ঢাকা, মঙ্গলবার, ২৩ এপ্রিল ২০২৪ | ১০ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

ওয়ার্কার্স পার্টি ভাঙন নিয়ে দুটো কথা

বাপ্পাদিত্য বসু
🕐 ৯:৪৪ অপরাহ্ণ, অক্টোবর ২৪, ২০১৯

যদিও আমি এখন আর ওয়ার্কার্স পার্টি করি না নেতৃত্বের প্রতি অনাস্থা ও বেশকিছু মতবিরোধের কারণে। বাংলাদেশের সামগ্রিক বাম আন্দোলন যেভাবে চলছে, তাতে আমি অদূর বা সুদূর ভবিষ্যতে আর কোনো আশাও দেখি না, তাই ওয়ার্কার্স পার্টি ছেড়ে অন্য কোনো বামপন্থী দল বা অন্য যে কোনো রাজনৈতিক দলের সঙ্গেও যুক্ত হইনি। সহসাই আমার কোনো রাজনৈতিক কর্মকাণ্ডে সম্পৃক্ত হওয়ার কোনো আকাক্সক্ষা বা সম্ভাবনাও নেই। এমনকি চলমান ভাঙন প্রক্রিয়ায় কোনো অংশের সঙ্গেই আমার কোনো সম্পৃক্ততা নেই।

তবুও যেহেতু এক সময় ওয়ার্কার্স পার্টি করতাম, ছাত্রমৈত্রীর সভাপতি ছিলাম, আর ওয়ার্কার্স পার্টি তার ইতিহাসে সবচেয়ে সংকটজনক সময় পার করছে, তাই কিছু কথা বলতে ইচ্ছে হলো। যদিও আমি জানি, এসব কথা অর্থহীন, অহেতুক, এগুলো শোনার মতো মানসিকতা ওয়ার্কার্স পার্টির চলমান ভাঙন প্রক্রিয়ায় কোনো অংশেরই নেই।

১৯৯২ সালে তিন পার্টির ঐক্যের মধ্য দিয়ে বর্তমান ওয়ার্কার্স পার্টি গঠিত হয়। তখন সভাপতি নির্বাচিত হন কমরেড অমল সেন এবং সাধারণ সম্পাদক নির্বাচিত হন কমরেড রাশেদ খান মেনন। পরের কমিটিতেও এই নেতৃত্ব ছিল। তার পরের দুইবার কমরেড রাশেদ খান মেনন সভাপতি ও কমরেড বিমল বিশ্বাস সাধারণ সম্পাদক। তার পরেরবার কমরেড রাশেদ খান মেনন সভাপতি ও কমরেড আনিসুর রহমান মল্লিক সাধারণ সম্পাদক। তার পরেরবার কমরেড রাশেদ খান সভাপতি ও কমরেড ফজলে হোসেন বাদশা সাধারণ সম্পাদক (আগামী ৫ নভেম্বর পর্যন্ত চলমান কমিটি)।

অর্থাৎ ১৯৯২ সাল থেকে এ পর্যন্ত ওয়ার্কার্স পার্টির মূল নেতৃত্বে আছেন কমরেড রাশেদ খান মেনন। তার সঙ্গে একেকবার একেকজন করে আরো চারজন। কিন্তু শুরু থেকে আজ পর্যন্ত কমরেড মেনন আছেনই।

১৯৯৫ সালে পার্টি ভাঙে। কমরেড টিপু বিশ্বাস, কমরেড আব্দুল মতিন মুনীর, কমরেড মোশাররফ হোসেন নান্নুসহ অনেকেই বেরিয়ে গেলেন। তাদের অভিযোগের বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও মূল অভিযোগের তীর ছিল কমরেড রাশেদ খান মেননের প্রতি।

২০০৪ সালে পার্টি ভাঙে। কমরেড সাইফুল হক, কমরেড খন্দকার আলী আব্বাস, কমরেড পরেশ চন্দ্র সাহা, কমরেড নাসিরউদ্দিন আহমেদ নাসু, কমরেড রাজা মিয়াসহ অনেকেই বেরিয়ে গেলেন। তাদের অভিযোগের বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও মূল অভিযোগের তীর ছিল কমরেড রাশেদ খান মেননের প্রতি।

