রবিবার, ৩ আগস্ট ২০২৫,
১৯ শ্রাবণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

রবিবার, ৩ আগস্ট ২০২৫
শিরোনাম: এনসিপি-ছাত্রদলের সমাবেশ আজ      নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটেনি      এক দফা ঘোষণা      চব্বিশের স্মরণে ২৪ দফা ইশতেহার দেবে এনসিপি      রোববার শাহবাগ এলাকা এড়িয়ে চলার অনুরোধ      ৫ আগস্ট বিকালে ঘোষণা হবে জুলাই ঘোষণাপত্র      জামায়াত আমিরের ওপেন হার্ট সার্জারি সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
কুরবানির চামড়া : দানের পুণ্য থেকে দানবীয় সিন্ডিকেটে
মোহাম্মদ মোরশেদ
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ১২ জুন, ২০২৫, ৯:২৪ পিএম

বাংলাদেশের চামড়া শিল্প একটি সম্ভাবনাময় রফতানিমুখী খাত। প্রাণিসম্পদ অধিদফতরের তথ্যানুসারে, এ বছর কুরবানির পশুর চাহিদা প্রায় ১ কোটি ৩ লাখ ৮০ হাজার। এ পরিসংখ্যান প্রতি বছর দেখা যায়। যার ফলে ৫০-৬০ শতাংশ কাঁচা চামড়া এ ঈদের সময় সংগ্রহ করা হয়। বাস্তবে এ সংখ্যাটি হয়ত আরো বেশি। চামড়া থেকে তৈরি হয় জুতা, ব্যাগ, বেল্ট, গ্লাভসসহ নানা ধরনের পণ্য। এ খাত থেকে অর্জিত বৈদেশিক মুদ্রা বাংলাদেশের অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। বাংলাদেশে চামড়া শিল্পের সম্ভাবনা অনেক বেশি, কারণ এখানকার কাঁচা চামড়ার গুণগত মান ভালো এবং শ্রম খরচ তুলনামূলকভাবে কম। তবে নানা বাধার কারণে এ শিল্প কাঙ্ক্ষিত উন্নতি করতে পারছে না। পোশাকশিল্প যেখানে আমদানিনির্ভর হওয়া সত্ত্বেও সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহৎ রফতানি খাতে পরিণত হয়েছে, সেখানে দেশেই উৎপাদিত কাঁচা চামড়া থাকা সত্ত্বেও চামড়া শিল্পের রফতানি বৈশ্বিক বাজারে মূল্যের তুলনায় খুবই কম।
 
চামড়া খাতের রফতানি বড় অংশ ইউরোপের ওপর নির্ভরশীল। তবে চামড়া খাতের বৈশ্বিক সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপের (এলডব্লিউজি) সনদ না পাওয়ায় দেশীয় ট্যানারি শিল্প মারাত্মক ক্ষতিতে পড়েছে। ট্যানারিগুলো কমপ্লায়েন্স, সিইটিটি বা ওয়েস্ট ম্যানেজমেন্টের অভাবে এলডব্লিউজি সনদ পাচ্ছে না। চামড়া শিল্পের বড় বাধা হলো আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুযায়ী কমপ্লায়েন্স না থাকা। সাভারের চামড়া শিল্প নগরীতে কেন্দ্রীয় বর্জ্য পরিশোধনাগার যথাযথভাবে কাজ করছে না, ট্যানারির অভ্যন্তরীণ পরিবেশ উন্নত নয় এবং মালিকদের মধ্যে সচেতনতার অভাব রয়েছে। ফলে আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি প্রদানকারী সংস্থা লেদার ওয়ার্কিং গ্রুপ (এলডব্লিউজি)-এর সনদ বেশিরভাগ ট্যানারি পায় না। এ সমস্যার কারণে ইউরোপের বাজারে প্রবেশ করা যায় না এবং চীনসহ অন্যান্য দেশে কম দামে চামড়া রফতানি করতে হয়। বর্তমানে বাংলাদেশে ২০০টির অধিক ট্যানারি থাকলেও মাত্র ৬টি ট্যানারি এলডব্লিউজি সনদপ্রাপ্ত, যেখানে পার্শ্ববর্তী ভারতে ১৩৯টি, এবং চীনে ১০৩টি। পর্যাপ্ত সুযোগ ও সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও সরকার এই বিষয়ে উদাসীন।

