গালির প্রতিশোধ নিতে কিশোর খুন
নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৯:৫১ পূর্বাহ্ণ, আগস্ট ৩১, ২০১৯
২০১৮ সালের ১৮ সেপ্টেম্বর, মৌলভীবাজারের বড়লেখার মোহাম্মদপুর গ্রামের আরব আলীর টিলার ঢালে মাথা ও ডান হাত বিচ্ছিন্ন অবস্থায় পাওয়া যায় আব্দুল্লাহ হাসান নামের এক কিশোরের মরদেহ। সে সিলেটের ‘মনির আহমেদ একাডেমিতে’ নবম শ্রেণিতে পড়ত। এমন কোমলমতি শিক্ষার্থীকে কে বা কারা নৃশংসভাবে খুন করেছে আর এর পেছনের কি কারণ থাকতে পারে তার কূলকিনারা করতে পারছিলেন না তদন্তকারীরা। রহস্যের ধূম্রজালেই ঘুরপাক খাচ্ছিল পুলিশ ব্যুরো ইনভেস্টিগেশনের (পিবিআই) সদস্যরা। অবশেষে সেই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উন্মোচন হয়েছে। এ বিষয়ে মঙ্গলবার পিবিআই প্রধান পুলিশের ডিআইজি বনজ কুমার মজুমদার সোশ্যাল মিডিয়ায় একটি স্ট্যাটাস দিয়েছেন।
স্ট্যাটাসে তিনি লিখেন, প্রতিদিন আমরা কত ছোট ছোট ভুল করি। ঘাতক কি সর্বদা আমাদের আশপাশেই ঘোরে! সামান্য একটি ভুলের কারণে আব্দুল্লাহ হাসানকে তারই গাড়িচালক এরশাদ খুন করেছে। পিবিআই প্রধানের সেই স্ট্যাটাসে লিখেন, সিলেটের মনির আহমেদ একাডেমির নবম শ্রেণির ছাত্র আব্দুল্লাহ হাসান বয়সের তুলনায় একটু গম্ভীর। ধনাঢ্য বাবার সন্তান হলেও হিসাব করে খরচ করে। স্কুলের ছুটিতে এসে গ্রামের বন্ধুদের সঙ্গে খেলাধুলায় সময় কাটায়। সেদিন সন্ধ্যায়ও সে মার কাছ থেকে কর্ক কেনার টাকা নিয়ে ৩০০ গজ দূরের বাজারে যায় ব্যাডমিন্টন খেলতে। সেখান থেকে বাসায় হাসান আর বাড়ি ফেরেনি। চার দিন পর গ্রামেরই আরব আলীর টিলার ঢালে মাথা ও ডান হাত বিচ্ছিন্ন তার মৃতদেহ পাওয়া যায়। তার মৃত্যু গ্রামবাসীকে স্তম্ভিত করে দেয়। প্রযুক্তিতে ভর করা তদন্ত আর টিলার ঢাল অবধি পৌঁছায় না। সন্দেহের খোলা মাঠে পিবিআই ঘুরপাক খায় এদিক থেকে ওদিকে।
ছয় মাস চলে গেলে সাক্ষ্য প্রমাণ ক্রমান্বয়ে নাগালের বাইরে চলে গেলে চাকরি ছেড়ে দেওয়া ড্রাইভার এরশাদকে ডাকে পিবিআই। এরশাদের বাড়ি ভোলার শশীভূষণের চরমাইয়া গ্রামে। চাকরি সূত্রেই বিয়ে করেছিল হাসানদের বাড়ির কাছে। পরিবার নিয়ে থাকত হাসানদের তিনতলা ভবনের দুটি কক্ষে বিনা ভাড়ায়। তদন্ত টিম হতাশ হয়। কিন্তু পিবিআই তদন্ত দল তার ওপর নজরদারি রাখে। ড্রাইভারের গত তিন মাসের মধ্যে দৈনন্দিন অভ্যাস, বেশভূষা ও ধর্ম কর্ম দেখে খটকা লাগে তদন্ত কর্মকর্তাদের। তারপর আবারও তাকে জিজ্ঞাসাবাদে নিয়ে আসলে অবশেষে ড্রাইভার এরশাদ আদালতে স্বীকার করে হাসানকে সেই হত্যা করেছিল সামান্য অপমান ও কয়েকটি চড়ের প্রতিশোধ নিতে। স্কুলের যাওয়ার পথে চন্দনপুর বাজারে গাড়ি ঘুরানোর সময় হাসানের পায়ে একটু ব্যথা পাওয়ায় ড্রাইভার এরশাদকে স্থানীয় ভাষায় নোয়াখাইল্যা ও ব্যাংগালি বলে গালি ও কয়েকটি চড় মেরেছিল। এরই প্রতিশোধ নিতে পাঁচ বছর আগের কেনা একটি খাসিয়া-দা গোপনে ধার দিয়ে প্রতিদিন সন্ধ্যায় কোমরে গুঁজে রাখত। ঘটনার দিন সন্ধ্যায় হাসানকে টিলায় নিয়ে চন্দনপুরের ঘটনাটা উঠালে হাসান বলেছিল, ‘চাচা এগুলো মনে রাখতে হয় না-কি! ছোট মানুষ ভুল করে ফেলেছি, আপনি কথাটা আর ওঠাননি বলে মাফ চাওয়াও হয়নি।’ হাসানের কথা শেষ করার আগেই এরশাদ তার ধারালো খাসিয়া ‘দা’ দিয়ে হাতে ও মাথায় কোপ মেরে পাহাড়ের ঢালে ফেলে দেয়। তারপর সব নিস্তেজ। সেদিন খুনি এরশাদ হাসানদের বাড়ি এসে ঘুমিয়েছিল।
পিবিআই প্রধান সর্বশেষ স্ট্যাটাসে লিখেন, ‘নিহত কিশোর হাসানের জন্য কষ্ট হয়। সে মাকে বলে মাঠে খেলতে গিয়েছিল। খেলাধুলার পোশাক পরেই সে মৃত্যুকে আলিঙ্গন করল ছোট্ট একটি ভুলের খেসারত হিসেবে। প্রতিদিন আমরা কত ছোট ছোট ভুল করি- ঘাতক কি সর্বদা আমাদের আশপাশেই ঘোরে!’