বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫,
১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩২
বাংলা English
ই-পেপার

বৃহস্পতিবার, ২৭ নভেম্বর ২০২৫
শিরোনাম: ডেঙ্গুতে মৃত্যু আরও সাত, হাসপাতালে ভর্তি ৫৬৭      ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প      দুদকের সব কর্মকর্তাকে বাধ্যতামূলক সম্পত্তির হিসাব দিতে হবে      প্রাথমিক শিক্ষকদের লাগাতার কর্মবিরতি      নির্বাচনী জোটের আলোচনা প্রাথমিক পর্যায়ে : রাশেদ খান      গণতন্ত্র ফেরাতে নির্বাচনের বিকল্প নেই : আমান      সিসিইউতে খালেদা জিয়া      
খোলা মত ও সম্পাদকীয়
হাসিনার মৃত্যুদণ্ড: ন্যায়বিচার নাকি নতুন রাজনৈতিক বিভাজন?
মো. আজমির হোসেন
প্রকাশ: বৃহস্পতিবার, ২০ নভেম্বর, ২০২৫, ১:২৪ পিএম
ফাইল ছবি

ফাইল ছবি

বাংলাদেশের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গত ১৭ নভেম্বর আওয়ামী লীগ সভানেত্রী ও জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী ক্ষমতাচ্যুত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে মৃত্যুদণ্ড প্রদান করেছেন। এটি ছিল মানবতাবিরোধী অপরাধের একটি মামলা, যা ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্ট মাসে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের সময় বিক্ষোভকারী ও সাধারণ মানুষের ওপর শেখ হাসিনা সরকারের প্রত্যক্ষ আদেশে আইনের অপপ্রয়োগ করে নিরীহ মানুষের ওপর মারাত্মক দমন-পীড়নের ঘটনাগুলিকে সংযুক্ত করে দায়ের করা হয়েছিল। ট্রাইব্যুনাল শেখ হাসিনাকে হত্যায় প্ররোচনা, হত্যার নির্দেশ এবং নৃশংসতা প্রতিরোধে নিষ্ক্রিয় ভূমিকাসহ পাঁচটি অভিযোগে দোষী সাব্যস্ত করেছেন এবং তাকে তার অনুপস্থিতিতে এই মৃত্যুদন্ডের রায় দেওয়া হয়েছে। কারণ তিনি গত বছর ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার পর থেকে পালিয়ে ভারতে নির্বাসিত জীবনযাপন করছেন। এই মামলায় অবশ্য সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামালকেও মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়েছে। তবে, সাবেক পুলিশ প্রধান আবদুল্লাহ আল মামুন, যিনি রাজসাক্ষী হয়েছেন, তাকে পাঁচ বছরের কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

আওয়ামী লীগ এবং শেখ হাসিনা এই রায়কে ‘পক্ষপাতদুষ্ট রায় এবং রাজনৈতিক উদ্দেশ্যপ্রণোদিত রায়’ বলে অভিহিত করেছেন এবং তাদের বিরুদ্ধে করা সকল অভিযোগ অস্বীকার করেছেন। রায় প্রকাশের পর বাংলাদেশ সরকার হাসিনার প্রত্যর্পণের জন্য ভারতের কাছে আনুষ্ঠানিক অনুরোধ জানিয়েছে, তবে ভারত এখনও এ বিষয়ে চূড়ান্ত কোন সিদ্ধান্ত নেয়নি।

এই রায় বাংলাদেশের রাজনীতিকে আবারও এক সংকটময় কঠিন চ্যালেঞ্জ এর মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছে। হাসিনার বিরুদ্ধে ঘোষিত মৃত্যুদণ্ড দেশকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে এক কঠিন সংকটময় রাজনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে নিয়ে এসেছে, যা কেবল একটি রায় নয় বরং দেশের ক্ষমতার ভারসাম্য, রাজনৈতিক সংস্কৃতি, দলীয় কোন্দল বৃদ্ধি, জনমতের বিরুপ প্রতিক্রিয়া এবং আগামী নির্বাচনের ভোটের সমীকরণের সম্ভাবনাকে নতুনভাবে প্রভাবিত করছে।