কয়েকটি পরিসংখ্যান তুলে ধরলে চামড়া খাতের বাস্তব চিত্র স্পষ্ট হয়। রফতানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) তথ্য অনুযায়ী, ২০১৭-১৮ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১০৮ কোটি ৫৫ লাখ ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করেছিল। পরের অর্থবছর, অর্থাৎ ২০১৮-১৯-এ এই রফতানি আয় নেমে আসে প্রায় ১০২ কোটি ডলারে। এরপর করোনার ধাক্কা চামড়া খাতেও পড়ে। ২০১৯-২০ ও ২০২০-২১ অর্থবছরে রফতানি আয় যথাক্রমে ৮০ কোটি ও ৯৪ কোটি ডলারে নেমে আসে। ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশ ১.২৫ বিলিয়ন ডলারের চামড়া ও চামড়াজাত পণ্য রফতানি করেছে, যা আগের বছরের তুলনায় প্রায় ২ শতাংশ কম। আরো হতাশাজনক হলো, ২০২৩-২৪ অর্থবছরের প্রথম আট মাসে এ খাত থেকে আয় হয়েছে মাত্র ৭১৩ মিলিয়ন ডলার—যা গত বছরের একই সময়ের তুলনায় প্রায় ১৪ শতাংশ কম। বছরের পর বছর ধরে চামড়া ও চামড়াজাত পণ্যের রফতানি আমাদের প্রত্যাশিত সুফল না এনে বরং আর্থিক ক্ষতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে—এ পরিসংখ্যান তা স্পষ্ট করে।

রফতানি তথ্য অনুসারে, ২০১২ সালে চামড়া খাতের আয় ছিল ১.১৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা ২০২৪ সালে কমে ৯৭০ মিলিয়ন মার্কিন ডলারে দাঁড়িয়েছে। প্রচুর পরিমাণে কাঁচা চামড়ার সরবরাহ থাকা সত্ত্বেও, অন্যান্য শিল্পের উল্লেখযোগ্য উন্নয়ন হয়েছে, যেখানে চামড়া শিল্প পিছিয়ে রয়েছে। দেশীয় কাঁচামাল থাকা সত্ত্বেও আন্তর্জাতিক বাজারে অংশগ্রহণ সীমিত, এবং বিপুল সম্ভাবনার চামড়াশিল্প বিকাশ লাভ করছে না। অথচ কুরবানির ঈদে উৎপাদিত বিপুল পরিমাণ কাঁচা চামড়া যদি সঠিকভাবে সংগ্রহ, সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াজাত করা যেত, তাহলে তা বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনের একটি কার্যকর উৎসে রূপ নিতে পারত।

ঈদের সময় কুরবানিদাতারা চামড়া দান করেন মানবিকতা, ধর্মীয় বিশ্বাস ও সামাজিক কল্যাণের উদ্দেশ্যে। কিন্তু অনেক এলাকায় দেখা যায়, কিছু মধ্যস্বত্বভোগী ও সিন্ডিকেট সদস্যরা কৃত্রিমভাবে চামড়ার দাম কমিয়ে ফেলে। নির্ধারিত মূল্যের চেয়ে অনেক কম দামে চামড়া কেনা হয়, কখনো বিনামূল্যে সংগ্রহ করাও যায়। এমনকি কিছু কিছু স্থানে মাদ্রাসা বা এতিমখানার প্রতিনিধি এলেও তাদের কাছ থেকে চামড়া ছিনিয়ে নেওয়ার ঘটনাও ঘটে। ২০১৯ সালে দেখা গেছে, চামড়ার দাম এতটাই কমে যায় যে শত শত চামড়া সড়কের পাশে পড়ে নষ্ট হয়ে যায়। ঢাকায় প্রায় ৫০% চামড়া বিক্রি না হওয়ায় ফেলে দেওয়া হয় ডাস্টবিনে। চট্টগ্রামের অলিতে-গলিতে নষ্ট হয়ে পড়ে ছিল চামড়া। ধর্মীয় দান আর তখন আর্থিক অপচয়ে রূপ নেয়।

