বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসে জাতীয় সংসদ নির্বাচনগুলোর গুরুত্ব অপরিসীম। প্রতিটি নির্বাচনই শুধু ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং গণতন্ত্রের ভিত্তি সুসংহত করার এক একটি মাইলফলক। যদিও বাংলাদেশের জাতীয় সংসদের ক্রমিক সংখ্যা অনুযায়ী এখন পর্যন্ত ত্রয়োদশ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়নি (সর্বশেষ দ্বাদশ সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে এবং ত্রয়োদশ সংসদ নির্বাচন ২০২৬ সালের প্রথম দিকে অনুষ্ঠিত হওয়ার সম্ভাবনা), তবুও একটি ‘ত্রয়োদশ নির্বাচন’ এর ধারণাটি আমাদের রাজনৈতিক আলোচনার টেবিলে একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন উত্থাপন করে: আমরা কোনো পথে হাঁটছি এবং আমাদের ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য নির্বাচনের আদর্শিক গুরুত্ব কী হওয়া উচিত?
এখানে আমরা একটি আদর্শিক ও প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ নির্বাচনের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও ভবিষ্যৎ গতিপথ নিয়ে আলোচনা করব।
আমরা বিশেষভাবে নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষতা, আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা এবং সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতার মতো বিষয়গুলোর ওপর জোর দেব। গণতন্ত্রের অভিযাত্রা ও নির্বাচনের তাৎপর্য স্বাধীনতার পর থেকেই বাংলাদেশ একটি বহুদলীয় সংসদীয় গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র হিসেবে নিজেদের প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছে। নির্বাচন সেই চেষ্টার কেন্দ্রবিন্দু। নির্বাচন জনগণের সার্বভৌম ক্ষমতাকে প্রতিফলিত করে, যেখানে নাগরিকরা তাদের প্রতিনিধি বেছে নেওয়ার সুযোগ পায়। এই প্রক্রিয়া সরকারের বৈধতা, জবাবদিহিতা এবং স্বচ্ছতা নিশ্চিত করার একমাত্র পথ। একটি আদর্শ ত্রয়োদশ নির্বাচন- এর প্রধান গুরুত্ব হবে এটি অতীতের সকল ত্রুটি ও বিতর্কমুক্ত একটি গ্রহণযোগ্য নির্বাচন হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হওয়া।
(১). রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও ঐকমত্যের সৃষ্টি: দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক স্থিতিশীলতার জন্য একটি সর্বজনীনভাবে গ্রহণযোগ্য নির্বাচন অপরিহার্য। যখন একটি নির্বাচনি দল- নিরপেক্ষভাবে এবং স্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় অনুষ্ঠিত হয়, তখন পরাজিত পক্ষও ফলাফল মেনে নিতে বাধ্য হয়। ঐকমত্য: একটি বিশ্বাসযোগ্য নির্বাচন রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে আস্থা ফিরিয়ে আনতে পারে, যা দীর্ঘদিনের বিভেদ ও সংঘাত নিরসনে সহায়ক। অতীত অভিজ্ঞতা বলে, নির্বাচন পদ্ধতি নিয়ে বিতর্ক দেশে গভীর রাজনৈতিক মেরুকরণ সৃষ্টি করেছে। ত্রয়োদশ নির্বাচনকে অবশ্যই এই মেরুকরণের ঊর্ধ্বে উঠে একটি জাতীয় ঐকমত্যের প্ল্যাটফর্ম হিসেবে কাজ করতে হবে।
স্থিতিশীলতা: এটি নির্বাচনের পরবর্তী সময়ে সহিংসতা ও অস্থিতিশীলতা রোধ করে, যার ফলে অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সামাজিক অগ্রগতি সম্ভব হয়। স্থিতিশীলতা না থাকলে ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার বাধাগ্রস্ত হয় এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়।
