ঢাকার প্রাণকেন্দ্রে অবস্থিত হাতিরঝিল প্রকল্পটি এক সময় নগরবাসীর জন্য নির্মল বাতাসে শ্বাস নেওয়ার স্বপ্নের একটি স্থান ছিল। তবে বর্তমানে এটি বিষাক্ত জলাশয়ে পরিণত হয়েছে, যেখানে হাঁটতে গেলে নাক চেপে ধরতে হয়। এ রূপান্তরের পেছনে দায় কার? এর সমাধান কি আদৌ সম্ভব? নাকি শুধুই অর্থের অপচয়ে আটকে থাকবে রাজধানীবাসীর স্বপ্ন?
হাতিরঝিলের স্বপ্নের সূচনা
২০১৩ সালে হাতিরঝিল প্রকল্পের উদ্বোধন হয়েছিল ঢাকার জলাবদ্ধতা কমানো, যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং নগরবাসীর জন্য একটি নির্মল বিনোদন কেন্দ্র তৈরির লক্ষ্যে। প্রকল্পটি ৩০২ একর আয়তনের, যা এফডিসি থেকে গুলশান পর্যন্ত বিস্তৃত। তখনোই নগরবাসী প্রথমবারের মতো রাজধানীর বুকে এমন একটি জায়গা পেয়ে উচ্ছ্বসিত হয়েছিল। চারপাশে সবুজ গাছের সারি, ঝকঝকে পানি, ওয়াটার ট্যাক্সিতে ভ্রমণ—সব মিলিয়ে ঢাকার বুকে হাতিরঝিল এক টুকরো শান্তির নাম হয়ে উঠেছিল।
পানিদূষণের সূচনা ও বর্তমান অবস্থা
কিন্তু বছর না ঘুরতেই সেই স্বপ্নে কালো ছায়া পড়তে শুরু করে। হাতিরঝিলের পানিতে আশপাশের ড্রেনের পানি, পয়োবর্জ্য, শিল্পবর্জ্য মিশতে থাকে। পরিশোধনের যথাযথ ব্যবস্থা না থাকায় পানি দ্রুত দূষিত হতে শুরু করে। রাস্তা ঘেঁষে থাকা প্রায় ৭০০টি নর্দমার পানি হাতিরঝিলে মিশে যায় প্রতিনিয়ত। ফলে দুর্গন্ধের উৎস সৃষ্টি হয়। বিশেষ করে পলিথিন, প্লাস্টিক, ময়লার স্তর এবং বর্জ্যের স্তর হাতিরঝিলের রূপ-রস-গন্ধ কেড়ে নেয়।
সরেজমিনে দেখা গেছে, ঝিলের প্রায় সব অংশ থেকেই পানির দুর্গন্ধ ভেসে আসছে। পানিতে নানা বর্জ্য-পলিথিন-প্লাস্টিকের পাইপও ভাসতে দেখা গেছে। কাওরানবাজারের প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলের পেছনে বর্জ্যের মাত্রা এত বেশি যে কাজী নজরুল ইসলাম অ্যাভিনিউ থেকেও দুর্গন্ধ টের পাওয়া যায়। ঝিলে মৃত মাছও ভাসতে দেখা যায়। পানির ওপরে বর্জ্যের ওপর একটি পুরু স্তর তৈরি হয়েছে, যা ওয়াটার ট্যাক্সিতে চলার সময় স্পষ্টভাবে দেখা যাচ্ছিল। হাতির ঝিলের পানি জীববৈচিত্র্য ও পরিবেশের জন্য হুমকি বলেছেন পরিবেশবিদরা।
দায়িত্বপ্রাপ্তদের ব্যর্থতা ও দুর্নীতি
রাজউক হাতিরঝিলের রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিষ্কারের দায়িত্ব দিয়েছে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজকে। দুবছরের জন্য এক কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ হয়েছে। অথচ বাস্তবে সেভাবে কোনো অগ্রগতি চোখে পড়ে না। বরং সংবাদমাধ্যমের অনুসন্ধানে দেখা যাচ্ছে, সেই অর্থের বড় অংশ ‘কাগজে কলমে খরচ’ হয়েছে।
রক্ষণাবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় রাসায়নিক বরাদ্দ শেষ হয়ে গেছে আগেই। বাকি যা-ও ছিল, সেটি ব্যবহার হচ্ছে বছরে একবার। অথচ পানির দূষণ রোধে নিয়মিত রাসায়নিক ব্যবহার না করলে হাতিরঝিলের পানি পরিশোধন করা সম্ভব নয়। এছাড়া কাগজে-কলমে থাকা ডুবুরি বা ম্যানুয়াল মেশিন অপারেটরদের অনেককেই খুঁজে পাওয়া যায়নি। অথচ তাদের নামে বিল তোলা হয়েছে।
মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজের মালিকের কাছেও কর্মীর নাম জিজ্ঞাসা করলে তিনি সুপারভাইজারের কাছে ফোন করে নাম জেনে উত্তর দেন। কাজের অগ্রগতি ও বাস্তবিক চিত্রের মধ্যে যে ফারাক তা স্পষ্টই চোখে পড়ে।
দূষণের মাত্রা ও পরিবেশগত প্রভাব
