ঢাকা, সোমবার, ২০ মে ২০২৪ | ৬ জ্যৈষ্ঠ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন, নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ

ডেস্ক রিপোর্ট
🕐 ১:৪০ অপরাহ্ণ, মে ২১, ২০২২

বন্যায় বিপর্যস্ত জনজীবন, নেই পর্যাপ্ত ত্রাণ

সুনামগঞ্জে বন্যা পরিস্থিতি অপরিবর্তিত। নিম্নাঞ্চলে বাড়ছে পানির চাপ। খাবার, বিশুদ্ধ পানি আর স্যানিটেশনের অভাবে মানবেতর জীবন কাটছে জেলার সদর, বিশ্বম্ভরপুর, দোয়ারাবাজার, ছাতক, তাহিরপুর, ধর্মাপাশা উপজেলার লাখো মানুষের। নদীর তীর রক্ষাবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। অপরদিকে, সিলেটের বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীর রক্ষাবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করছে ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি। বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও এখনো অনেক জায়গায় কোনো ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। প্রতিনিধিদের পাঠানো প্রতিবেদনে

চোখের জল আর বানের পানিতে একাকার : উজান থেকে আসা পানি জেলার দক্ষিণ সুনামগঞ্জ, জগন্নাথপুর, দিরাই, শাল্লা, জামালগঞ্জ উপজেলার নতুন নতুন এলাকা প্লাবিত হচ্ছে। এসব এলাকার ঘরবাড়ি, রাস্তাঘাট, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, মসজিদ, মন্দির, কবরস্থান, শ্মশানসহ সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন স্থাপনা তলিয়ের যাওয়ার সংবাদ পাওয়া গেছে।

গতকাল শুক্রবার দিনে সুরমা নদীর পানি কিছুটা কমতে শুরু করলেও উজানে বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকায় বন্যার স্থায়িত্ব বাড়ার শঙ্কা করছে পানি উন্নয়ন বোর্ড। এদিকে টানা সময় ধরে পানিবন্দি অবস্থায় থাকায় বন্যাকবলিত অনেকের বাড়িতে ডুবে গেছে রান্নাঘর, বাথরুম, টিউবওয়েলসহ থাকার জায়গা। এসব এলাকায় তীব্র খাবার, বিশুদ্ধ পানির সংকট দেখা দিয়েছে। উপায় না পেয়ে পানির মধ্যেই প্রাকৃতিক কাজ সারছেন অনেকেই।

এতে চরম স্বাস্থ্যঝুঁকিতে বন্যাকবলিত পরিবারের শিশু ও বয়স্করা। বন্যার্ত এলাকায় ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছে দেওয়ার কথা বলা হলেও এখনো অনেক জায়গায় কোনো ত্রাণ সহযোগিতা পৌঁছেনি বলে অভিযোগ। তাই শুকনো খাবার বা কোনো সময় না খেয়ে সময় পার করতে হচ্ছে বানবাসীদের।

সুনামগঞ্জ পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ডের পশ্চিম তেঘরিয়ার বাসিন্দা স্বপ্না বেগম বলেন, ঘরে চারদিন হলো পানি। আশপাশে আশ্রয়ের কোনো জায়গা না থাকায় নিরুপায় হয়ে খাটের উপরে নির্ঘুম রাত কাটছে। চুলা ডুবে গেছে। স্বামী কাজ করতে না পারায় খাবারও কিনতেও পারছি না। এখনো কেউ খবর নেননি। আমাদের মতো গরিবের চোখের জল দেখার কেউ নেই।