জুলাই ২০২৪ অভ্যুত্থান-পরবর্তী অস্থিরতার সময়কাল থেকেই দেশের রাজনৈতিক পরিবেশ ছিল ভঙ্গুর। সেই সময়ের ধাক্কা এখনও দেশের রাজনীতিতে প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। নিবন্ধন হারানো আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশের রাজনীতির মাঠে দীর্ঘদিন জোটবদ্ধ হয়ে রাজনীতি করা পুরনো মিত্রদলগুলোর মধ্যে এখন স্পষ্ট বিভাজন বিদ্যমান। দীর্ঘদিনের ক্ষমতার অংশীদার ও বিরোধী দল হিসেবে জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতে ইসলামীর মধ্যে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে মাঠের দ্বন্দ্ব ও ভোটের প্রতিযোগিতা স্পষ্টত প্রতীয়মান। সেই প্রেক্ষাপটে শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের এই রায় যেন বাংলাদেশের রাজনৈতিক মানচিত্রে এক নতুন বিস্ফোরণ ঘটিয়েছে।

রায় ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে এই রায়কে সমালোচনা করে এবং প্রতিবাদ জানিয়ে দেশ বিদেশে অবস্থানরত আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের পক্ষ থেকে প্রতিবাদী সংবাদ, পোস্ট, মতামত, কমেন্টস ইত্যাদি সোস্যাল মিডিয়ায় এবং বিদেশি ও দেশি গণমাধ্যমের মাধ্যমে প্রচার করছে। দলটি এই রায়টিকে ‘আওয়ামী লীগের বিপক্ষে রাজনৈতিক প্রতিহিংসার ও প্রতিশোধের রায়’ হিসেবে আখ্যা দিয়েছে। দলের শীর্ষ নেতৃত্ব মনে করছে, রায়টি তাদের দলকে রাজনৈতিকভাবে জনগণের নিকট প্রশ্নবিদ্ধ করতে দেয়া হয়েছে।

বিশেষ করে এই রায়ের ফলে দলটির তৃণমূল নেতারা অনেক বেশি আতঙ্কিত, কারণ অনেক শীর্ষ নেতারাই বিদেশে অবস্থান করছেন এবং স্থানীয় নেতৃত্বকে এখনো প্রকাশ্যে রাজনৈতিক কাজকর্ম করার কোন সুযোগই দেয়া হচ্ছে না হাসিনা সরকারের পতনের পর থেকেই। তাই রায়ের বিরুদ্ধে প্রকাশ্যে দলের এই দু:সময়ে কোন বড় ধরনের দৃশ্যমান মিছিল মিটিং প্রতিবাদ সভা বা রাজনৈতিক সমাবেশ পরিচালনা করতে দেখা যায়নি বরং অনলাইন সোস্যাল মিডিয়ার মাধ্যমে ও দেশি ও বিদেশি কয়েকটি মিডিয়ার মাধ্যমে দেশব্যাপী শাটডাউন পালন করার জন্য একটা দায়সারা ঘোষণা প্রদান করেছে দলের পক্ষ থেকে এবং এর প্রেক্ষিতে রাজধানীতে অল্প কিছু যানবাহনে অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। কিন্তু আওয়ামী লীগের মত বৃহত্তম এক দলের জন্য এই প্রতিক্রিয়া খুবই বেমানান। দলটি মনে করছে, এই রায় প্রদান করে সরকার শুধু শেখ হাসিনার পরীক্ষা নয় বরং পুরো আওয়ামী লীগ দলের অস্তিত্বকে পরীক্ষা করছে।

