ত্রয়োদশ জাতীয় নির্বাচনের সময় যত এগোচ্ছে, প্রতিশ্রুত সংস্কার শেষ করতে তত চাপে পড়ছে অন্তর্বর্তী সরকার। রয়েছে রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার সঙ্গে পূর্ববর্তী সরকারের রেখে যাওয়া অর্থনৈতিক চাপও। সরকারের সংস্কার কর্মসূচিকে লাইনচ্যুত করতে বিরোধীদের চেষ্টা অব্যাহত আছে। আবার আন্দোলনের মধ্য দিয়ে হাসিনা সরকারের পতনের পর অন্তর্বর্তী সরকার যে ব্যাপক সমর্থন পেয়েছিল, তাও ম্লাম হতে শুরু করেছে বলে মনে করে ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপ (আইসিজি)। রাজনৈতিক দল ও অন্যান্য গুরুত্বপূর্ণ পক্ষ সংস্কার নিয়ে দর কষাকষি করায় এবং নির্বাচনি সুবিধার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠায় চলতি বছর বাড়তে পারে রাজনৈতিক চ্যালেঞ্জ। গণ-অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত রাজনৈতিক নেতৃত্বের নাম নিঃসন্দেহে তারেক রহমান, যিনি দেশে না থেকেও আছেন জনগণের হৃদয়ে। তাই তারেক রহমানের এমন অভিভাবকত্ব দেখার জন্য অধীর আগ্রহে দিন গুনছেন আগামী ত্রয়োদশ নির্বাচনের দিকে।
২০০৭ সালের ওয়ান-ইলেভেন ও পরবর্তী সময়ে আওয়ামী লীগ সরকার তারেক রহমানকে নিয়ে একটি সংঘবদ্ধ প্রোপাগান্ডা ছড়ায়। দুর্নীতি আর লুটপাটের কথিত গালগল্প বিভিন্ন মাধ্যমে ছড়িয়ে তারা তারেক রহমানকে কোণঠাসা করে ফেলে। কেননা তারা জানত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও খালেদা জিয়ার উত্তরাধিকার তারেক রহমানের মধ্যে যে মানবীয় রাজনৈতিক ধারা বহমান, তার চর্চা যত বেশি হবে, দেশের সাধারণ মানুষ তত বেশি বিএনপির প্রতি আকৃষ্ট হবে। সে কারণেই তারা জনগণ থেকে তারেক রহমানকে দূরে সরিয়ে রাখার চক্রান্ত করেছে। তবে চব্বিশের ছাত্র-জনতার গণ-অভ্যুত্থান সব চক্রান্ত- ষড়যন্ত্রকে ধূলিসাৎ করে দিয়েছে। জনগণ উপলব্ধি করতে পেরেছেন একজন দেশপ্রেমিক রাজনীতিককে।
জনগণ চিনতে পেরেছে সত্যিকারের নেতাকে। সংকট কিংবা সম্ভাবনায় দূরদৃষ্টিসম্পন্ন একজন দায়িত্বশীল অভিভাবক হিসেবে তারা পেয়েছে তারেক রহমানকে, যিনি তার জীবনের প্রতিটি মুহূর্তে ভাবেন দেশ ও দেশের মানুষকে নিয়ে। কাজ করেন দেশের ভবিষ্যৎ বিনির্মাণের জন্য। তিনি শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমান ও সাবেক প্রধানমন্ত্রী খালেদা জিয়ার জ্যেষ্ঠ সন্তান। পারিবারিক পরিচয়ে তিনি ক্ষমতার বৃত্তে বেড়ে উঠলেও ক্ষমতা তাকে কখনোই স্পর্শ করেনি, বরং তিনি মা-বাবার আদর্শে হয়ে উঠেছেন একজন দেশ ও মানবতাবাদী। সে কারণেই তিনি দেশের কোটি কোটি মানুষের কাক্সিক্ষত আগামীর রাষ্ট্রনায়ক, যার প্রতীক্ষায় বাংলাদেশ দাঁড়িয়ে আছে তার অমিত সম্ভাবনা নিয়ে।