আছিয়া বেগম নামের আরেক বন্যার্ত নারী বলেন, ঘরে তিনটি ছোট ছোট ছেলেমেয়ে। স্বামী নেই। মানুষের বাড়িতে কাজ করে খাই। বন্যার কারণে কাজে যেতে পারিনি। ঘরে হাঁটুর উপরে পানি। টেবিলের উপরে অস্থায়ী চুলায় একবেলা রান্না করি। বাথরুম ডুবে গেছে। মহাবিপদে আছি। এভাবে পানি বাড়তে থাকলে ঘর ছেড়ে স্কুলে উঠতে হবে। তিনি বলেন, সরকার এতো সাহায্য দেয় যা আমাদের ভাগ্যে জুটে না।
এদিকে সদর উপজেলা পরিষদের উদ্যোগে উপজেলার সুরমা ইউনিয়নে ত্রাণ বিতরণ করা হয়। ত্রাণ নিতে বিভিন্ন গ্রাম থেকে ছুটে আসেন শত শত মানুষ। পর্যাপ্ত ত্রাণের অভাবে অনেকেই ফিরে গেছেন কোনো ধরনের সহযোগিতা ছাড়াই।

জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, বন্যার্ত এলাকায় পর্যাপ্ত ত্রাণ সহযোগিতা ও নগদ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। বন্যার্তদের জন্য আশ্রয়কেন্দ্র খোলা হয়েছে। ঝুঁকি এড়াতে আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে বানবাসীদের পরামর্শ দিয়েছেন জেলা প্রশাসক জাহাঙ্গীর হোসেন।
অপরদিকে, নদীর তীর রক্ষাবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করছে পানি। সিলেটের বরাক, সুরমা ও কুশিয়ারা নদীর তীর রক্ষাবাঁধ ভেঙে লোকালয়ে প্রবেশ করছে ভারতীয় পাহাড়ি ঢলের পানি। এতে জকিগঞ্জ উপজেলার বিভিন্ন এলাকা প্লাবিত হয়েছে। গত বৃহস্পতিবার রাত সাড়ে ১২টার দিকে বাঁধ ভেঙে ভারতের বরাক নদী থেকে পানি প্রবেশ করায় রাস্তাঘাট ও ফসলি জমি তলিয়ে গেছে।

উপজেলার অমলশিদ, পল্লিকান্দি, বারঠাকুরী, শরিফগঞ্জ, খাসিরচক, সোনাসারসহ বেশ কিছু এলাকা পানিতে তলিয়ে যায়। একই সঙ্গে উপজেলা সদরের সঙ্গে অমলশিদ যাতায়াতের রাস্তাটিও পানিতে ডুবে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। ফলে সকাল থেকে এ রাস্তায় যান চলাচল বন্ধ রয়েছে।

জকিগঞ্জে পানি দ্রুত বাড়লেও সিলেট মহানগর ও জেলার অন্যান্য উপজেলায় বন্যা পরিস্থিতি উন্নতি হয়েছে। সুরমা নদীর কানাইঘাট ও সিলেট শহর পয়েন্টে যথাক্রমে দশমিক ২০ সেন্টিমিটার ও দশমিক ১২ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। এর ফলে সিলেট নগরে প্রায় ৭-৮ ইঞ্চি পানি কমেছে। তবে বিদ্যুৎ, বিশুদ্ধ পানি ও খাবার সংকটে আছেন লাখ লাখ মানুষ।

পানি উন্নয়ন বোর্ড সিলেটের নির্বাহী প্রকৌশলী আসিফ আহমেদ বলেন, শুক্রবার দুপুর ১২টায় পানির স্তর পরিমাপে দেখা গেছে গত ২৪ ঘণ্টার তুলনায় সিলেটের প্রধান নদী সুরমা সিলেট সদর পয়েন্টে দশমিক ১২ সেন্টিমিটার পানি কমেছে। এখনো তা বিপৎসীমার ১১ দশমিক ১৫ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গতকাল বৃহস্পতিবার দুপুরে যা ছিল বিপৎসীমার ১১ দশমিক ২৭ সেন্টিমিটার।

এছাড়া কানাইঘাট (সিলেট) পয়েন্টে দশমিক ২০ সেন্টিমিটার কমেছে। তবে এখনো তা বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ৭০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। গত বৃহস্পতিবার দুপুরে এ পয়েন্টে বিপৎসীমার ১৩ দশমিক ৯০ সেন্টিমিটার ওপর দিয়ে প্রবাহিত হয়েছিল। নগরের শামিমাবাদ এলাকার বাসিন্দা আহমদ জামিল জানান, সিলেটে বৃহস্পতিবারের তুলনায় কিছুটা পানি কমলেও এখনো বাসাবাড়িতে পানি রয়েছে।

