ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ২৫ এপ্রিল ২০২৪ | ১১ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

কবি হেনরীর পর ইমতিয়াজও গ্রেফতার

ডিজিটাল আইন নিয়ে উদ্বেগ

শাহবাগে প্রতিবাদ সমাবেশ

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ১০:৫৩ অপরাহ্ণ, মে ১৫, ২০১৯

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন-২০১৮’র প্রয়োগ নিয়ে উদ্বেগ ছড়িয়ে পড়ছে। এই আইনে করা মামলায় গত মঙ্গলবার বরিশাল থেকে কবি হেনরী স্বপনকে গ্রেফতারের একদিন পর গতকাল বুধবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০১৩ সালে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) আইনে বিতর্কিত ৫৭ ধারা যুক্ত হওয়ার পর গত কয়েক বছর ধরে এই আইনে নাগরিকদের গ্রেফতার ও হয়রানির অভিযোগ তুলে ধারাটি বাতিলের জন্য আন্দোলন করে আসছিলেন গণমাধ্যম ও মানবাধিকার-কর্মীরা। সেই পরিপ্রেক্ষিতে সরকার ধারাটি বাতিল করে সাইবার অপরাধ দমনে নতুন এই ‘ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন’ প্রণয়ন করে। কিন্তু গত ১৯ সেপ্টেম্বর জাতীয় সংসদে ডিজিটাল নিরাপত্তা বিল পাসের পর দেখা যায় সেখানে চারটি ধারায় ঘুরিয়ে ফিরিয়ে বিতর্কিত ৫৭ ধারাটিকে প্রতিস্থাপন করা হয়েছে। মানবাধিকার কর্মীরা বলছেন, ‘এটি আসলে আইসিটি আইনের ৫৭ ধারারই অন্যরূপ। কবি হেনরী স্বপনের পর ইমতিয়াজ মাহমুদের গ্রেফতার- দুটোই মত প্রকাশের স্বাধীনতায় হস্তক্ষেপের সামিল।’

কেন উদ্বেগ বাড়ছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন নিয়ে? বিশেষজ্ঞরা বলছেন, আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় যা ছিল, কিছু শব্দ অদল-বদল করে তাই নিয়ে আসা হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫, ২৮, ২৯ ও ৩১ ধারায়। ধারাগুলোতে ডিজিটাল মাধ্যমে ব্যক্তি ও রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন , ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত, কারো মানহানি কিংবা বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি বা আইন-শৃঙ্খলার অবনতি ঘটানোর মতো বিষয়গুলোকে অপরাধ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। যেগুলোর শাস্তি ক্ষেত্র বিশেষে তিন থেকে সাত বছরের কারাদ-। এর আগে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় বলা হয়েছিল, ‘কোনো ব্যক্তি যদি ইচ্ছাকৃতভাবে ওয়েবসাইটে বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক বিন্যাসে এমন কিছু প্রকাশ বা সম্প্রচার করেন, যা মিথ্যা ও অশ্লীল বা সংশ্লিষ্ট অবস্থা বিবেচনায় কেউ পড়লে, দেখলে বা শুনলে নীতিভ্রষ্ট বা অসৎ হতে উদ্বুদ্ধ হতে পারেন অথবা যার দ্বারা মানহানি ঘটে, আইনশৃঙ্খলার অবনতি ঘটে বা ঘটার আশঙ্কা সৃষ্টি হয়, রাষ্ট্র ও ব্যক্তির ভাবমূর্তি ক্ষুন্ন হয় বা ধর্মীয় অনুভূতিতে আঘাত করে বা করতে পারে বা এ ধরনের তথ্যাদির মাধ্যমে কোনো ব্যক্তি বা সংগঠনের বিরুদ্ধে উসকানি প্রদান করা হয়, তাহলে এ কাজ অপরাধ বলে গণ্য হবে। এই অপরাধে সর্বোচ্চ ১৪ বছর ও সর্বনিম্ন সাত বছর কারাদ- এবং সর্বোচ্চ এক কোটি টাকা অর্থদ- দেওয়া হবে।’