১৯৮৯ সালে বগুড়া জেলা বিএনপির প্রাথমিক সদস্য পদ গ্রহণের মাধ্যমে আনুষ্ঠানিকভাবে রাজনীতিতে নাম লেখান তারেক রহমান। এর পর থেকে শুরু হয় তার রাজনীতিক হয়ে ওঠার লড়াই। ক্ষমতাকে ব্যবহার করে নয়, বরং তৃণমূলের মানুষের কাছে গিয়ে তাদের কাছ থেকেই তিনি শিখেছেন রাজনীতি। প্রান্তিক মানুষের সমস্যা-সংকট আর সম্ভাবনার চুলচেরা বিশ্লেষণ কিংবা উত্তরণের উপায় খুঁজতে খুঁজতে রাজনীতিকে নিজের কাছে সহজপাঠ্য করেছেন তিনি। তিনি ধারণ করেছেন কৃষকের স্বপ্ন, মুটে আর মজুরের সংগ্রাম কিংবা তারুণ্যের সম্ভাবনাময় আগামীকে। তাইতো তার রাষ্ট্র দর্শন কিংবা রাজনৈতিক বক্তব্য এতা বাস্তবসম্মত হয়, যেন মানুষের হৃদয়ের কথা বলেন তিনি। যেন তিনি বলেন, আমি-তুমি আর আমরা যা বলতে চেয়েছি, অথবা ভেবেছি বলব বলে- সে সবকিছুই। তারেক রহমান দলীয় তেমন কোনো পদ পদবিতে না থাকলেও বহু আগে থেকেই তিনি ছাত্রদলের সঙ্গে নিবিড় সম্পর্ক তৈরি করেন। তিনি নিজে রাজনীতি বুঝেছেন। যা ভেবেছেন কিংবা যেভাবে রাজনীতিকে দেখতে চেয়েছেন, তা নিয়ে কথা বলেছেন নেতাদের সঙ্গে। এভাবে খোলামেলা আলোচনায় উপকৃত হয়েছে দল। এগিয়েছে দেশ। রাজনীতিতে পরিপক্ব হয়েছেন তিনি।
২০০১ সালের জাতীয় নির্বাচনের ভোট বিপ্লবের নেপথ্য কারিগর হিসেবে ভূমিকা রেখেছিলেন তারেক রহমান। খালেদা জিয়ার নেতৃত্বে সরকার গঠিত হলেও তারেক রহমান সরকারে যোগ না দিয়ে সাংগঠনিক কাজে ওতপ্রোতভাবে জড়িত হন। তার নেতৃত্বে দলীয় কর্মকাণ্ডের ব্যাপক বিস্তৃতি ঘটে। স্বল্প সময়ের ব্যবধানেই তিনি নিজেকে জাতীয়তাবাদী রাজনীতির পাদপ্রদীপে নিয়ে আসতে সক্ষম হন। বিএনপি সরকার ক্ষমতায় আসার পর তারেক রহমানকে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটি এবং নির্বাহী কমিটির সর্বসম্মত সিদ্ধান্তে কাউন্সিলের মাধ্যমে সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিবের দায়িত্ব দেওয়া হয়।
চেয়ারপারসন দেশনেত্রী খালেদা জিয়ার ও দলের সিদ্ধান্ত মোতাবেক চেয়ারপারসন কার্যালয়ের সার্বিক দায়িত্বভার গ্রহণ করেন তারেক রহমান। রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক- এক কথায় দেশ ও দল পরিচালনার এক আধুনিক গবেষণাগার হিসেবে পরিকল্পিতভাবে কাজ শুরু হয় চেয়ারপারসন কার্যালয়ে। শিক্ষিত মেধাবী একদল আধুনিক কর্মী বাহিনী ও বিএনপির সিনিয়র নেতাদের সমন্বয়ে