অমলশিদ গ্রামের বাসিন্দা শামীম জানান, পানির চাপে বাঁধের অন্তত ২০-৩০ ফুট অংশ ভেঙে যায়। শুক্রবার সকালে আরও ৫০ ফুট ভেঙে গেছে। এ অবস্থায় সরাসরি বরাক নদী থেকে আসা পানি সুরমা-কুশিয়ারায় প্রবাহিত হওয়ার পাশাপাশি অমলশিদ এলাকার লোকালয়ে কছে।
বারোঠাকুরী ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান মহসীন মর্তুজা বলেন, বাঁধ ভাঙার খবর এলাকায় প্রচার করেছি। সবাইকে সর্তক থাকার জন্য মসজিদের মাইকে বলা হচ্ছে। বেশির ভাগ মসজিদ মাদরাসায় পানি ঢুকে পড়েছে। এ অবস্থায় সরকারি ত্রাণ সহায়তা বাড়ানো দরকার নইলে ভানবাসী মানুষ চরম দুর্ভোগে পড়বেন।

জকিগঞ্জের ভারপ্রাপ্ত উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) পল্লব হোম দাস বলেন, বরাক নদীর পানি সবচেয়ে বেশি প্রবাহিত হয় কুশিয়ারা দিয়ে। সুরমা-কুশিয়ারার উৎপত্তিস্থলে বাঁধের অন্তত ৩০ ফুট ভেঙে গেছে। ফলে বরাক থেকে আসা ঢল দুই নদী দিয়ে প্রবাহিত হওয়ার পাশাপাশি সরাসরি জকিগঞ্জের লোকালয়ে প্রবেশ করছে।

দিরাইয়ে বন্যায় ডুবেছে ঘরবাড়ি, ভেঙেছে রাস্তাঘাট : উজান থেকে নেমে আসা পানির ঢল আর গত কয়েক দিনের লাগাতার বৃষ্টির প্রভাবে সিলেট-সুনামগঞ্জের পর এবার দিরাইয়ে বন্যার আক্রমণ চলছে। গত বৃহস্পতিবার থেকে হঠাৎ পানি বেড়ে বিভিন্ন ইউনিয়নের এ পর্যন্ত প্রায় পাঁচ শতাধিক বাড়ি ও পানির তোড়ে রাস্তাঘাট ভেঙে যাওয়ার খবর পাওয়া গেছে। এছাড়া মাছের খামারের পাড় ডুবে যাওয়ায় চাষীরা জাল দিয়ে মাছ রক্ষার সর্বশেষ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন বলেও খবর পাওয়া গেছে।

দিরাই উপজেলা মৎস্য অফিসার শরীফুল আলম জানান, এখন পর্যন্ত কোন পুকুর তলিয়ে যায়নি, তবে অনেক পুকুরের পাড় ডুবে গেছে। সেগুলোর মাছ রক্ষার্থে চাষিরা সর্বশেষ জাল দিয়ে বেড়া দিচ্ছেন।

দিরাই উপজেলার জগদল ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হুমায়ুন রশিদ লাভলু জানান, হঠাৎ বন্যার আক্রমণে ইউনিয়নের মানুষ দিশেহারা। পুরো ইউনিয়নের শতাধিক পারিবার পানির নিচে রয়েছে বলেও তিনি জানান।

কুলঞ্জ ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান একরার হোসেন একরাম জানান, দিরাইয়ে বন্যার পানি হঠাৎ চলে আসায় মানুষের মধ্যে আতঙ্ক বিরাজ করছে। বিশেষ করে হাতিয়া-নাচনীর পুরাতন সড়কটি তলিয়ে গিয়ে একেবারে ভেঙে গেছে। তাছাড়া টংগর গ্রামে নতুন একটি সড়ক, তারাপাশা গ্রাম থেকে বাজারে আসার সড়কটি পুরো ভেঙে গেছে। পানির তলে শতাধিক বাড়ি রয়েছে বলেও তিনি জানান।

 
Electronic Paper