একটু খেয়াল করলেই দেখা যাবে, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত বিধানগুলো সামান্য ঘুরিয়ে বসিয়ে দেওয়া হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে। এ ছাড়া এই আইনের ৩২ ধারা মতে, ‘যদি কোনো ব্যক্তি বেআইনি প্রবেশের মাধ্যমে কোনো সরকারি, আধা সরকারি ও স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠানের অতি গোপনীয় বা গোপনীয় তথ্য ডিজিটাল বা ইলেকট্রনিক মাধ্যমে ধারণ, প্রেরণ ও সংরক্ষণ করেন বা সহায়তা করেন, তাহলে সর্ব্বোচ ১৪ বছরের সাজা।’

ডেইলি স্টার সম্পাদক মাহফুজ আনাম বলেন, ‘আইনে সরকারি গোপনীয়তার কথা বলা হয়েছে। প্রশ্ন হলো, সরকারি গোপনীয়তা কী? যে কোন জিনিস যেটা সরকার অফিসিয়ালি জনগণকে জানাচ্ছে না, সেটাই তো সিক্রেট থেকে যাচ্ছে। এই আইন অনুযায়ী সেটা তো জনগণের জানার অধিকার নেই। কারণ সরকার সেটা জানাচ্ছে না। কিন্তু সাংবাদিকদের তো সেটা জানাই ২৪ ঘণ্টার কাজ। এমন হলে আমি তো আর এখানে সাংবাদিকতা করতে পারব না।’

আইনটির ৪৩ ধারায় বলা হয়েছে, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী যেকোনো সময় যেকোনো মিডিয়া অফিসে ঢুকে তল্লাশি করতে পারবেন এবং যদি মনে করেন, তদন্তের স্বার্থে অফিসিয়াল সার্ভারে ঢোকা দরকার তাহলে তাও করতে পারবেন, এমনকি চাইলে অফিসিয়াল সার্ভার জব্দও করতে পারবেন। সন্দেহ হলে সেখান থেকে কাউকে আটকও করার ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে আইনে।

মাহফুজ আনাম বলেন, ‘পরোয়ানা ছাড়াই তল্লাশি, জব্দ ও গ্রেফতারের যে ক্ষমতা দেওয়া হয়েছে, তাতে চাপের মুখে পড়বেন গণমাধ্যমকর্মীরা। তা ছাড়া যদি সার্ভার জব্দ করা হয়, তাহলে অপরাধের আলামত থাকুক আর না থাকুক সার্ভার জব্দ হওয়ায় ওই দিনের প্রকাশনা বন্ধ রাখতে হবে। এমনকি এটা কয়েকদিনও বন্ধ থাকতে পারে। এমনকি সরকার কোনো খবরের কাগজ বন্ধ করার আদেশ না দিয়েও কাগজটা বন্ধ করে দিতে পারেন শুধু সার্ভারটা যদি উনারা কব্জা করে নেন।’

হেনরির পর গ্রেফতার ইমতিয়াজ

ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে কবি হেনরী স্বপনকে কারাগারে পাঠানোর একদিন পর এবার তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইনের মামলায় লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদকে গ্রেফতার করা হয়েছে। গতকাল বুধবার বেলা ১১টায় পেশাগত কাজে আদালতে যাওয়ার পথে তাকে গ্রেফতার করে বনানী থানা পুলিশ। খাগড়াছড়ি সদর থানায় ২০১৭ সালে দায়ের করা ওই মামলায় ইমতিয়াজ মাহমুদ জামিনে ছিলেন।

বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) বিএম ফরমান আলী গণমাধ্যমে বলেন, ‘আমাদের কাছে তার নামে একটি ওয়ারেন্ট এসেছিল। আমরা কেবল ওয়ারেন্ট তামিল করেছি।’ এরপর গতকাল বিকেলে ঢাকার মহানগর হাকিম সত্যব্রত শিকদারের আদালতে ইমতিয়াজকে হাজির করা হলে জামিন আবেদন নাকচ করে বিচারক তাকে কারাগারে পাঠানোর আদেশ দেন।

২০১৭ সালের ১৭ জুলাই সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সাম্প্রদায়িক উস্কানি দেওয়ার অভিযোগে শফিকুল ইসলাম নামে এক ব্যক্তি ইমতিয়াজ মাহমুদের নামে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন (২০০৬) এর ৫৭/২ ধারায় একটি মামলা দায়ের করেন। কবি, লেখক ও আইনজীবী ইমতিয়াজ মাহমুদ লেখালেখির পাশাপাশি পাহাড়ি ও সংখ্যালঘুদের অধিকার নিয়ে লেখালেখি করে থাকেন।

হেনরি স্বপনকে মুক্তি দিতে ২৪ ঘণ্টার আল্টিমেটাম

আগামী ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কবি হেনরি স্বপনকে মুক্তি দিতে সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে। ‘নিপীড়নের বিরুদ্ধে শাহবাগ’ নামক একটি সংগঠনের ব্যানারে এই আল্টিমেটাম দিয়েছেন লেখক, সাংবাদিক, ছাত্র, বুদ্ধিজীবীরা। গতকাল বুধবার রাজধানীর শাহবাগে এক মানববন্ধন থেকে এ ঘোষণা দেওয়া হয়।

প্রকাশক রবীন আহসান বলেন, হেনরি স্বপনকে মুক্তি দেওয়া না হলে শুক্রবার বিকাল ৪টা থেকে শাহবাগে আমরা অবস্থান ধর্মঘট পালন করব। আমরা সরকারকে জানিয়ে দিতে চাই, ডিজিটাল আইনে নিরপরাধ মানুষ, লেখক-শিল্পী-চলচ্চিত্রকার-কবিদের নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে।

তিনি আরও বলেন, ফেসবুকে হাজারো মানুষ বিভিন্ন ধর্মের নানা বিষয়ে কথা বললেও তাদের গ্রেফতার করা হচ্ছে না। বাছাই করে হেনরি স্বপনদের মতো কবি-সাহিত্যিকের গ্রেফতার করা হচ্ছে। তার মানে হচ্ছে, সরকার আমাদের ভয় দেখাতে চায়। আমরা সরকারকে বলব, ভয় পেতে পেতে আমরা রাস্তায় নামতে শিখেছি। যখন এই ভয় আপনারা ভেঙে দেবেন তখন পুলিশের বুলেট কামান এসব কাজে আসবে না।

চলচ্চিত্র পরিচালক আবু সাইদ বলেন, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে সম্পাদক পরিষদসহ যখন সবাই প্রতিবাদ করেছিল তখন বলা হয়েছিল আইনটি পুনর্বিবেচনা করা হবে। কিন্তু করা হয়নি। আমরা স্বাধীন দেশে বাস করি। আমাদের বাকস্বাধীনতা থাকতে হবে।

সংগঠনের সমন্বয়ক আকরামুল হকের সভাপতিত্বে বক্তব্য রাখেন কবি সাহেদ কায়েস, শ্রাবণ প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী রবিন আহসান, নাট্যকার অনন্ত হীরা, কবি সরদার ফারুক, প্রগতি লেখক সংঘের সাধারণ সম্পাদক দীপংকর গৌতম, আইনজীবী হাসান তারেক চৌধুরী সোহেল, ইন্ডিপেন্ডেট ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক আবদুল বাতেন, ছাত্র ইউনিয়নের কেন্দ্রীয় সভাপতি মেহেদী হাসান নোবেল, লেখক শওকত হোসেন, বাকি বিল্লাহ, এফএম শাহীন প্রমুখ।

 
Electronic Paper