বিশ্বায়নের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং বাংলাদেশের মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ বিনির্মাণের বাস্তবধর্মী কর্মযজ্ঞ শুরু করেন কর্মবীর তারেক রহমান। দক্ষ কর্মী বাহিনী দিয়ে রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক বিষয়ে তৃণমূল পর্যায় থেকে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করে প্রকৃত সমস্যাগুলোকে চিহ্নিত করেন। এরপর প্রতিটি ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ মতামত গ্রহণ করে দায়িত্বশীল নেতাদের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে সঠিক এবং কার্যকর পরিকল্পনা প্রণয়ন করত তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী দেশনেত্রী খালেদা জিয়াকে এবং সরকার পরিচালনায় অংশগ্রহণকারী নেতাদের সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে নিরলসভাবে কাজ করেছে চেয়ারপারসন কার্যালয়। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি, শিল্প, সাহিত্য, মানবাধিকার, আইনের শাসন, সামাজিক উন্নয়ন, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক এবং যোগাযোগ, আধুনিক জ্ঞান-বিজ্ঞান ও তথ্য-প্রযুক্তি এবং আধুনিকায়নের চ্যালেঞ্জসহ সামগ্রিক বিষয়ে গবেষণা করা এবং গবেষণালব্ধ তথ্যের ভিত্তিতে কাজ করার মধ্যে ছিল তার রাষ্ট্রনায়কোচিত প্রজ্ঞা ও বিচক্ষণতা।
তারেক রহমানের ভিশনারি রাজনীতির অন্যতম এক দৃষ্টান্ত হচ্ছে তৃণমূল প্রতিনিধি সম্মেলন। ২০০২ সালে তৃণমূল পর্যন্ত শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শকে ছড়িয়ে দিয়ে তরুণ প্রজন্মকে আগামী বাংলাদেশ বিনির্মাণের প্রাণশক্তিতে রূপান্তরের এক মহাযজ্ঞ নিয়ে তিনি বাংলাদেশের প্রান্তিক এলাকাগুলো চষে বেড়ান। তারেক রহমানের এই অফুরান প্রাণশক্তি তাকে তরুণ প্রজন্মের কাছে তারুণ্যের অহংকার হিসেবে পরিচিত করে তোলে। তিনি বিশ্বাস করেন, এ দেশের তরুণসমাজের কাছে দেশের সঠিক ইতিহাস, গণতান্ত্রিক মূল্যবোধ, বাংলাদেশবাদী রাজনীতির বার্তা পৌঁছে দেওয়া সম্ভব হলে একদিন তাদের মাধ্যমেই বাংলাদেশ বিশ্বের দরবারে এক রোল মডেল হিসেবে আবির্ভূত হবে। এ লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে সঙ্গে করে লাখো মানুষের তুমুল হর্ষধ্বনি আর অবিরাম ভালোবাসা সঙ্গে নিয়ে সবুজ বাংলার প্রান্তর থেকে প্রান্তরে ঘুরে বেড়িয়েছেন তারেক রহমান। ২০০৫ সালের জানুয়ারি থেকে টানা তিন মাস দেশের প্রতিটি ইউনিয়নের প্রতিনিধিদের নিয়ে ইউনিয়ন প্রতিনিধি সভা করে তিনি দলে