২০০৮ সালে পার্টি ভাঙে। কমরেড হায়দার আকবর খান রনো, কমরেড আজিজুর রহমান, কমরেড আব্দুস সাত্তার, কমরেড আফসার আলী, কমরেড শাহরিয়ার ফিরোজসহ অনেকেই বেরিয়ে গেলেন। তাদের অভিযোগের বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও মূল অভিযোগের তীর ছিল কমরেড রাশেদ খান মেননের প্রতি।

এবারও পার্টি ভাঙছে। ইতোমধ্যেই কমরেড বিমল বিশ্বাস বেরিয়ে গেছেন। সম্ভাব্য আরও বেরিয়ে যাওয়ার তালিকায় আছেন পলিটব্যুরো ও কেন্দ্রীয় কমিটির আরও কয়েকজন। তাদের অভিযোগের বহু তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা থাকা সত্ত্বেও মূল অভিযোগের তীর ছিল কমরেড রাশেদ খান মেননের প্রতি। ১৯৯৪ সালে বেরিয়ে যাওয়ারা একসঙ্গে থাকতে পারেননি।

এদের মধ্যে টিপু বিশ্বাসকে বহিষ্কার করেন মোশাররফ হোসেন নান্নুরা। টিপু বিশ্বাসের বর্তমান পার্টির নাম জাতীয় গণফ্রন্ট। মোশাররফ হোসেন নান্নুদের বর্তমান পার্টির নাম ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ। মতিন মুনীর মারা গেছেন।

২০০৪ সালে বেরিয়ে যাওয়ারাও একসঙ্গে থাকতে পারেননি। এদের মধ্যে পরেশ চন্দ্র সাহা আবার বেরিয়ে এসে অন্য পার্টি করেছিলেন, ওয়ার্কার্স পার্টিতে ফেরার প্রক্রিয়ায় ছিলেন। তার আগে মারা যান। খন্দকার আলী আব্বাস মারা গেছেন। সাইফুল হক, নাসিরউদ্দিন নাসুদের বর্তমান পার্টির নাম বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি।

২০০৮ সালে বেরিয়ে যাওয়ারাও একসঙ্গে থাকতে পারেননি। এরা শুরুতে ওয়ার্কার্স পার্টি (পুনর্গঠিত) নামে দল বানালেও এদের মধ্যে হায়দার আকবর খান রনো, শাহরিয়ার ফিরোজরা যোগ দেন সিপিবিতে। আর আজিজুর রহমান, আব্দুস সাত্তাররা যোগ দেন ১৯৯৪ সালের ভাঙনওয়ালাদের মধ্যে মোশাররফ হোসেন নান্নুর ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগে।

আর বর্তমানের ভাঙনওয়ালারা কে কোথায় যাচ্ছেন, তা দেখতে আরও কিছুদিন অপেক্ষা করতে হচ্ছে।
ভাঙনওয়ালাদের কমবেশি একই অভিযোগ। পার্টি নষ্ট হয়েছে, ডানপন্থী সুবিধাবাদ, বাম বিচ্যুতি, নেতৃত্বের বিরুদ্ধে সংগঠন কুক্ষিগত করার অভিযোগ আর কার্যত রাশেদ খান মেননের বিরুদ্ধে অভিযোগ। মোটের ওপর সহজ কথায় এই। বাকিটা তাদের বিশাল বিশাল তত্ত্বকথার ব্যাপার। যা আমার মতো মাথামোটা সাবেক বাম কর্মীর বোঝার বাইরে। আর সাধারণ জনগণ তো আরও দূরের ব্যাপার।

এখন প্রশ্ন হলো-ভাঙনওয়ালাদের সবার অভিযোগ যেহেতু একই, তাহলে মূল ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে বেরিয়েও আপনারা একসঙ্গে থাকতে পারেননি কেন? কেন আবার ভাঙলেন? আর ভাঙ্গনওয়ালারা সবাই মিলে কেন একটা পার্টি বানাতে পারলেন না? তাহলে সমস্যা কি শুধু ওয়ার্কার্স পার্টির একার অথবা রাশেদ খান মেননের একার ছিল/আছে? নাকি আপনাদের প্রবণতাই স্রেফ ভাঙন? আমার মনে হয়েছে, পার্টি ভাঙা বাংলাদেশের বামপন্থীদের একটা অহেতুক রোগের নাম। তত্ত্বকথাগুলো কেবল মোড়কের ওপরে লেখা থাকে। ভিতরে থাকে পদ-পদবি আর পাওয়া-না পাওয়ার দ্বন্দ্ব। না হলে ১৯৯২ সালের এক ওয়ার্কার্স পার্টি থেকে আজ ওয়ার্কার্স পার্টি, গণফ্রন্ট, ইউনাইটেড কমিউনিস্ট লীগ, বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টি। কিছু লোক সিপিবিতে। আর নতুন ভাঙনওয়ালাদের নতুন ঠিকানা কি হয় সেটা দেখার বিষয়।

