ঘরে ঘরে জ্বর-সর্দি নতুন আতঙ্ক
মাজহার মুনতাসসির
🕐 ৬:২৪ অপরাহ্ণ, সেপ্টেম্বর ২২, ২০২০
করোনা। সার্স গ্রুপের নতুন একটি ভাইরাস। বর্তমান সময়ে পুরো বিশ্বের কাছে মূর্তমান এক আতঙ্ক। করোনার সাধারণ উপসর্গের মধ্যে অন্যতম হলো জ্বর-সর্দি-কাশি। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে বুকে ব্যথা, শ্বাসকষ্ট, পাতলা পায়খানা। এই উপসর্গগুলো দীর্ঘস্থায়ী হলে সেক্ষেত্রে নমুনা পরীক্ষা করে দেখা গেছে করোনা হয়েছে। তবে সবার যে করোনা হয়েছে এমনটা নয়।
বাংলাদেশে গত ৮ মার্চ প্রথম করোনা রোগীর সন্ধান মেলে। সোমবার পর্যন্ত করোনায় প্রাণ হারিয়েছেন চার হাজার ৯৭৯ জন, আক্রান্ত হয়েছেন তিন লাখ ৫০ হাজার ৬২১ আর সুস্থ হয়েছেন দুই লাখ ৫৮ হাজার ৭১৭ জন। করোনার এ সময়ে অনেক দেশেই সংক্রমণ কমে আসছে আর যারা আক্রান্ত হয়েছেন তারাও সুস্থ হচ্ছেন। বাংলাদেশেও কোরবানির ঈদের পর থেকে সংক্রমণের সংখ্যা কমে আসছে। এরই মধ্যে ঘরে ঘরে মিলছে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগী। বলা চলে প্রায় প্রত্যেক ঘরে এমন রোগী রয়েছে। অনেকে করোনায় আক্রান্ত হয়েছেন ভেবে চিকিৎসকের শরণাপন্ন না হয়ে বাজারে প্রচলিত অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করছেন।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন আবহাওয়াগত পরিবর্তনের কারণে ঘরে ঘরে যে জ্বর-সর্দি-কাশিতে আক্রান্ত রোগীর দেখা মিলছে তা এক প্রকার সিজনাল ফ্লু। চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়া এ অবস্থায় অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করলে এতে হিতেবিপরীত হতে পারে। আর সিজনাল ফ্লুতে আক্রান্ত অবস্থায় করোনায় আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকি তুলনামূলকভাবে বেশি বলেও জানান তারা। তাই এ সময়টায় রোগীসহ সবাইকে সবচেয়ে বেশি সচেতন হওয়ার তাগিদ স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞদের।
ডেমরার রিফাত মাহমুদ শাকিল। একটি অ্যাকাউটিং, ভ্যাট-ট্যাক্স কনসাল্টেন্সি ফার্মে এক্সিকিউটিভ অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। তিনি জানান, গত কয়েক দিন আগে সর্দি-কাশি ও জ্বরে আক্রান্ত হই। দুদিন পর আমার স্ত্রী ও ২ বছরের ছেলেরও একই উপসর্গ দেখা দেয়। এতে অনেকটা ঘাবড়ে যাই আমি। কারণ যেহেতু এখনো দেশে করোনার সংক্রমণ প্রকোপ রয়েছে। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী করোনা পরীক্ষার জন্য সবাই নমুনা দিই। পরে তিনজনেরই রিপোর্ট নেগেটিভ আসে। তখন নিশ্চিত হলাম আমরা সিজনাল-ফ্লুতে আক্রান্ত।
নোয়াখালীর অনন্তপুরে থাকেন আরাফাত। কাজ করেন একটি ওয়ার্কশপে। গত কয়েক দিন ধরে খুব জ্বর আর শরীর ব্যথা অনুভব করেন। তার জ¦রের খবর শুনে আশপাশের অনেকেই আতঙ্কিত হয়ে পড়েন- আরাফাতের করোনা হয়েছে কি না। পরে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী ওষুধ সেবনের পর সুস্থ হন আরাফাত। তখন সবার মাঝে স্বস্তি আসে। তারা জানতে পারেন আরাফাতের করোনা নয় সিজনাল ফ্লু হয়েছে।