২০২২ সালে হাতিরঝিল থেকে সংগৃহীত পানির নমুনায় ক্ষতিকর রাসায়নিক পিএফওএ এবং পিএফওএস-এর উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা মানুষের জন্য দীর্ঘমেয়াদে মারাত্মক ক্ষতির কারণ। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিএফওএস-এর মাত্রা পরামর্শমূলক মাত্রার চেয়ে ১৮৫ গুণ বেশি পাওয়া গেছে, যা ভয়াবহ।
এ ছাড়া মাছ মরে ভেসে ওঠা, ব্যাঙ, সাপ, পোকামাকড়ের বিলুপ্তি হাতিরঝিলের জীববৈচিত্র্যের ওপর ভয়াবহ আঘাত হেনেছে। বাতাসে মিথেন গ্যাসের উৎকট গন্ধ নগরবাসীকে নাক চেপে চলতে বাধ্য করছে। শিশুদের খেলাধুলা, পরিবার নিয়ে সময় কাটানো এখনো আর স্বপ্নের হাতিরঝিলে সম্ভব হচ্ছে না।
পরিবেশবিদদের দৃষ্টিতে
পরিবেশবিদ আহমদ কামরুজ্জামান মজুমদার বলেছেন, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের পিলারের কারণে আশপাশের সুয়ারেজ সিস্টেম ভেঙে পড়ছে। মাটি দিয়ে ঝিল ভরাটের কারণেও পরিবেশের ভয়াবহ ক্ষতি হচ্ছে। অক্সিজেনের মাত্রা কমে গিয়ে মাছ মরে যাচ্ছে। ক্ষুদ্র জীববৈচিত্র্য যেমন ব্যাঙ, সাপ হারিয়ে যাচ্ছে, যা ঢাকার বাস্তুতন্ত্রে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। এর ফলে মানুষের স্বাস্থ্যঝুঁকিও বাড়ছে।
দুর্নীতি, অব্যবস্থাপনা ও অদক্ষতা
রাজউক কর্তৃপক্ষের বক্তব্য শুনলে একদিকে অনিয়মের করুণ চিত্র ফুটে ওঠে, অন্যদিকে অসহায়ত্বের সুর শোনা যায়। প্রকৌশলী সাব্বির বিন তাহেরের দেওয়া তথ্য ও মাঠ পর্যায়ে পাওয়া তথ্যের মধ্যে বিস্তর ফারাক। কাগজে ম্যানুয়াল মেশিনের জন্য চারজন শ্রমিক থাকার কথা থাকলেও বাস্তবে একজনও নেই। ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান মেহজাবিন এন্টারপ্রাইজের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন এলাকাবাসী ও সাংবাদিকরা।
শুধু তাই নয়, বর্জ্য অপসারণের জন্য সপ্তাহে দুই-একদিন গাড়ি ভাড়া করে কাজ করা হয়, অথচ স্থায়ী কোনো গাড়ি বা শ্রমিক নেই। অর্থাৎ বরাদ্দ তোলা হচ্ছে, কিন্তু সেই অর্থের ব্যবহার হচ্ছে অন্য খাতে বা লোক দেখানো কার্যক্রমে।
রাজউকের দায় এড়ানোর সুযোগ নেই
রাজউক চেয়ারম্যান রিয়াজুল ইসলাম দুর্নীতি-অনিয়ম তদন্তের আশ্বাস দিয়েছেন বটে, কিন্তু বাস্তবে এমন আশ্বাস ঢাকার মানুষের কাছে নতুন কিছু নয়। কয়েক বছর ধরে হাতিরঝিলের পানি দূষণ নিয়ে আলোচনা হচ্ছে, কিন্তু কোনো স্থায়ী সমাধান হয়নি। বরাদ্দের টাকা গায়েব হয়ে যাচ্ছে ঠিকাদারদের পকেটে, অথচ রাজধানীর মানুষ ক্রমশ স্বাস্থ্যঝুঁকিতে পড়ছে।
সম্ভাব্য সমাধান ও সুপারিশ
১. দূষণ প্রতিরোধে সঠিক বর্জ্য ব্যবস্থাপনা : প্রথমেই আশপাশের ড্রেন, নর্দমা, শিল্পবর্জ্য হাতিরঝিলে যাওয়ার পথ বন্ধ করতে হবে। সঠিক স্যুয়ারেজ ডাইভারশন নিশ্চিত করতে হবে।
২. টেকসই পরিশোধন ব্যবস্থা : হাতিরঝিলের জন্য একটি আধুনিক, কার্যকর এবং পর্যাপ্ত ক্ষমতাসম্পন্ন পানিশোধনাগার (ওয়াটার ট্রিটমেন্ট প্ল্যান্ট) স্থাপন করতে হবে।
৩. দুর্নীতি ও অনিয়মের লাগাম টানা : ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের বিলভিত্তিক অনিয়ম এবং ভুতুড়ে শ্রমিক নিয়ে নাটক বন্ধ করে প্রকৃত কর্মী দিয়ে স্বচ্ছ কার্যক্রম পরিচালনা করতে হবে। সিসিটিভি নজরদারি ও নিয়মিত গণমাধ্যমে প্রতিবেদন প্রকাশ করে।
লেখক : এমফিল গবেষক, জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়
কেকে/এএম