ভাঙনওয়ালাদের প্রত্যেকেই পার্টি ভেঙে বেরিয়ে গেছেন, এরপর বৃহত্তর বাম ঐক্যের কথা বলেছেন, কিন্তু কোনো দিন ঐক্য করে এক পার্টি বানাতে পারেননি, তারপর বাম গণতান্ত্রিক জোটে ও তেল-গ্যাস রক্ষা কমিটিতে শরিক দল হয়ে প্রত্যেকেই শরিক দলের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক হয়ে সমস্ট্যাটাস অর্জন করেছেন। এর বাইরে বাম ঐক্য বলতে আজ পর্যন্ত আপনারা অন্য আর কিছুই দেখাতে পারেননি। এ রোগ শুধু ওয়ার্কার্স পার্টির নয়, অন্যান্য বাম দলেরও।

এখন কয়েকটা মজার বিষয়। ২০০২-২০০৩ সালের দিকে একবার ওয়ার্কার্স পার্টি ও সিপিবির ঐক্য করার সুর উঠল। উভয় পক্ষে ঐক্যবিরোধী যেসব নেতা ছিলেন, তাদের মধ্যে প্রধান ছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। তিনি নিজেই আজ সিপিবির নেতা। ওয়ার্কার্স পার্টির নেতা থাকাকালীন ২০০৬ সালের ২২ জানুয়ারির নির্বাচনে (ওই নির্বাচন পরে অনুষ্ঠিত না হয়ে বাতিল হয়, ১/১১ আসে) ওয়ার্কার্স পার্টিকে নৌকা প্রতীক নিতে সর্বস্তরের কর্মীদের রাজি করিয়েছিলেন হায়দার আকবর খান রনো। পরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনের আগে সেই কমরেড রনোই নৌকা প্রতীক নেওয়ার বিরোধিতা করে দল ভাঙলেন। পরে তিনি গেলেন সিপিবিতে। এই সিপিবি আবার ১৯৯১ সালেই নৌকা প্রতীক নিয়ে নির্বাচন করে অভিজ্ঞতা অর্জন করে রেখেছিল।

আরেকটা মজার বিষয় হলো- বর্তমানে আওয়ামী লীগের সঙ্গে ঐক্য করার বিরোধিতার সুর তুলে সবার আগে দল ছাড়লেন কমরেড বিমল বিশ্বাস। তিনি নিজেই দলের সাধারণ সম্পাদক থাকাকালীন আওয়ামী লীগের সঙ্গে অপরাপর বাম গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল দলগুলো মিলে ১৪ দল গঠনের অন্যতম প্রধান কাণ্ডারী ছিলেন। নিজে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নৌকা প্রতীকে ভোট করেছেন, হেরে গেছেন। এমপি-মন্ত্রীদের যেসব অনাচারের অভিযোগ তিনি তুলেছেন, তিনি নিজে সেবার জিতে গিয়ে এমপি হলে এসব অনাচার কীভাবে ঠেকাতেন? একই যাত্রায় তো আর দুই ফল হতো না।

আরেকটি মজার বিষয় হলো-গত ২০১৪ সালের কংগ্রেস আর এবারের আগামী ২-৫ নভেম্বরের কংগ্রেসে দলের কেন্দ্রীয় কমিটির প্রণীত দলিলের বিপরীতে পলিটব্যুরো সদস্য কমরেড নুরুল হাসান ও কমরেড ইকবাল কবির জাহিদ ভিন্নমত উপস্থাপন করেছেন। সেই ভিন্নমতের মূল সুর হলো ১৪ দল থেকে বেরিয়ে আসা ও নৌকা প্রতীক বাদ দেওয়া।