দেশের এখন ঘরে ঘরেই চলছে জ্বর, সর্দি কাশির প্রকোপ। গত দুই সপ্তাহ ধরে হঠাৎ করে এসব রোগের প্রকোপ বেড়ে যাওয়ায় দেশের বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি হাসপাতালে এ ধরনের রোগীর বাড়তি চাপ পড়েছে। অন্যদিকে করোনার উপসর্গ এবং এই ভাইরাসজনিত রোগের উপসর্গ একই হওয়ায় দুশ্চিন্তাগ্রস্ত হচ্ছেন অনেকেই।
তবে চিকিৎসকরা বলছেন, এটি ভাইরাসজনিত সিজনাল-ফ্লু এবং খুব ছোঁয়াচে। যে কারণে একই ঘরে একাধিক ব্যক্তি এ ফ্লুতে আক্রান্ত হচ্ছে। কক্সবাজার জেনারেল হাসপাতালের চিফ মেডিকিল অফিসার ডা. আব্দুল মজিদ বলেন, গত ১১ থেকে ১৫ সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হাসপাতালের বহির্বিভাগে তিনি প্রায় ১০০ রোগী দেখেছেন, যারা সবাই এই ফ্লুতে আক্রান্ত। তিনি বলেন, এখন হাসপাতালে আউটডোরে যেসব রোগী আসছে, এর সিংহভাগই জ¦র, সর্দি-কাশির রোগী। এসব রোগীর মেডিকেল চেকআপে শুধু জ্বর-কাশি ছাড়া অন্য কোনো সমস্যা পাওয়া যায়নি। অনেক ক্ষেত্রে জ্বরের সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ১০৫ ডিগ্রি পর্যন্ত হয়। তবে এই চিকিৎসক ফ্লুতে আতঙ্কিত না হয়ে এ রোগ যাতে ব্যাপকভাবে না ছড়ায় সে জন্য মুখে মাস্ক ব্যবহার, ঘন ঘন হাত ধোয়া, হাঁচি-কাশির সময় মুখে রুমাল বা কনুই ব্যবহার করা এবং চিকিৎসকের পরার্মশ নেওয়ার কথা বলেন।
এদিকে বাংলাদেশ থেকে সদ্য বিদায়ী আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন অণুজীববিজ্ঞানী এবং গণস্বাস্থ্য কেন্দ্রের অ্যান্টিবডি ও অ্যান্টিজেন কিট আবিষ্কারক দলের প্রধান ড. বিজন কুমার শীল এ বিষয়ে বলেছেন, ফ্লু ও করোনাভাইরাস- বাংলাদেশে দুটোই একসঙ্গে চলছে। করোনা হলে হাঁচি হয় না, ফ্লুয়ের হয়। করোনায় নাক দিয়ে সর্দি পড়ে না, ফ্লু হলে পড়ে। এগুলো দেখে বোঝা যায়, করোনা নাকি ফ্লু হয়েছে। তিনি বলেন, এখন সবচেয়ে বড় গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়েছে বাংলাদেশে যে, ফ্লু ও করোনাভাইরাস একই সঙ্গে চলছে। এখনকার জ্বর কী জ্বর, তা পার্থক্য করা বিশেষ প্রয়োজন। বর্ষার সময় যে ফ্লু হওয়ার কথা ছিল, সেটা হয়নি বাংলাদেশে। কিন্তু এখন হচ্ছে। জ¦র চেনা যাবে কীভাবে? ফ্লু চেনার সহজ উপায় হচ্ছে হাঁচি হবে এবং নাক দিয়ে পানির মতো সর্দি পড়বে। করোনাভাইরাসে এই দুটোর একটাও হয় না। করোনায় হাঁচিও হবে না, নাক দিয়ে পানিও পড়বে না। এগুলো হলো করোনা ও ফ্লুকে প্রাথমিকভাবে শনাক্ত করার উপায়।
এ বিষয়ে কথা হয় গোলাপবাগ বউবাজারের আল করিম জেনারেল হাসপাতালের মেডিসিন বিভাগের রেজিস্ট্রার ও ব্র্যাকের ডাক্তার নাবিল হাসান নাবিলের সঙ্গে। তিনি খোলা কাগজকে বলেন, বর্তমান সময়ে আবহাওয়ার পরিবর্তন হচ্ছে। এর সঙ্গে খাপ খাওয়াতে না পেরে অনেকে সর্দি-কাশি-জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছেন। তার উপর বলা যায় এ সময়টায় ডেঙ্গুর প্রকোপ বাড়ে। করোনাও পুরোপুরি নিয়ন্ত্রণে আসেনি। তাই যিনি সর্দি-কাশি-জ¦রে আক্রান্ত হন- তিনি জানেন না সিজনাল ফ্লু নাকি করোনা নাকি ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়েছেন। তার উচিত সঙ্গে সঙ্গে চিকিৎসকের শরণাপন্ন হওয়া। চিকিৎসকই তাকে সঠিক পরামর্শ দিতে পারবেন। নিজে নিজে ওষুধ সেবন করলে এতে হিতেবিপরীত হতে পারে। সর্বোপরি সচেতনতার বিকল্প আর কিছু নেই।