ঢাকা, শনিবার, ২০ এপ্রিল ২০২৪ | ৬ বৈশাখ ১৪৩১

Khola Kagoj BD
Khule Dey Apnar chokh

৬৮ বছরে পূর্ণাঙ্গ ভাষা আন্দোলনের ছবি হয়নি একটিও

ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপট নিয়ে মাত্র ৩টি চলচ্চিত্র, দায় কার

নিজস্ব প্রতিবেদক
🕐 ৩:১৬ অপরাহ্ণ, ফেব্রুয়ারি ২১, ২০২০

বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনকে বলা হয়ে থাকে ১৯৭১ সালে গৌরবময় বিজয় অর্জনের মূল সূত্র। প্রথমে রাষ্ট্রভাষা বাংলা এবং পরে সার্বভৌমত্ব অর্জনের মধ্য দিয়ে আজকের মাথা উঁচু বাংলাদেশ। এর চেয়েও উল্লেখযোগ্য বিষয়– ভাষার জন্য এমন রক্তক্ষয় কিংবা আন্দোলনের নজির পৃথিবীতে আর ঘটেনি একটিও। বছর ঘুরে একুশে ফেব্রুয়ারি সেই বার্তা নিয়ে হাজির হয় বিশ্ববাসীর নজরে। কারণ দিনটি এখন আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস হিসেবে স্বীকৃত।

অথচ এমন দিনে (২১ ফেব্রুয়ারি) কিংবা ভাষার মাসকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশে মুক্তি পাচ্ছে না কোনও চলচ্চিত্র! এদিকে একুশে ফেব্রুয়ারিকে কেন্দ্র করে টিভি চ্যানেলগুলোতে প্রচার হবে হাতেগোনা কয়েকটি বিশেষ নাটক। প্রকাশের তথ্য মেলেনি নতুন কোনও গান কিংবা মিউজিক ভিডিওর। অথচ গেলো সপ্তাহে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে ঘিরে বাংলাদেশের নাটক-সিনেমা আর গানের বাজারে তৈরি হলো মল্লযুদ্ধ! যার রেশ রয়েছে এখনও। গত ১৪ ফেব্রুয়ারি শতাধিক নাটক, মিউজিক ভিডিওর সঙ্গে মুক্তির মিছিলে ছিল হাফ ডজন বাংলা সিনেমা।

বিপরীতে এবারের মহান একুশে ফেব্রুয়ারিতে দেশে মুক্তি পাচ্ছে ইংরেজি ভাষার দুটি নতুন চলচ্চিত্র। আন্তর্জাতিক মুক্তির দিনেই (২১ ফেব্রুয়ারি) ‘দ্য কল অব দ্য ওয়াইল্ড’ ও ‘ব্রামস: দ্য বয় টু’ নামে হলিউডের ছবি দুটি নিয়ে এসেছে ঢাকার স্টার সিনেপ্লেক্স। না, এ দুটি ছবির গল্প ‘ভাষা’ নিয়ে রচিত হয়নি।

বোদ্ধাদের অভিমত, ভাষার সঙ্গে সংযোগ আছে এমন ছবিগুলোকে এই দিনে (২১ ফেব্রুয়ারি) বা এই সপ্তাহে প্রেক্ষাগৃহে প্রদর্শনীর উদ্যোগ নেওয়া হলে ইতিবাচক ব্যাপার ঘটতো।

এদিকে ভাষা আন্দোলনের প্রেক্ষাপটে সবশেষ ছবি বানিয়েছেন অভিনেতা-নির্মাতা তৌকীর আহমেদ। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ নামের ছবিটি ভালোই প্রশংসা কুড়িয়ে চলছে দেশ-বিদেশের বিভিন্ন উৎসবে। এ ধরনের ছবি কম হওয়ার কারণ প্রসঙ্গে তার মন্তব্য, ‘দেশে মুক্তি দেওয়ার মতো ছবি না থাকলে তো বিদেশি ছবিই আসবে। সিনেমা হল তো ফাঁকা থাকবে না। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে ছবি নির্মাণ করা বেশ ব্যয়বহুল আর সময়সাপেক্ষ বিষয়। এ অবস্থা থেকে আমাদের উত্তরণ হওয়া প্রয়োজন। আমাদের চলচ্চিত্র শিল্পের সার্বিক অবস্থাই আসলে নাজুক।’