প্রতি বছর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় চামড়ার জন্য মূল্য নির্ধারণ করে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের বাণিজ্য উপদেষ্টা শেখ বশিরউদ্দিন বলেন, ‘এবার রাজধানীতে লবণজাত গরুর চামড়ার সর্বনিম্ন দাম ধরা হয়েছে ১৩৫০ টাকা। ঢাকার বাইরে ১১৫০ টাকা। মাদ্রাসা-এতিমখানাগুলোর সংগ্রহ করা কাঁচা চামড়া সংরক্ষণে বিনামূল্যে ৩০ হাজার টন লবণ সরবরাহ করেছে সরকার।’ কিন্তু বাস্তবে কোনো এলাকায়ই এ মূল্য কার্যকর হয় না। কেননা সিন্ডিকেট একটি ছাতার নিচে কাজ করে— যেখানে আড়তদার, ট্যানারি মালিক, স্থানীয় রাজনৈতিক প্রভাবশালীর একটি অংশ সক্রিয় থাকে। ফলে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা নিরুপায় হয়ে পড়ে। এবারেও যার বাস্তব করুণ চিত্র বিভিন্ন গণমাধ্যমে উঠে আসে।
 
চট্টগ্রামের বিভিন্ন উপজেলাসহ নগরের বিভিন্ন এলাকা থেকে মৌসুমি ব্যবসায়ীরা কুরবানির পশুর চামড়া কিনে চট্টগ্রাম শহরের আতুরার ডিপো, চৌমুহনী, দেওয়ানহাট ও পতেঙ্গা এলাকায় বিক্রির উদ্দেশ্যে আনেন। তবে আড়তদারদের অনাগ্রহের কারণে অধিকাংশ ব্যবসায়ী চামড়া বিক্রি করতে ব্যর্থ হন। এবং চামড়াগুলো রাস্তায় ফেলে চলে যান।
বাংলাদেশের চামড়া শিল্প এক সময় সম্ভাবনাময় হলেও আজ তা অব্যবস্থাপনা, দুর্বল অবকাঠামো এবং সিন্ডিকেটের দৌরাত্ম্যে প্রায় ধ্বংসের পথে। সাভার চামড়া শিল্পনগরীতে ইটিপি চালু না হওয়া, আধুনিক প্রযুক্তির ঘাটতি, নীতিগত দুর্বলতা এবং কুরবানির মৌসুমে সিন্ডিকেটের দমন-পীড়নে রফতানিমুখী সম্ভাবনাগুলো মুখ থুবড়ে পড়েছে।

এর বিপরীতে ভিয়েতনাম, ইতালি, তুরস্ক ও ব্রাজিল চামড়া শিল্পকে প্রযুক্তিনির্ভর, পরিবেশবান্ধব এবং আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন করে গড়ে তুলে বৈশ্বিক বাজারে নিজেদের অবস্থান দৃঢ় করেছে। বিশেষ করে ‘ভ্যালু অ্যাডেড’ পণ্য, দক্ষ জনবল এবং রফতানিমুখী নীতিমালার কারণে তারা বিশাল পরিমাণ বৈদেশিক মুদ্রা অর্জনে সক্ষম হয়েছে।

বাংলাদেশ চাইলে এসব দেশের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে চামড়া শিল্পকে আবারো ঘুরে দাঁড়াতে পারে। এর জন্য প্রয়োজন সময়োপযোগী অবকাঠামো উন্নয়ন, পরিবেশ ব্যবস্থাপনা, প্রযুক্তি ব্যবহার, দক্ষ জনবল তৈরি ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণে কার্যকর নীতি গ্রহণ।

লেখক : প্রাবন্ধিক

কেকে/এএম
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

এনসিপি-ছাত্রদলের সমাবেশ আজ
নির্বাচন নিয়ে শঙ্কা কাটেনি
এক দফা ঘোষণা
ভেড়ামারায় বিদ্যুতায়িত হয়ে মা—ছেলের মৃত্যু
‘জনগণই খুনি হাসিনাকে গণভবন থেকে নামিয়ে এনেছে’

সর্বাধিক পঠিত

বাঞ্ছারামপুরের প্রভাবশালী আ.লীগ নেতা পঁচা দেলু গ্রেফতার
উখিয়ায় জামায়াতের পথসভায় জনস্রোত
মৌলভীবাজারে পৃথক দুর্ঘটনায় ২জনের মৃত্যু
‘শিল্পীর দূরদৃষ্টিতে ফেলনা বলতে কিছু নেই’
চাটমোহরে ভাঙা রাস্তা সংস্কারের দাবিতে মানববন্ধন

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close