরে তাদের দিয়ে এসব কাজ করানো তো আইনের চূড়ান্ত লঙ্ঘন। আমরা পুরো বিষয়টি মালদায় শ্রম দফতরের যুগ্ম কমিশনারকে চিঠি লিখে জানিয়েছি। এতে যাতে রাজ্য সরকার দ্রুত হস্তক্ষেপ করে এবং আটককৃতদের ছাড়িয়ে আনার ব্যবস্থা করে। আমাদের সন্দেহ হচ্ছে, এদেরকেও না বাংলাদেশে পুশ করে দেয়। ’
হরিয়ানার গুরুগ্রামে যাদের আটক করা হয়েছে, তাদের বাড়ি যে জেলায়, সেই মালদারই অন্য ছয় বাসিন্দাকে সম্প্রতি পাঞ্জাবে আটক করেছে সেরাজ্যের পুলিশ। তাদের বিরুদ্ধে অন্যান্য অভিযোগের মধ্যেই রয়েছে গোহত্যারও অভিযোগ।
পরিযায়ী শ্রমিক ঐক্য মঞ্চ বলছে, এ ছয়জনের বিরুদ্ধে ২ জুলাই একটি এফআইআর দায়ের করা হয়েছিল। এরা সবাই একটি পোলট্রি ফার্মে কাজ করতেন। তাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা দেওয়া হয়েছে বলে জানিয়েছেন ঐক্য মঞ্চের নেতা আসিফ ফারুক। তিনি বলেন, ‘এরা খুবই গরীব, শ্রমিকের কাজ করতে গিয়েছিল পাঞ্জাবে। মামলা লড়ারও ক্ষমতা নেই তাদের।’
পশ্চিমবঙ্গ পরিযায়ী কল্যাণ পর্ষদের চেয়ারম্যান ও তৃণমূল কংগ্রেসের সংসদ সদস্য সামিরুল ইসলাম জানিয়েছেন, পাঞ্জাবে গ্রেফতার হওয়া ছয়জনের জন্য তারা আইনি সহায়তা দিচ্ছেন।
পশ্চিমবঙ্গের ক্ষমতাসীন তৃণমূল কংগ্রেসের এক সমাবেশে দলনেত্রী মমতা ব্যানার্জী সোমবার আবারো অভিযোগ করেছেন যে বিভিন্ন রাজ্যে বাংলায় কথা বললেই বাংলাদেশি বলে সন্দেহ করে হেনস্থা করা হচ্ছে। পশ্চিমবঙ্গের অনেক বাসিন্দাকে নানা রাজ্যে আটক করা হচ্ছে এবং বেশ কয়েকজনকে ইতোমধ্যে বাংলাদেশে পাঠিয়ে দেওয়া হয়েছে বলেও তিনি অভিযোগ করেন। কেন্দ্র ও বিভিন্ন বিজেপি শাসিত রাজ্যকে নিশানা করেন তিনি।
কেকে/এআর