নতুনভাবে আলোড়ন ও উদ্দীপনা সৃষ্টি করতে সক্ষম হন। কেননা তিনি মনে করেন, বিএনপির প্রতিটি নেতাকর্মীই দল ও দেশ পরিচালনায় ভূমিকা রাখতে পারেন। সঠিক নির্দেশনা আর দক্ষ নেতৃত্ব তাদের ভেতর সুপ্ত নেতৃত্বকে জাগিয়ে তুলবে। সে কারণেই তিনি তৃণমূলে ঘুরে ঘুরে তাদের উজ্জীবিত করেন। তার এই অভিনব রাজনৈতিক ভাবনা ও তা বাস্তবায়নের প্রারম্ভিক কর্মসূচিগুলো ছিল নন্দিত, যথাযোগ্য ও সময়ের চেয়ে অগ্রসরমাণ। রাজনীতিতে তারেক রহমানের এ কর্মসূচি ভিন্ন মাত্রা যোগ করে। বিরোধী শিবিরেও তাকে নিয়ে ব্যাপক চর্চা শুরু হয়। রাজনীতির বাইরেও তারেক রহমানের সমাজ ও দেশ নিয়ে ভাবনার ইচ্ছা প্রবল।
তারেক রহমান চেয়েছেন কখনোই যেন দেশের মানুষের থেকে বিচ্ছিন্ন না হন। ক্ষমতায় না থেকেও যাতে সামাজিক উন্নয়ন ও সেবামূলক কর্মকাণ্ড চালিয়ে নেওয়া যায় সে লক্ষ্যে তিনি প্রতিষ্ঠা করেন ‘জিয়াউর রহমান ফাউন্ডেশন’। তার হাতে গড়া অরাজনৈতিক এই সংগঠনটি আজ দেশে মানবসেবার অনন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। কৃষি-শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা, পরিবেশ-প্রযুক্তিসহ বিভিন্ন খাতে বহু বছর ধরে এই ফাউন্ডেশন নিরবচ্ছিন্নভাবে কাজ করে যাচ্ছে।হাসিনার দেড় দশকের শাসনের ফ্যাসিবাদী আমল শেষ হয়েছে। তারুণ্যের প্রবল ঝড়ে উড়ে গেছে অহংকার আর দম্ভের রাজপ্রাসাদ। দেশে এখন বইছে গণতন্ত্রের হাওয়া। রক্তস্নাত বিপ্লব আমাদের ধরে রাখতে হবে। এগিয়ে নিতে হবে গণতান্ত্রিক অভিযাত্রাকে। শহীদ রাষ্ট্রপতি জিয়াউর রহমানের আদর্শ ও দূরদর্শিতা এবং খালেদা জিয়ার বাংলাদেশপন্থি রাজনীতিকে ছড়িয়ে দিতে হলে এ মুহূর্তে তারেক রহমানের বিকল্প নেই। তার নেতৃত্বেই বাংলাদেশে সৃষ্টি হবে এক নতুন ইতিহাস। আগামী ফেব্রুয়ারির জাতীয় নির্বাচন বিঘ্নিত হলে বাংলাদেশের গণতান্ত্রের ভবিষ্যৎ কত দীর্ঘ সময় মহাকাশের কালো গহ্বরের আড়ালে অন্তরীণ হয়ে থাকবে, সেটা হঠকারী রাজনৈতিক নেতৃত্ব উপলব্ধি করতে ব্যর্থ হলেও সাধারণ মানুষের কাছে সেটা দুর্বোধ্য নয়। আর তেমন হলে ইতিহাস তাদের কি পরিণতি নির্ধারণ করবে সেটা ইতিহাসের জন্য তোলা থাক কিন্তু জনগণের শিক্ষা কেমন হতে পারে সেটা নিশ্চয়ই বলে দেওয়ার প্রয়োজন নেই। অন্য দিকে রাজনৈতিক দলগুলোর সামনে আগামী ফেব্রুয়ারিতে এক মহিমান্বিত গণতান্ত্রিক উত্তরণে মহানায়ক হবার দুর্লভ সুযোগ। পাশাপাশি দেশটি গণতান্ত্রিক উত্তরণে এগিয়ে যাওয়ার এক বিশাল সুযোগ জনগণ হাতছাড়া করতে চায় না।
লেখক : গবেষক ও কলাম লেখক, যুক্তরাজ্য
কেকে/এআর