বাংলাদেশের রাজনীতিতে সরকার প্রধানের বিরুদ্ধে মামলার রায় প্রদানের উত্থান-পতন ইতিহাস এদেশের মানুষ আগেও দেখেছে। ২০০৭ সালের তত্ত্বাবধায়ক সরকারের মাধ্যমে জরুরি অবস্থার সময় রাজনৈতিক সংকট এবং ক্ষমতার পরিবর্তনের সময়ে বড় দুই রাজনৈতিক দল বিএনপি এবং আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের গ্রেফতার, নানাবিধ মামলা হামলা দিয়ে ভয়াবহ আতঙ্ক, এবং উত্তেজনা বৃদ্ধি করা হয়েছিল। সেসময় মামলা দিয়ে বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া ও আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাকে কারাবন্দী করার ইতিহাস এদেশের মানুষ দেখেছে। আবার আওয়ামী লীগের শাসনামলে শেখ হাসিনার মামলাগুলো প্রত্যাহার করে শুধুমাত্র খালেদা জিয়া এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানকে অনেকগুলো রাজনৈতিক মামলায় অভিযুক্ত করে বিভিন্ন মেয়াদে কারাভোগের সাজা প্রদান করা হয়েছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া মৃত্যুদন্ডের এই রায় প্রদানের মাধ্যমে ইতিহাসের যেন আংশিক পুনরাবৃত্তি হচ্ছে। কিন্তু ব্যতিক্রম হল এবার দণ্ডাদেশপ্রাপ্তরা প্রত্যক্ষ হুকুমদাতা হিসেবে হত্যামামলার আসামি এবং পলাতক অবস্থায় সবাই দেশের বাহিরে অবস্থান করছেন। এই রায় নিয়ে আওয়ামী লীগ রাজনৈতিক বিরোধী দলগুলোর শীর্ষস্থানীয় নেতাদের প্রতিক্রিয়ায় অবশ্য রকমফের রয়েছে। বিএনপি বলেছে, “এ রায় স্বৈরশাসনের বিরুদ্ধে, অন্যায় শাসন ও শোষনের বিরুদ্ধে ন্যায়বিচারের প্রতীক এবং সরকারের দুর্নীতি ও অন্যায়ভাবে ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে জনগণের শক্তিশালী ভুমিকা রাখার সুযোগ।”

বিএনপির বক্তব্য হলো, দীর্ঘদিনের মানবাধিকার লঙ্ঘন, রাজনৈতিক গুম ও হত্যা, প্রশাসনের দলীয়করণ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থাগুলো কে বলপ্রয়োগকারী হিসেবে জনগণের বিরুদ্ধে ব্যবহার করা, বিরোধী রাজনৈতিক প্রতিপক্ষকে মামলা দিয়ে ভয় ভীতি প্রদর্শন করে দমিয়ে রাখার মত বিষয়গুলোর মূলহোতাদের অবশ্যই বিচার হওয়া দরকার ছিল। বিএনপি যদিও এই রায়ে সরাসরি মাঠে নেমে কোন উল্লাস প্রকাশ করছে না, তবে রাজনৈতিকভাবে এটি তাদের জন্য বড় সুযোগ তৈরি করছে। অবশ্য বিএনপির কতিপয় শীর্ষ নেতা এই রায়ের গ্রহনযোগ্যতা ও রাজাকার বিচারের জন্য গঠিত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের এইরকম স্পর্শকাতর রায় প্রদানের সক্ষমতা নিয়ে সমালোচনামুলক বক্তব্যও প্রদান করছেন।

এদিকে জামায়াতে ইসলামী বলছে, এই রায় অতীতের জুলুম, অপরাদ, অবিচার ও অন্যায়ের প্রতিকার এর উদাহরণ এবং ভবিষ্যতের যেকোনো স্বৈরশাসকদের জন্য একটি সতর্কবার্তা। দলটি মনে করছে, বিচার প্রক্রিয়া যদি এইরকম স্বচ্ছভাবে পরিচালিত হয়, তাহলে ভবিষ্যতের রাজনীতিতে শাসনের মানদণ্ড স্থির করা সম্ভব হবে। সকল ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী ন্যায়বিচার এবং সুশাসন নিশ্চিত করতে বাধ্য হবে। অনেক ছাত্র সংগঠনের সাথে ইসলামি ছাত্র শিবিরের কতিপয় নেতাকর্মী ধানমণ্ডি ৩২ নাম্বারের শেখ মুজিবের বাড়ি ভাংচুর করতে বুলডোজার নিয়ে হামলা চালিয়েছিল যা পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর প্রতিরোধ এর জন্য বাতিল করা হয়েছে।