(২). কার্যকর সংসদ ও শক্তিশালী বিরোধী দল : গণতন্ত্রের প্রাণ হলো শক্তিশালী বিরোধী দল একটি বিতর্কিত নির্বাচন প্রায়শ বিরোধী দলগুলোকে সংসদ বর্জন করতে উৎসাহিত করে, যা সংসদকে কার্যকারিতা এবং বিতর্কের তীক্ষ্ণতা থেকে বঞ্চিত করে।
কার্যকর ভূমিকা : ত্রয়োদশ নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে আসা একটি শক্তিশালী বিরোধী দল সরকারে জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে পারে এবং গঠনমূলক সমালোচনা ও বিকল্প নীতি প্রস্তাব করে আইন প্রণয়ন প্রক্রিয়াকে সমৃদ্ধ করতে পারে। একটি কার্যকরী সংসদ শুধুমাত্র আইন প্রণয়নই নয়, বরং জনগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে আলোচনা ও নীতি নির্ধারণের প্রধান ক্ষেত্র।
জনগণের কণ্ঠস্বও : এটি নিশ্চিত করে যে জনগণের ভিন্নমত ও উদ্বেগগুলো সংসদের ফ্লোরে উত্থাপিত হচ্ছে, যার ফলে সংসদ জনগণের সত্যিকারের প্রতিনিধিত্বশীল প্রতিষ্ঠানে পরিণত হয়। বিরোধী দলের দুর্বলতা গণতন্ত্রের জন্য ক্ষতিকর, কারণ এটি সরকারকে একচেটিয়া ক্ষমতা প্রয়োগের সুযোগ দেয়। ভবিষ্যৎ বাংলাদেশে ত্রয়োদশ নির্বাচনের গুরুত্ব ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের স্বপ্ন হলো একটি উন্নত, সমৃদ্ধ ও বৈষম্যহীন সমাজ। এই স্বপ্ন বাস্তবায়নে একটি আদর্শ ত্রয়োদশ নির্বাচন একাধিক দিক থেকে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করতে পারে।
(৩). সুশাসন প্রতিষ্ঠা ও দুর্নীতি দমন : নির্বাচন হলো নাগরিক নজরদারি প্রয়োগের সবচেয়ে শক্তিশালী হাতিয়ার। ভোটাররা তাদের ম্যান্ডেট ব্যবহার করে দুর্নীতিগ্রস্ত বা অকার্যকর নেতৃত্বকে প্রত্যাখ্যান করতে পারে।
জবাবদিহিতা : একটি সুষ্ঠু নির্বাচন জনপ্রতিনিধিদের মধ্যে এই ভয় সৃষ্টি করে যে খারাপ পারফরম্যান্সের জন্য তাদের শাস্তি পেতে হবে, যা তাদের সুশাসন প্রতিষ্ঠায় মনোযোগ দিতে বাধ্য করে। এর ফলে সরকারি অর্থের সঠিক ব্যবহার নিশ্চিত হয়।
প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা : নির্বাচন কমিশন (ইসি) যখন স্বাধীনভাবে কাজ করে, তখন দেশের অন্যান্য প্রতিষ্ঠান যেমন দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক), মানবাধিকার কমিশন এবং বিচার বিভাগও স্বাধীন ও কার্যকরভাবে কাজ করার সাহস পায়। ত্রয়োদশ নির্বাচনের মাধ্যমে ইসির সাংবিধানিক স্বাধীনতা ও আর্থিক সচ্ছলতা আরো সুদৃঢ় করা অপরিহার্য।
(৪). আইনের শাসন ও মৌলিক অধিকার সুরক্ষা : একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচন আইনের শাসন প্রতিষ্ঠার ভিত্তি। নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার সংবিধান ও আইনের প্রতি দায়বদ্ধ থাকে। মৗলিক অধিকার: একটি ত্রুটিমুক্ত নির্বাচন প্রক্রিয়া নাগরিকদের মত প্রকাশের স্বাধীনতা, সমাবেশ করার অধিকার এবং নিরাপদে ভোটদানের মৌলিক অধিকার নিশ্চিত করে। এই অধিকারগুলো গণতান্ত্রিক সমাজব্যবস্থার মূল ভিত্তি।
সংবিধানের প্রতি আস্থা : যখন নির্বাচন নিয়ে বিতর্ক সৃষ্টি হয়, তখন জনগণের মধ্যে সংবিধান ও রাষ্ট্রীয় কাঠামোর প্রতি আস্থা কমে যায়। ত্রয়োদশ নির্বাচনকে অবশ্যই সেই আস্থা পুনরুদ্ধার করতে হবে, যাতে সবাই বুঝতে পারে যে সাংবিধানিক পথেই ক্ষমতার পরিবর্তন সম্ভব। এটি দেশের গণতান্ত্রিক সংস্কৃতিকে শক্তিশালী করে।
