ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

দুঃসময়ে মানুষের পাশে...

চিকিৎসকদের মানবিক উদ্যোগ

মুহাম্মদ শফিকুর রহমান
🕐 ১:৪২ অপরাহ্ণ, আগস্ট ২৬, ২০২০

করোনার দহনকালে সম্মুখসারির যোদ্ধা চিকিৎসকরা। মানহীন মাস্ক, সময়মতো পিপিই না পাওয়াসহ নানা রকম সমস্যা ছিল। সব সমস্যা পেরিয়ে মানুষের সেবায় সঁপে দিয়েছেন নিজেদের। প্রাণ হারিয়েছেন কয়েকজন চিকিৎসক। তবু মানুষের চেষ্টার একটুখানি কমতি নেই। ব্যক্তি উদ্যোগ ও সমন্বিতভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ তাদের। দুজন মানবিক চিকিৎসকের মানবিক কর্মকাণ্ড নিয়ে লিখেছেন মুহাম্মদ শফিকুর রহমান

ডা. নিজাম উদ্দিন

তখন প্রায় মধ্যরাত। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের সামনে একটি নিথর দেহ পড়ে আছে। পাশেই তার স্বজনরা। মুষড়ে পড়ছেন প্রিয়জন হারানোর বেদনায়। চিকিৎসকও আছেন সেখানে। হাত পা ছেড়ে দিয়ে বসে আছেন। যেন বড় অসহায় তিনি। সক্ষমতার সবটুকু দিয়েছেন। তবুও নিয়তির কাছে পর্যদস্ত। এমনই একটি দৃশ্যপটের ছবি ভাইরাল হয়েছে। মানুষের হৃদয়ে গভীরভাবে নাড়া দিয়েছে। ছুঁয়ে গেছে ভেতরের মমতা, সহানুভূতি, ভালোবাসার কোমল জায়গা। স্থান হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স। যে চিকিৎসক বীরের মতো লড়লেন তিনি হলেন নিজাম উদ্দিন মিজান। টগবগে তরুণ। ৩৯তম বিসিএসে পাস করেছেন। এটিই তার প্রথম কর্মস্থল। গত বছরের ১৯ ডিসেম্বর তিনি হাতিয়া উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে যোগ দেন। বাড়ি নোয়াখালীর বেগমগঞ্জ উপজেলার আমানতপুর গ্রামে। ২০১৪ সালে সলিমুল্লাহ মেডিক্যাল কলেজ থেকে এমবিবিএস পাস করেন। স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে করোনা ফোকাল পারসনের দায়িত্ব তার কাঁধে। করোনার শুরু থেকেই তিনি তৎপর। করোনা রোগীর নমুনা সংগ্রহ, করোনা আক্রান্তদের বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠান লকডাউন, চিকিৎসা সেবা প্রদান। এ সব কিছুতেই নিজেকে ব্যস্ত রেখেছেন।

রোজকার মতো সেদিনই তিনি কাজ করছিলেন। বাড়ি বাড়ি গিয়ে ওষুধ দেওয়া, লকডাউন করা। এক বাড়িতে গিয়ে একজন শ্বাসকষ্টের রোগীর দেখা পেলেন। অক্সিজেনের মাত্রা তার মাত্র ৩৫ শতাংশ। হাসপাতাল থেকে অক্সিজেন সিলিন্ডার আনলেন। সিলিন্ডার লাগিয়ে যখন তিনি ফিরলেন তখন রাত এগারটা। এরই মধ্যে খবর পেলেন, স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের নিচে একজন রোগী আসছে। ছুটে গেলেন নিজাম উদ্দিন। রোগীকে সিপিআর দেওয়া শুরু করলেন। নিজাম উদ্দিন এ বিষয়ে বলেন, রোগীকে মাটিতে শুইয়ে সিপিআর দেওয়া শুরু করলাম। এই সিপিআর দেওয়া যে কত কষ্টের এইটা একমাত্র যে দিয়েছে সে জানে। আর কেউ জানবে না। একটা সময় রোগীর পালস পেলাম। তখনও সিপিআর দেওয়া চালাচ্ছি। এই কাজে আমাকে সাহায্য করছে রোগীর ছেলেটা। অনেকক্ষণ সিপিআর দেওয়ার পর আমি আর শক্তি পাচ্ছিলাম না সিপিআর দেওয়ার। পিপিই পরেছিলাম সেই বিকাল থেকে। তারপর এন৯৫ মাস্ক পরে শ্বাসও নিতে পারছিলাম না ভালোভাবে। পরে খেয়াল করলাম, রোগীর পালস আর নাই। চোখ স্থির হয়ে গেল, রোগী তার শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করে ফেলেছে। আমি হতভম্ব হয়ে বসে পড়লাম রোগীর পাশে। চোখের সামনে লোকটা মরে গেল। এই তো একটু আগেই তো হেঁটেই নাকি আসছিল হাসপাতালে।

ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী

করোনাভাইরাসে আক্রান্ত নন। অন্য সব রোগের রোগী যারা। করোনাকালে তারা দুর্ভোগে পড়েছে সবচেয়ে বেশি। অনেক হাসপাতালে চিকিৎসা সেবা বন্ধ করে দিয়েছে। কোভিড নেগেটিভ না হলে রোগী ভর্তি নেওয়া হচ্ছে না। চিকিৎসা ব্যবস্থার নড়বড়ে অবস্থা। এই সময়ে এগিয়ে এসেছেন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) অর্থোডন্টিস্ট বিভাগের আবাসিক সার্জন ডা. ফারিয়া তাবাসসুম তন্বী। নিজ থেকেই তিনি আইডিয়া জেনারেট করলেন। সাহায্য চাইলেন বন্ধু চিকিৎসকদের। তারাও এগিয়ে এলেন। চালু হল করোনাভাইরাসে আক্রান্ত এবং অন্য রোগীদের চিকিৎসা সেবা। চিকিৎসা না পেয়ে কেউ যেন ফেরত না যায়। সে ব্যবস্থাই করলেন ডা. তন্বী ও ‘ফিমেল ডেন্টাল সার্জন অব বাংলাদেশ’-এর উদ্যমী তরুণ চিকিৎসকরা। তন্বী প্রথমে ৫০ জন ফিমেল ডেন্টাল সার্জন নিয়ে একটি ফ্রি মেডিক্যাল টিম গঠন করেন। এরপরে যোগ দেন বিভিন্ন বিশেষজ্ঞ এবং করোনা ডেডিকেটেড চিকিৎসক। তিনি এ টিমের সদস্যদের মোবাইল ফোন নম্বর সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যেন যে কেউ কল করে চিকিৎসা নিতে পারে।

ডা. তন্বী বলেন, ‘শুরুটা হয়েছিল ফলস নেগেটিভ রিপোর্টের কারণে। করোনাভাইরাস রিপোর্ট নেগেটিভ বলে আমাদের ফিমেল ডেন্টাল সার্জন শুভেচ্ছার বাবার (৬৫) নিঃশ্বাসে কষ্ট হওয়া সত্ত্বেও তাকে ভর্তি করছিল না করোনা ডেডিকেটেড কোনো হাসপাতাল। তিনদিন বিভিন্ন হাসপাতালে ঘুরে ঘুরে তিনি মৃত্যুর দিকে এগিয়ে যাচ্ছিলেন। আক্রান্ত হওয়ার লক্ষণ ছিল বলে অন্য হাসপাতালও ভর্তি করছিল না। তখন কী করব ভেবে পাচ্ছিলাম না। অনলাইনে অক্সিজেনের খোঁজ পেলাম।
পালস অক্সিমিটার কিনলাম। বাসায় রেখেই ইমারজেন্সি চিকিৎসা শুরু করলাম। অনেকটা চ্যালেঞ্জ হিসেবেই নিলাম আমি আর ডা. শুভেচ্ছা। রাত জেগে ফোনেই চিকিৎসা দিতাম। আমাদের সঙ্গে অনকলে থাকতেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা। এভাবেই একজন-দু’জন করে বর্তমানে ১০০ করোনা রোগী ছাড়িয়েছে, যাদের বেশিরভাগের বয়স পঞ্চাশের বেশি।’

তিনি আরও বলেন, যারা হাসপাতালে ইমারজেন্সি চিকিৎসা পাচ্ছেন না, তাদের জন্য আমরা বাংলাদেশ ফিমেল ডেন্টাল সার্জনের (এফডিএসবি) উদ্যোগে বিশেষজ্ঞ ডাক্তারদের সমন্বয়ে গঠন করেছি ইমারজেন্সি কোভিড-১৯ ম্যানেজমেন্ট টিম। বাড়িতেই চিকিৎসা দিয়ে ইমারজেন্সি রোগীদের অধিকাংশ সুস্থ করা সম্ভব। অসংখ্য রোগীর চিকিৎসা থেকে ধারণা করছি ঘরে বসে চিকিৎসা নিলেই ১৪ দিনে সুস্থ হয়ে যাবেন ইনশাআল্লাহ।

এটি খুব জটিল রোগ নয়। বয়স্ক ও আগে থেকেই অন্য রোগে আক্রান্তরাও বেঁচে যাচ্ছেন। প্রথম থেকেই চিকিৎসা দিলে অধিকাংশ মানুষের জীবন বেঁচে যাবে। আমাদের মৃত্যু সংখ্যা এখন পর্যন্ত শূন্য। কারণ আমরা আগে থেকে বাড়িতেই অক্সিজেন দিয়ে রোগী কিছুটা স্বাভাবিক হলে হাসপাতালে যেতে বলি। আসলে বাড়িতে অক্সিজেনের ব্যবস্থা করলে পরে আর হাসপাতালে যাওয়ার প্রয়োজন হয় না।

ডা. তন্বী বলেন, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত রোগীদের মধ্যে যারা তরুণ তাদের ফ্রি চিকিৎসা দেওয়ার বিনিময়ে আমরা তাদের প্লাজমা ডোনেট করতে উৎসাহ দিচ্ছি। আর যারা সচ্ছল তাদের বলেছি, কোনো অভাবি পরিবারের চিকিৎসার খরচ যেন সম্ভব হলে তারা বহন করেন। অভাবি পরিবারগুলোর নম্বর সচ্ছলদের দেওয়া হচ্ছে। তারা চাইলে তাদের মতো করে অভাবি রোগীদের সাহায্য করবেন। ফিমেল ডেন্টাল সার্জনদের আমাদের এ গ্রুপ টিম ওয়ার্কের মাধ্যমে কাজ করছি। আমার সঙ্গে সারা রাত জেগে ফিমেল ডেন্টাল সার্জনরা কাজ করেছেন, তাদের মধ্যে উল্লেখযোগ্য ডা. শাম্মা, ডা. পুণ্য, ডা. মিশি ও ডা. শুভেচ্ছা।

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ

Electronic Paper