এই বছরের শুরুতে নবগঠিত ও সম্প্রতি নিবন্ধন পাওয়া জুলাই-আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের নেতৃত্ব প্রদানকারী দল হিসেবে দাবি করা এনসিপি শেখ হাসিনার মৃত্যুদন্ডের রায়কে “ঐতিহাসিক ও যুগান্তকারী রায়” বলে আখ্যা দিয়েছে। দলটি বলেছে, জুলাই অভ্যুত্থান সময়কাল শহীদ পরিবার এবং আহত জুলাই যোদ্ধারা ও সকল হাসিনা সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা মানুষ ন্যায় বিচার পেয়েছে। এই রায়ে রাষ্ট্রের প্রধানদের সুশাসন নিশ্চিত করা ও দায়িত্বশীলতার প্রতি সম্মান দেখানো হয়েছে। তারা মনে করছে, এই রায় ভবিষ্যৎ রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বজায় রাখতে এবং অবৈধ শাসনের বিরুদ্ধে জনমতকে শক্তিশালী করতে সহায়ক উদাহরণ হবে।

হেফাজতে ইসলাম এবং ইসলামি আন্দোলনও এই রায়কে গুরুত্ব দিয়েছে। হেফাজতে ইসলাম বলেছে, এই রায়ের ফলে দেশের ইসলামি শাসনব্যবস্থার প্রয়োজনীয়তা, দেশ পরিচালনাকারীদের নৈতিকতা ও সরকার প্রধানের ন্যায়বিচারের প্রশ্ন উঠেছে এবং শাসকরা জনগণের সঙ্গে দায়বদ্ধ থাকবে। ইসলামি আন্দোলন বলেছেন, রায়ে নিহতদের পরিবারের মানুষজন এবং দল হিসেবে তারা খুশি হয়েছে। তারা এটাও বলেছে যে, বিচার ব্যবস্থা পুরোপুরি স্বচ্ছ না হলে এটি রাজনৈতিক অস্থিরতা বাড়াবে। অন্যান্য ইসলামি দলগুলো এ রায়ের ফলে সরাসরি আন্দোলন বা সংঘর্ষের আশঙ্কা দেখাচ্ছে না, তবে দেশের রাজনীতিতে সতর্কবার্তা প্রদান করছে।

এদিকে আওয়ামী লীগের মিত্র হিসেবে সুপরিচিত এবং আওয়ামী লীগের সবচেয়ে সুবিধাভোগী হিসেবে সমালোচিত জাতীয় পার্টি তুলনামূলকভাবে এই রায়ের প্রতিক্রিয়ায় মধ্যমপন্থা অবলম্বন করে শান্ত আছে। দলটি সরাসরি মিডিয়ায় কোন বিবৃতি প্রদান না করলেও বিভিন্ন টক শো এবং মিডিয়ার সামনে দলটির শীর্ষস্থানীয় নেতারা বলছেন যে, যেকোনো অপশাসনের অন্যায়ের বিচার অবশ্যই প্রয়োজন, তবে এত দ্রুতগতিতে একতরফা বিচারকার্য সম্পন্ন করে একজন দীর্ঘমেয়াদে দেশ পরিচালনাকারী প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে রায় প্রদান এদেশের রাজনৈতিক বিভাজন আরও বাড়তে পারে। তারা মনে করছে, দেশের স্থিতিশীলতা রক্ষায় জাতীয় পার্টিকে সাথে রেখে রাজনৈতিক সংলাপ করা জরুরি ছিল কিন্তু এই সরকার জাতীয় পার্টিকে ডাকেনি।

গণ অধিকার পরিষদ ও জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া অনেকগুলো সমমনা রাজনৈতিক দল বলেছে, এ রায় রাজনৈতিক শোষণ, অবিচার, আইনের অপপ্রয়োগ, আইন প্রয়োগকারী সংস্থা দিয়ে বলপ্রয়োগ এবং ক্ষমতার অপব্যবহারের বিরুদ্ধে চরম উদাহরণ হিসেবে গণ্য হবে। তারা নতুন প্রজন্মকে রাজনৈতিকভাবে সক্রিয় হওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। বাম দলগুলো অবশ্য নমনীয় ভুমিকায় কথা বলছে। তারা বলছে, রায় যাই হোক, দেশের গণতন্ত্র অনেক বেশি দুর্বল হয়ে গেছে এবং ভোটের মাঠে  শক্তিশালী রাজনৈতিক সংগঠন ও শক্তিশালী প্রতিপক্ষ ছাড়া মানুষ রাজনৈতিকভাবে নিরাপদ নয়।