(৫). তরুণ ভোটার ও ডিজিটাল বাংলাদেশের আকাক্সক্ষা : বাংলাদেশের জনসংখ্যার একটি বিশাল অংশ এখন তরুণ। এই তরুণ প্রজন্ম একটি স্বচ্ছ, তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর এবং প্রগতিশীল নির্বাচন প্রক্রিয়ার প্রত্যাশী। আস্থা পুনরুদ্ধার : একটি আদর্শ ত্রয়োদশ নির্বাচন তরুণদের মধ্যে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ার প্রতি আস্থা ফিরিয়ে আনবে। তারা ভোট দিতে উৎসাহিত হবে এবং দেশের ভবিষ্যৎ নির্মাণে নিজেদের ভূমিকা অনুভব করবে। কারণ, তরুণদের সক্রিয় অংশগ্রহণই গণতন্ত্রকে প্রাণবন্ত রাখে।
ডিজিটাল স্বচ্ছতা : আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করে ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন (ইভিএম) এর ব্যবহার, ভোটার তালিকা, ভোটদান ও ফলাফল প্রকাশে সর্বোচ্চ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা গেলে ডিজিটাল বাংলাদেশের আকাক্সক্ষা নির্বাচনের মাঠেও প্রতিফলিত হবে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে কারচুপির সুযোগ কমিয়ে আনা সম্ভব।
(৬) আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা ও অর্থনৈতিক প্রভাব : একটি দেশের অভ্যন্তরীণ রাজনীতি যখন স্থিতিশীল এবং গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যখন আন্তর্জাতিক মানদণ্ড মেনে চলে, তখন সেই দেশের আন্তর্জাতিক গ্রহণযোগ্যতা বৃদ্ধি পায়। বিনিয়োগ আকর্ষণ : বিদেশি বিনিয়োগকারীরা সাধারণত রাজনৈতিকভাবে স্থিতিশীল ও গণতান্ত্রিক দেশে বিনিয়োগ করতে পছন্দ করেন। একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অর্থনৈতিক অনিশ্চয়তা দূর করে এবং দীর্ঘমেয়াদি বিনিয়োগের পরিবেশ সৃষ্টি করে। বিদেশি অংশীদার ও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো তখন বাংলাদেশকে আরো নির্ভরযোগ্য সহযোগী হিসেবে বিবেচনা করে।
আন্তর্জাতিক সম্পর্ক : গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় আস্থা আন্তর্জাতিক সহযোগী দেশ ও সংস্থাগুলোর সঙ্গে বাংলাদেশের স¤পর্ককে আরো মজবুত করে, যা উন্নয়ন সহায়তা ও বাণিজ্য প্রসারে সহায়ক।
উপসংহার : গণতন্ত্রের ভবিষ্যতের অঙ্গীকার একটি প্রত্যাশিত ত্রয়োদশ নির্বাচন নিছক একটি ভোট প্রক্রিয়া নয়, বরং এটি ভবিষ্যৎ বাংলাদেশের জন্য একটি অঙ্গীকার। এই অঙ্গীকার হলো- জনগণের ম্যান্ডেটই হবে ক্ষমতার একমাত্র ভিত্তি। যদি এই নির্বাচনটি সকল দলের অংশগ্রহণ, নির্বাচন কমিশনের পূর্ণ স্বাধীনতা, অবাধ প্রচারণার সুযোগ, আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর নিরপেক্ষতা এবং ভোটারদের নির্ভয়ে ভোটদানের পরিবেশ নিশ্চিত করতে পারে, তবে তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে নতুন উচ্চতায় নিয়ে যাবে। এটি শুধুমাত্র ক্ষমতার পালাবদল নয়, বরং গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের পুনরুজ্জীবন, সুশাসনের প্রতিষ্ঠা এবং একটি উন্নত, মানবিক ও প্রগতিশীল বাংলাদেশের স্বপ্ন পূরণের পথে এক অদম্য অভিযাত্রা হবে।
এই নির্বাচনই নির্ধারণ করবে বাংলাদেশ তার স্বাধীনতার মূল চেতনা-গণতন্ত্র- থেকে সরে যাচ্ছে নাকি একে আরো মজবুত করছে। তাই, ত্রয়োদশ নির্বাচনের গুরুত্ব কেবল ইতিহাসের পাতায় নয়, বরং ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য গণতান্ত্রিক অধিকার ও সার্বভৌমত্বের রক্ষা কবচ হিসেবে এটি বিবেচিত হবে। এই নির্বাচন হবে সেই সময়, যখন বাংলাদেশ প্রমাণ করবে যে, জনগণের শক্তিই রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ শক্তি।
লেখক : সাংবাদিক ও মানবাধিকারকর্মী
কেকে/এমএ