রাজশাহীর দরগাপাড়া এলাকায় দিঘাপতিয়ার রাজপরিবার-সম্পর্কিত একটি পুরোনো বাড়ি ভাঙার সময় মেঝের নিচে একটি সুড়ঙ্গের সন্ধান মিলেছে।
বুধবার সকালে ভবনটির একটি অংশ ভাঙতে গিয়ে শ্রমিকরা সুড়ঙ্গপথটি দেখতে পান। সেখান থেকে অবিরাম পানি বের হতে থাকায় বর্তমানে সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি সরানোর কাজ চলছে।
স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, বাড়িটি নির্মাণ করেছিলেন দিঘাপতিয়ার রাজা হেমেন্দ্র কুমার রায়ের ছেলে সন্দীপ কুমার রায়। সামনে পুরোনো নাগলিঙ্গম গাছ, দুই পাশে একতলা ভবন এবং পেছনে দোতলা ভবন নিয়ে স্থাপনাটি ছিল অনন্য। সরকারি নথিতে এটি অর্পিত সম্পত্তি হিসেবে উল্লেখ থাকলেও, প্রত্নমূল্য যাচাই না করেই নিলামে বিক্রি করে দেওয়ায় তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন ইতিহাসবিদেরা।
বোয়ালিয়া ভূমি কার্যালয় জানায়, ৫২৪ খতিয়ানভুক্ত জমির দাগ ৪৭ শ্রেণি সিভিল ডিভিশন অফিস। মালিকানা দিঘাপতিয়া স্টেটের নামে। ১৯৮১ সালে এটিকে অর্পিত সম্পত্তি ঘোষণা করা হয়। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টের রায় অনুযায়ী, ১৯৭৪ সালের পর কোনো সম্পত্তিকে অর্পিত ঘোষণা করা যায় না ফলে বিষয়টি রহস্যজনক বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।
কবি ও গবেষক তসিকুল ইসলাম জানান, স্বাধীনতার পর ভাষাসৈনিক মনোয়ারা রহমানকে বাড়িটি ইজারা দেওয়া হয়। তিনি সেখানে মহিলা কুটিরশিল্প প্রতিষ্ঠান চালাতেন। বাড়িটি ছিল ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, তেভাগা আন্দোলন ও মুক্তিযুদ্ধ-সংগঠক পরিবারের আবাসস্থল।
মনোয়ারার স্বামী এম আতাউর রহমান ও বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ আ ন ম সালেহও এই বাড়িতে বসবাস করেছেন।
স্থানীয়দের দাবি, মহারানি হেমন্তকুমারী রাজশাহী এলে এ বাড়িতেই থাকতেন। বাড়ির কাঠের সিঁড়ি, দোতলা অংশ এবং চুন-সুরকির সরু সিঁড়ি সব মিলিয়ে বাড়ির গঠন ছিল অনন্য। দোতলার নিচ দিয়ে সুড়ঙ্গপথে একতলা ভবনে যাওয়ার একটি রাস্তা ছিল বলে প্রত্যক্ষদর্শীরা জানান। সেই সুড়ঙ্গই এখন উন্মুক্ত হয়েছে।
বাড়িটি কিনে ভাঙার দায়িত্ব পাওয়া শ্রমিকদের ব্যবস্থাপক অপু বলেন, ভাঙার পর নিচে সুড়ঙ্গ বেরিয়ে আসে। এক সুড়ঙ্গের সঙ্গে আরেকটির সংযোগ আছে। ভেতরে পানি থাকায় সেচযন্ত্র বসিয়ে পানি শুকানোর চেষ্টা চলছে।
হেরিটেজ রাজশাহীর প্রতিষ্ঠাতা মাহাবুব সিদ্দিকী বলেন, এ ধরনের স্থাপনা ভাঙার সিদ্ধান্ত অত্যন্ত দুঃখজনক। দিঘাপতিয়ার রাজপরিবার রাজশাহীর উন্নয়নে অসামান্য ভূমিকা রেখেছে। বাড়িটি ভাঙার আগে আমাদের মতো ইতিহাসচর্চাকারীদের সঙ্গে আলোচনা করা উচিত ছিল।
তিনি আরও বলেন, বরেন্দ্র জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করা থেকে শুরু করে রাজশাহী কলেজ, পিএন বালিকা বিদ্যালয় ও হাসপাতাল দিঘাপতিয়া রাজবংশের অবদান সর্বত্র ছড়িয়ে রয়েছে। ফলে এই বাড়ির প্রত্নমূল্য যাচাই না করে ভাঙা সংস্কৃতি-ঐতিহ্যের জন্য ক্ষতিকর।
রাজশাহীর অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মহিনুল ইসলাম বলেন, স্থাপনাটি অত্যন্ত জরাজীর্ণ হয়ে পড়েছিল, তাই ভাঙার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। জায়গাটি নিয়ে আমাদের পরিকল্পনা আছে।
সুড়ঙ্গের বিষয়ে তিনি জানান, সহকারী কমিশনারকে (ভূমি) ঘটনাস্থলে পাঠানো হয়েছে। যদি প্রত্নতাত্ত্বিক কোনো নিদর্শন পাওয়া যায়, তা সংরক্ষণ করা হবে।
ঐতিহ্যবাহী বাড়ির ভাঙা ও সুড়ঙ্গ আবিষ্কার নিয়ে এখন স্থানীয়দের মধ্যে কৌতূহল ও বিতর্ক দুটোই জোরদার হয়েছে।
কেকে/ এমএস