এই রায়ের পর বাংলাদেশের সবগুলো জাতীয় সংবাদমাধ্যমের বিশ্লেষণও একাধিক দৃষ্টিকোন থেকে ভিন্ন ভিন্ন মতামত প্রকাশিত হয়েছে। প্রথম আলো বলেছে, এটি ন্যায়বিচারের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্ত, কিন্তু রায়ের প্রক্রিয়ার স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে। ডেইলি স্টার বলেছে, বিচার হওয়া উচিত, তবে রাজনৈতিক প্রভাব থেকে মুক্ত হতে হবে। দৈনিক খোলা কাগজ উল্লেখ করেছে, রায়কে কেন্দ্র করে মানুষদের মধ্যে মিশ্র প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে; কেউ স্বস্তি পেয়েছে, কেউ উদ্বেগে ভুগছে। সোশ্যাল মিডিয়ায় এবং সাধারণ মানুষের আড্ডায় স্পষ্টত এই রায়ের ফলে দেশের জনমত দ্বিখণ্ডিত হয়ে গেছে। সোস্যাল মিডিয়াতে আওয়ামী লীগ বিরোধী এবং জুলাই অভ্যুত্থানে অংশ নেয়া পক্ষগুলোর মতামত দেখলে বোঝা যায় এই রায়ে তারা অনেক খুশি হয়েছে, উচ্ছ্বাস প্রকাশ করছে। অন্যদিকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মী সমর্থনকারীরা ও শেখ হাসিনার সরকারের পক্ষের রাজনৈতিক দলের, সংগঠনের অনেককেই সোস্যাল মিডিয়াতে এই রায়কে সমালোচনা করে মতামত ও পোস্ট দিতে দেখা যাচ্ছে। ১০০১ জন শিক্ষক এবং অনেক সাংবাদিক নেতারাও রায়ের বিরুদ্ধে মিডিয়ার মাধ্যমে বিবৃতি প্রদান করেছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া এই মৃত্যুদন্ডের রায়ের পর আন্তর্জাতিক মিডিয়ার প্রতিক্রিয়াও বহুমাত্রিক। পশ্চিমা সংবাদমাধ্যম ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুনালের বিচার প্রক্রিয়া যথেষ্ট স্বচ্ছ ছিল কিনা এবং প্রশ্নবিদ্ধ ছিল কিনা সরকারের নিকট ব্যাখ্যা চেয়েছে। অ্যামনেস্টি ইন্টারন্যাশনাল ও হিউম্যান রাইটস ওয়াচ মৃত্যুদণ্ডের বিরোধিতা করেছে। ভারতীয় কতিপয় সংবাদমাধ্যম এই রায়কে একতরফা এবং আওয়ামী লীগ নিধনের হাতিয়ার বলে উল্লেখ করেছে। অবশ্য দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার কিছু দেশ এই রায়কে সরকারের দায়বদ্ধতার প্রমাণ হিসেবে প্রশংসা করেছে আবার কিছু দেশ দ্রুতগতিতে এই রায় প্রদানের জন্য সমালোচনাও করেছে। তাই আন্তর্জাতিক অঙ্গনে এই রায়ের প্রতিক্রিয়া কেবল আইনি নয়, রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক প্রভাব এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের ভালো মন্দের নানান দিক নিয়ে অনিশ্চয়তার নতুন সমীকরণের ইংগিত বহন করছে।

শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে দেয়া এই রায় রাজনৈতিকভাবে দেশে ও বিদেশে যে বার্তা দিয়েছে তা স্পষ্ট, “ক্ষমতার অবস্থান কাউকে দায়মুক্ত করতে পারে না। রাষ্ট্রীয় দায়িত্বশীলতা, ন্যায়বিচার এবং জনগণের অধিকার রক্ষা করতে হলে সব সরকারকে শৃঙ্খলাবদ্ধভাবে ন্যায় নীতির মাধ্যমে রাস্ট্র পরিচালনার কাজ করতে হবে।”

কিন্তু আশঙ্কাও আছে। এই রায় দেশের আওয়ামীপন্থী একটা বৃহত্তর জনগোষ্ঠীর ক্ষোভ বাড়িয়ে দিয়েছে। রায় ঘোষণার পর অদ্যাবধি রাজপথে, গণমাধ্যমে, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এই দলের নেতাকর্মী ও সমর্থকদের যে উত্তেজনা দেখা যাচ্ছে, তা স্পষ্টভাবেই রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের নিকট অদৃশ্য ইংগিত দেয় যে, বাংলাদেশ এখন রাজনৈতিক অগ্নিকেন্দ্রে পরিণত হয়েছে। আগামী দিনগুলোতে আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে কেন্দ্র করে দেশের রাজনীতিতে তিনটি প্রধান পরিস্থিতি দেখা দিতে পারে। প্রথমত, আওয়ামী লীগ প্রকাশ্যে কিংবা গোপনে মাঠে নামলে সরকার আরও কঠোর অবস্থান নিতে পারে এবং প্রশাসনের কার্যক্রম আরও সক্রিয় হতে পারে। দ্বিতীয়ত, আওয়ামী লীগ বিরোধী দলগুলোর দলীয় কোন্দল বিভাজন কমতে পারে এবং দলগুলোর একতাবদ্ধ প্রতিবাদ বাড়তে পারে। আওয়ামী লীগকে প্রতিহত করতে তারা রাজপথে আগের মতই আরও শক্তিশালী একতাবদ্ধ প্রতিপক্ষ হিসেবে সক্রিয় হতে পারে। তৃতীয়ত, নতুন অনেকগুলো রাজনৈতিক জোট গঠনের সম্ভাবনা আছ যেখানে বিএনপিকেন্দ্রিক সবচেয়ে শক্তিশালী বড় জোট হবে, জামায়াতে ইসলামী কেন্দ্রিক আরেকটা মধ্যমপন্থার জোট গঠনের সম্ভাবনার সাথে এনসিপি, গণ অধিকার পরিষদ, কতিপয় ডান-বাম দলগুলো একত্রিত হয়ে রাজনৈতিক জোট গঠনের মাধ্যমে মাঠের রাজনীতিতে প্রভাব বিস্তার করতে পারে। এক্ষেত্রে আওয়ামী লীগের বিশাল ভোট ব্যাংকের দিকে নজর দেবার সম্ভাবনা রয়েছে এবং যেকোনো গোপন সমঝোতা হবার সম্ভাবনা ও রাজনীতিতে উড়িয়ে দেয়া যায় না। কারণ রাজনীতিতে শেষ বলে কোন কথা নেই।

আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে এইরকম উদ্ভুত অস্থিতিশীল পরিস্থিতি ডিসেম্বরে তফসিল ঘোষণার পর দেশের রাজনৈতিক পরিবেশকে আরও জটিল করবে এবং ভোটের মাঠে জনমতের ওপর প্রভাব ফেলবে। এদেশের সাধারণ জনগণ এখন বিভ্রান্ত। একদিকে তারা জুলাই গণহত্যার ন্যায়বিচারের দাবি করছে, অন্যদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতা ও বিভাজন তাদের উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। দেশের রাজনীতিতে প্রতিটি পদক্ষেপ, প্রতিটি বক্তব্য এবং প্রতিটি আন্দোলন সাধারণ নিরীহ জনগণের জীবনে সরাসরি নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। তাই জনগণ এখন লক্ষ্য রাখছে কোন রাজনৈতিক দল সত্যিই দেশের গণতন্ত্রকে দেশীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে রক্ষা করতে পারবে, শক্তভাবে দেশ পরিচালনা করতে পারবে এবং কোন দল যেকোনো উছিলায় শুধুমাত্র ক্ষমতায় আসার জন্য রাজনীতি করবে।

শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ড কেবল একজন ব্যক্তির বিচার নয়। এটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতি, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া, বিচারব্যবস্থা, আন্তর্জাতিক অবস্থান, ভৌগলিক ভূরাজনীতি এবং ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের ওপর একটি বড় পরীক্ষা। বাংলাদেশের মানুষ এবং আন্তর্জাতিক মহল সবাই এখন এই রায়ের ফলে কি হতে পারে এর ওপর চোখ রাখছে। এই রায় কি সত্যিই বাংলাদেশে ন্যায়বিচারের সূচনা করবে, নাকি নতুন রাজনৈতিক বিভাজনের জন্ম দেবে? যদিও আপাতদৃষ্টিতে এই প্রশ্নের উত্তর আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হাতে, কিন্তু নিশ্চিত উত্তর একটাই- বাংলাদেশ আর আগের বাংলাদেশ থাকবে না। দেশের রাজনৈতিক নেতৃত্বের চিন্তা ভাবনার আমুল পরিবর্তন করতে হবে, দেশ পরিচালনাকারী ভবিষ্যৎ সরকারকে জুলাই সনদের ৪টি হ্যা-না ভোটের উত্তরের মাধ্যমে নতুনভাবে নীতি, সংস্কার ও আইন গঠন করতে হবে। আগামীর বাংলাদেশে প্রতিটি দলের অবস্থান হবে সুশাসন নিশ্চিত করা, জনগণের বিশ্বাস ফিরিয়ে আনা এবং রাজনৈতিক মতনৈক্য নিরসনে দমন পীড়নের পরিবর্তে সংলাপই দেশের সুন্দর রাজনৈতিক ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে।

লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও শিক্ষাবিদ, ডীন ও চেয়ারম্যান, ব্যবসায় প্রশাসন বিভাগ, ঢাকা ইন্টারন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি

কেকে/ আরআই
আরও সংবাদ   বিষয়:  হাসিনা   মৃত্যুদণ্ড   রাজনৈতিক বিভাজন  
মতামত লিখুন:

সর্বশেষ সংবাদ

গাজীপুরে রেলওয়ে স্টেশন পরিদর্শনে প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী
টস জিতে ফিল্ডিংয়ে বাংলাদেশ
স্বাধীনতার ৫৪ বছর পরেও অবকাঠামো সংকট, চরমে দুর্ভোগে বিয়ানীবাজারবাসী
আবুল সরকারকে মুক্তি দিলে অবস্থান কর্মসূচির ঘোষণা মাদানীর
অনাকাঙ্খিত মৃত্যু থেকে বাঁচার দোয়া

সর্বাধিক পঠিত

পঞ্চগড়-২ আসনে গণঅধিকার পরিষদের প্রার্থী আসাদুজ্জামান নূর
নাটোর-১ আসনে এবি পার্টির প্রার্থীর বিলবোর্ড ভাঙচুরের অভিযোগ
ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ফের ভূমিকম্প
পাটগ্রাম উপজেলায় সীমান্ত সুরক্ষা জোরদারে 'চতুরবাড়ী বিওপি'র যাত্রা
থাইল্যান্ডে যাচ্ছে তরুণ উদ্ভাবক দল সায়েন্স অ্যান্ড রোবটিকস ক্লাব

খোলা মত ও সম্পাদকীয়- এর আরো খবর

সম্পাদক ও প্রকাশক : আহসান হাবীব
বার্তা ও বাণিজ্যিক কার্যালয় : বসতি হরাইজন, ১৭-বি, বাড়ি-২১ সড়ক-১৭, বনানী, ঢাকা-১২১৩
ফোন : বার্তা-০২২২২২৭৬০৩৭, মফস্বল-০২২২২২৭৬০৩৬, বিজ্ঞাপন ও সার্কুলেশন-০২২২২২৭৬০২৯, ০১৭৮৭৬৯৭৮২৩, ০১৮৫৩৩২৮৫১০ (বিকাশ)
ই-মেইল: [email protected], [email protected]

© 2025 Kholakagoj
🔝
close