অথচ ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে কমরেড জাহিদ একাই যশোর-৩, যশোর-৪, যশোর-৫ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছিলেন নৌকা প্রতীক ও মহাজোটের মনোনয়নের আশায়। অথচ দলের সিদ্ধান্ত ছিল যশোর-৩ আসনে মনোনয়নপত্র জমা দেবেন কমরেড আফসার আলী আর যশোর-৪ আসনে ইকবাল কবির জাহিদ। আফসার আলী সেই ক্ষোভে হায়দার আকবর খান রনোর সঙ্গে চলে গেলেন দল ছেড়ে।

সেবার মহাজোটের মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক পেলে কমরেড জাহিদ কী করতেন? ভিন্নমত কোথায় থাকত? ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনেও কমরেড জাহিদ মনোনয়ন চেয়ে পাননি। ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বরের নির্বাচনেও কমরেড জাহিদ ছিলেন ওয়ার্কার্স পার্টির শক্তপোক্ত প্রার্থী। এবারও তিনি মহাজোটের মনোনয়ন আর নৌকা প্রতীকের আশায় ছিলেন। কিন্তু মেনন-বাদশা মহাজোট নেত্রী শেখ হাসিনার কাছ থেকে তার মনোনয়ন ও নৌকা প্রতীক এনে দিতে পারেননি। এবারও যদি তিনি নৌকা পেতেন, তাহলে তার ভিন্নমতের কী হতো? তার মানে হলো আমার জন্য নৌকা পেলে নৌকা ঠিক আছে। আমি না পেলেই নৌকা হারাম।

ওয়ার্কার্স পার্টির নেতৃবৃন্দ, আর লোক হাসাবেন না। আবারও দল না ভেঙে সংগঠনের ক্ষয়ে যাওয়া ঠেকানোর পথ বের করুন। মন্ত্রী-এমপি হয়ে কি কি বদঅভ্যাসের কারণে সংগঠন ও পার্টি শেষ হয়ে গেল, সেগুলো সন্ধান করে এবারের কংগ্রেসের মধ্য দিয়ে আপনাদের যে কয়েকজন কর্মী অবশিষ্ট আছে, তা রক্ষা করে তাদের দিশা দেখাতে চেষ্টা করুন।

এক সময় আমি পার্টির ভিতরকার এসব কথা ফেসবুকে লিখতাম, তাই আমার বিরুদ্ধে শৃংখলা ভঙ্গের অভিযোগ ছিল। আ‌মি ফেসবু‌কে লিখতাম ব‌লে মেনন সা‌হে‌বের বাসায় আমা‌কে ডে‌কে নি‌য়ে কম‌রেড মেনন ও কম‌রেড বাদশা কড়া ধমক দি‌য়ে‌ছেন। মেনন সা‌হে‌বের স্টাফ‌দের প্র‌তি‌দিন সকা‌লের রু‌টিন ছি‌ল আমি ফেসবু‌কে কী লি‌খে‌ছি, তা তা‌কে রু‌টিন ক‌রে দে‌খি‌য়ে আমার বিরু‌দ্ধে তাকে খে‌পি‌য়ে তোলা।

তি‌নি খুব কানকথা শুন‌তেন, ওই স্টাফ‌দের কানকথায় তি‌নি আমার বিরু‌দ্ধে রে‌গে থাক‌তেন সব সময়। এখন দলের অভ্যন্তরীণ পত্রিকা ‘ফোরাম’-এ কমরেড বিমল বিশ্বাস কী লিখেছেন, তাও ফেসবুকে পাওয়া যায়। আমি দলের সদস্য আর নেই। তবু আমি ফোরামর সবগুলো লেখা পড়েছি।

এখন রাজশাহী জেলা, ঢাকা মহানগর, যশোর জেলার নেতারা এমনকি জেলা পর্যায়ের সাধারণ সম্পাদকরাও প্রকাশ্য ফেসবুকে একে অপরের বিরুদ্ধে লেখেন। এখন আর সাংগঠনিক শৃংখলা ভঙ্গ হয় না। কমরেড বিমল বিশ্বাস, দেবাশীষ প্রামাণিক দেবু কিংবা জিল্লুর রহমান ভিটুদের লেখায় শৃংখলা ভঙ্গ হয় না। কারণ তারা নেতা। আর আমি ছিলাম কর্মী।

বাপ্পাদিত্য বসু
সাবেক ছাত্রনেতা

 

এ বিভাগের অন্যান্য সংবাদ


Warning: Invalid argument supplied for foreach() in /home/www/kholakagojbd.com/post/details-page.php on line 228
Electronic Paper