ঢাকা, শুক্রবার, ১৯ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুই দেশের এক মসজিদ

আব্দুল কুদ্দুস চঞ্চল, নাগেশ্বরী, কুড়িগ্রাম
🕐 ১২:১৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২৩, ২০২০

কুড়িগ্রামের বাংলাদেশ-ভারত সীমান্ত। তারই শূন্য রেখার কাছে বাংলাদেশ অংশে ২০০ বছরের ঐতিহ্য ধরে রেখেছে একটি মসজিদ। যে মসজিদ দুই দেশের দুই গ্রামের মানুষকে বেঁধে রেখেছে সম্প্রীতিতে। এই মসজিদের আজান টেনে আনে দুই দেশের মুসল্লিদের। প্রতি জুম্মায় মিষ্টি মুখ করান একে অপরের। তাদের সম্প্রীতিতে কখনো বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি সীমান্তরক্ষাকারী বাহিনীও। মসজিদটির নাম ভারতীয় গ্রামের নামেই, ‘ঝাকুয়াটারী সীমান্ত জামে মসজিদ’। উত্তরে তার ভারতের কোচবিহার এবং দক্ষিণে বাংলাদেশের কুড়িগ্রাম। এ যেন দুই দেশের এক মসজিদ, এ যেন সম্প্রীতির প্রতীক- এমনটাই মনে করেন কুড়িগ্রামের ভুরুঙ্গামারী উপজেলার বাঁশজানি গ্রামবাসী। ঐতিহ্যবাহী সীমান্ত মসজিদটি দেখতে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে ছুটে আসেন দর্শনার্থীরা।

জানা যায়, ১৯৪৭-এ দেশভাগের পর মসজিদের গ্রামটি ভাগ হয়ে যায়। বাংলাদেশ অংশের নাম হয় বাঁশজানি, আর ভারতীয় অংশের নাম হয় ঝাকুয়াটারী। কিন্তু গ্রাম ভাগ হলেও ভাগ হয়নি দুই এলাকার মানুষের মধ্যকার টান। এলাকাবাসী জানায়, সীমান্তের এই জামে মসজিদটি দুই দেশের মানুষকে আজো একটি সমাজে আবদ্ধ রেখেছে। বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তের আন্তর্জাতিক ৯৭৮ নম্বর মেইন পিলারের সাব-পিলারের পাশে মসজিদটি অবস্থিত। ভিন্ন সংকৃতির ভিন্ন দেশ হওয়া সত্ত্বেও একই মসজিদে নামাজ পড়েন তারা।

মসজিদের মুয়াজ্জিন নজরুল মিয়া (৬২) বলেন, আজানের সঙ্গে সঙ্গে দুই বাংলার মুসল্লিরা ছুটে আসেন মসজিদে। একসঙ্গে আদায় করেন নামাজ। একাকার হয়ে যান একে অপরের প্রীতি-ভালোবাসায়। মসজিদ থেকে বেরিয়ে কোলাকুলি করেন দুই বাংলার মানুষ। নিজেদের মধ্যে বিনিময় করেন কুশলাদি।

বাঁশজানি গ্রামের জাহাঙ্গীর আলম (৩২) জানান, ঐতিহ্যবাহী সীমান্ত মসজিদটি দেখতে বাংলাদেশ ও ভারতের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শনার্থীরাও আসেন। তবে অবকাঠামগত জীর্ণতায় অনেকে হতাশ হন।’

ভারতের ঝাকুয়াটারী গ্রাম থেকে আসা মুসল্লি খয়বর আলী (৭৯) বলেন, ‘দুইশ বছরের ঐতিহ্যবাহী মসজিদ হওয়া সত্ত্বেও হয়নি অবকাঠামোগত উন্নতি। সীমান্তে অবকাঠামো নির্মাণে আন্তর্জাতিক আইনি জটিলতা থাকায় এটি সম্ভবও হচ্ছে না।’ দুই বাংলার মানুষেরা যৌথভাবে আর্থিক সহায়তা দিয়ে মেরামত করে থাকেন বলেও তিনি জানান।

মসজিদের ইমাম বাঁশজানি গ্রামের বাসিন্দা আবু বক্কর সিদ্দিক (৪৫) বলেন, ‘প্রতি শুক্রবার জুমার নামাজের দিন সীমান্তে এই মসজিদটি আরও বেশি প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে। বাংলাদেশ ও ভারতের মুসল্লিরা পাতিল-বালতি ভরে নিয়ে আসেন তবারক (খাদ্য)। নামাজ শেষে সে-সব বিতরণ করা হয়।’

ভারতের ঝাকুয়াটারী গ্রামের আহমেদ আলী (৬৭) জানান, ভারতের ঝাকুয়াটারী গ্রামে ৪৫টি পরিবারের আড়াইশ মানুষের বাস। সীমান্তের এপারের মানুষের সঙ্গে তাদের রয়েছে আত্মীয়তার বন্ধন। তাদের মধ্যে কোনো দিনই ঘটেনি কোনো ঝগড়া বিবাদ ও জটিলতা। মসজিদটির সম্পাদক বাংলাদেশের অংশের বাসিন্দা কফিলুর রহমান জানান, পূর্বপুরুষ থেকে এই একটি সমাজে আমাদের বসবাস। দেশভাগ হলেও আমাদের সমাজ এবং মসজিদ ভাগ হয়নি। দুই দেশের আইনি জটিলতা আমাদের ওপর প্রভাব পড়েনি।

মসজিদটি দর্শন এবং নামাজ পড়তে আসা বিশিষ্ট নাট্য নির্মাতা ও সমাজকর্মী শাহজাহান শোহাগ, সমাজকর্মী ও তিস্তা গ্লোবাল লজিস্টিক লিমিটেডের ব্যবস্থাপনা পরিচালক ফখরুজ্জামান জেট জানান, এই মসজিদটিতে দুই দেশের মানুষের সঙ্গে নামাজ পড়ে অত্যন্ত ভালো লেগেছে। তাদের সহাবস্থান দেখে অনেক কিছু শেখার আছে। তবে মসজিদটির জীর্ণ অবস্থা আমাদের মর্মাহত করেছে। এমন ঐতিহ্যবাহী মসজিদটি মেরামত ও রক্ষা করার দাবি জানান তারা।

ভূরুঙ্গামারী উপজেলার পাথরডুবি ইউনিয়নের চেয়ারম্যান হুমায়ুন কবীর মিঠু বলেন, এই সীমান্তের উভয় বাংলায় বসবাসকারীরা একে অপরের আত্মীয়। দেশ বিভাগের সময় তারা রাষ্ট্রীয়ভাবে ভাগ হলেও আত্মীয়তার বন্ধন থেকে ভাগ হয়নি। কেউ মারা গেলে তারা উভয়ে জানাজায় অংশগ্রহণ করেন। কোনো দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীও তাদের শান্তিপূর্র্ণ বসবাসে বাধা হয়ে দাঁড়ায়নি কখনো।

 
Electronic Paper