তৌকীর বলেন, ‘সরকারি-বেসরকারি দুটো মাধ্যমেরই চলচ্চিত্র শিল্পটার দিকে নজর দেওয়ার সময় এসেছে। আমাদের বোঝা দরকার, শুধু সিনেপ্লেক্স বানালেই হবে না। সবশ্রেণির মানুষকে ছবি দেখার সুযোগটা তৈরি করে দিতে হবে। কারণ, ৪০০-৬০০ টাকায় টিকিট কেটে তো দেশের সব মানুষ ছবি দেখার ক্ষমতা রাখে না। আবার কনটেন্ট নিয়ে ভাবারও সময় এসেছে। চলচ্চিত্রের সামগ্রিক জটিলতা না ছুটলে বিশেষ ছবি তৈরি হওয়ার আশা করা ভুল হবে।’

চলচ্চিত্র তথ্যভাণ্ডার বলছে, ১৯৫২ সালের পর ভাষা আন্দোলন নিয়ে বাংলাদেশে মাত্র তিনটি পূর্ণদৈর্ঘ্য চলচ্চিত্র নির্মিত হয়েছে! যার প্রথমটি ১৯৭০ সালে পরিচালনা করেন জহির রায়হান, নাম ‘জীবন থেকে নেয়া’। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগেই ছবিটি বানিয়েছিলেন তিনি। যে ছবি শুধু কালজয়ী হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হয়নি, স্বাধীনতা সংগ্রামেও ব্যাপক অবদান রেখেছিল।

বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর মহান মুক্তিযুদ্ধ নিয়ে বেশকিছু চলচ্চিত্র নির্মিত হলেও ভাষা আন্দোলনকে প্রাধান্য দিয়ে শহীদুল ইসলাম খোকন ২০০৬ সালে নির্মাণ করেন ‘বাঙলা’। প্রখ্যাত কথাসাহিত্যিক আহমদ ছফার ‘ওংকার’ উপন্যাসে অনুপ্রাণিত এটি। ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে নির্মিত হয় ‘বাঙলা’। হুমায়ুন ফরীদি, মাহফুজ আহমেদ, শাবনূর অভিনীত এ ছবির শেষ দৃশ্যে একজন বোবা মেয়ের মুখ থেকে বের হয়ে আসে একটি শব্দ– ‘বাঙলা’।

মাঝের চার দশক ভাষাকে উপজীব্য করে একটি সিনেমাও নির্মাণ হয়নি দেশে। অবশেষে ২০১৯ সালে ইমপ্রেস টেলিফিল্মের ব্যানারে তৌকীর আহমেদ নির্মাণ করেন ‘ফাগুন হাওয়ায়’। এতে অভিনয় করেন সিয়াম আহমেদ ও নুসরাত ইমরোজ তিশা।

চলচ্চিত্রকার জহির রায়হান ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ নামে একটি ছবি নির্মাণের প্রস্তুতি নিয়েছিলেন ’৭০ সালের দিকে। কিন্তু তৎকালীন পাকিস্তান সরকার তাকে অনুমতি দেয়নি। আরেক বরেণ্য চলচ্চিত্রকার আমজাদ হোসেন ‘শহীদ আসাদ’ নামে একটি ছবি নির্মাণের ঘোষণা দিয়েছিলেন। কুমিল্লার এক জনসভায় মজলুম জননেতা মওলানা ভাসানীকে নিয়ে ছবিটির মহরত হয়েছিল। কিন্তু পরে এর কাজ এগোয়নি। কারণ একটাই– তৎকালীন পাক সরকারের অনুমতি না পাওয়া।

তারপরও ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ ও ‘শহীদ আসাদ’ ছবি দুটি নিয়েই চলচ্চিত্র শিল্পে আশা ছিল। কিন্তু স্বাধীনতার দেড় মাস পর জহির রায়হান রহস্যজনক নিখোঁজ হলে ‘একুশে ফেব্রুয়ারি’ হওয়ার সম্ভাবনা শেষ হয়ে যায়। অন্যদিকে ‘শহীদ আসাদ’-এর পরিকল্পনা থামিয়ে আমজাদ হোসেন ব্যস্ত হয়ে পড়েন মুক্তিযুদ্ধের ছবি নির্মাণে। বিনিময়ে ভাষা আন্দোলনের গৌরবময় ৬৮ বছরে এই বিষয়ে ছবি নির্মাণ হয়েছে মাত্র তিনটি!

বাংলাদেশ চলচ্চিত্র সেন্সর বোর্ডের প্রাক্তন সদস্য মুশফিকুর রহমান গুলজার মনে করেন, ‘‘সত্যি বলতে একুশ নিয়ে পূর্ণাঙ্গ কোনও ছবিই নেই। ‘জীবন থেকে নেওয়া’- সেটাও মূলত স্বাধিকার আন্দোলনের ছবি। এরপর যা হয়েছে তার কোনোটাই পূর্ণাঙ্গ ভাষা আন্দোলনের ছবি নয়।”

কারণ হিসেবে গুলজার প্রথম দায়টা দেন সরকারকেই। তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঐতিহাসিক গল্পকে হালকাভাবে দেখার সুযোগ নেই। এজন্য বিস্তর গবেষণা দরকার। প্রচুর অর্থলগ্নির বিষয় আছে। মূলত এসব কারণেই ভাষা নিয়ে ছবি হচ্ছে না। এক্ষেত্রে সরকারি উদ্যোগ জরুরি। আমার কথা হচ্ছে, সরকার তো প্রতি বছরই কোটি কোটি টাকা অনুদান দিচ্ছে সিনেমার জন্য। সেখানে ভাষা নিয়ে সিনেমা নির্মাণের জন্য বাজেট রাখা দরকার বলে মনে করি। অনুদান কমিটিতে যারা থাকেন, তারা প্রত্যেকেই অত্যন্ত বিজ্ঞ মানুষ। তাদের মাধ্যমেই ভাষা আন্দোলন নিয়ে বছরে অন্তত একটি করে ছবি অনুদান পেতে পারে। সেটা তো হচ্ছে না। সময় এসেছে এক্ষেত্রে সরকারের একটু নজর দেওয়ার।’

মহান ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্টদের কেন এমন দীনতা? তাদের কয়েকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, ভাষা আন্দোলন নিয়ে চলচ্চিত্র নির্মাণ করার মতো প্রযোজক পাওয়া দুষ্কর। সব প্রযোজকই লগ্নিকৃত অর্থ ফেরত চান। কিন্তু এ ধরনের বিষয় নিয়ে নির্মিত ছবি বাংলাদেশের প্রেক্ষাগৃহে দর্শক পায় না বললেই চলে। সেক্ষেত্রে সরকার অনেক বড় ভূমিকা রাখতে পারে। কিন্তু তেমন কিছু এখনও দৃশ্যমান নয়। এ কারণে দেশ, দেশের মানুষ ও নতুন প্রজন্মের জন্য তেমন কোনও ছবি হচ্ছে না যেখানে ভাষা আন্দোলনের গল্প তুলে ধরা হবে।

এদিকে অনেকে এ ধরনের ছবিকে অবাণিজ্যিক আখ্যা দিয়ে সরকারের কাঁধে দায় তুলে দিলেও ভাষার গল্প নিয়ে ‘ফাগুন হাওয়ায়’ বানিয়ে সুখকর অভিজ্ঞতাই অর্জন করেছেন তৌকীর আহমেদ। তিনি বলেন, ‘‘ভালো কনটেন্ট হলে সেটা টিকে থাকবে। হয়তো টানা হাউজফুল যাবে না, কিন্তু ধীরে ধীরে দীর্ঘ সময় ধরে কাজটি সুবাস ছড়াবে। ‘ফাগুন হাওয়ায়’ ছবির মাধ্যমে সেই সুবাসটাই পাচ্ছি। প্রেক্ষাগৃহে মুক্তি পেলো, সিনেপ্লেক্সে ভালো চলেছে, টিভিতে দু’বার সম্প্রচার হলো। আইফ্লিক্স কিনে নিয়েছে। দেশ-বিদেশের অনেক উৎসবে অংশ নিচ্ছে। যেমন আজই (২১ ফেব্রুয়ারি) ছবিটি অংশ নিচ্ছে ভারতের হায়দরাবাদ উৎসবে। আমি সহজ করে ছবিটি বানাতে চেয়েছি। আমার লক্ষ্য ছিল, তরুণ প্রজন্মের সঙ্গে এর সংযোগ ঘটনো। সেটি আমি পেরেছি। আমার অভিজ্ঞতা হলো, প্রতিবন্ধকতা আছে। তবে সঠিক বিষয় ভাবতে পারলে বাস্তবায়ন করা সম্ভব।’

শুধু তৌকীর আহমেদ নন, সরকারসহ সংশ্লিষ্ট সবারই মাতৃভাষা নিয়ে এমন ভাবনা জরুরি হয়ে উঠেছে। কথিত বাণিজ্যিক ছবি যে বাজারে মুখ থুবড়ে পড়ছে হরহামেশা, সেখানে মাতৃভাষা কিংবা ভাষা আন্দোলন নিয়ে সিনেমা-ভাবনার জন্য প্রথমেই উৎসাহের হাত প্রসারিত করতে হবে সরকারকে। অন্য হাতগুলো যুক্ত হবে তারপর। বলছেন সংশ্লিষ্ট প্রায় সবাই।

 

 
Electronic Paper