বাংলাদেশের রাজনীতিতে তৃণমূল জনগোষ্ঠীর অবিচল আস্থা ও আবেগের নাম তারেক রহমান। তার রাজনৈতিক উত্থানের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ অর্জন হলো- তিনি তৃণমূল মানুষের কণ্ঠস্বর হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছেন। বিভিন্ন সময়ে তার দল ক্ষমতায় থাকলেও তিনি কখনো সরাসরি সরকারে ছিলেন না। তার পরেও শহর থেকে গ্রাম-গঞ্জে ছুটে বেড়িয়েছেন স্থানীয় মানুষের সমস্যার কথা শুনতে। সমাধানও দিতেন স্থানীয়দের বাস্তব অভিজ্ঞতা ও বিশেষজ্ঞদের পরামর্শের ভিত্তিতে। এ ধারা এখনো বিদ্যমান রেখেছেন তিনি তার আপন কর্মে।
২০০১-২০০৬ সময়কালে তিনি বিএনপির অঙ্গ-সংগঠনগুলোর সাংগঠনিক কার্যক্রমে অনানুষ্ঠানিকভাবে যুক্ত থাকলেও তার সবচেয়ে বড় ভূমিকা ছিল তৃণমূলের রাজনৈতিক চর্চাকে নতুনভাবে সক্রিয় করা। তিনি দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে ভ্রমণ করেছেন, জেলা-মহানগরের নেতা-কর্মী থেকে শুরু করে সাধারণ কৃষক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী, শ্রমিক, শিক্ষক, মাদ্রাসাছাত্র বা স্থানীয় সমাজ প্রতিনিধিদের সঙ্গে সরাসরি মতবিনিময় করেছেন। যা তাকে দলের বাইরেও সাধারণ মানুষের কাছে আপন করে তোলে।
রাজনীতির প্রচলিত ঐতিহ্যে যেখানে কেন্দ্রীয় নেতৃত্ব অইেশ সময় তৃণমূল থেকে দূরে থাকে, সেখানে তারেক রহমান উল্টো দিকটি বেছে নিয়েছিলেন। তিনি কেন্দ্র নয়, বরং তৃণমূলকেই রাজনীতির ভিত্তি হিসেবে বিশ্বাস করতেন। তারেক রহমান দলীয় রাজনীতিকে কেন্দ্র থেকে প্রান্তে ছড়িয়ে দিয়েছেন এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর নিজস্ব কণ্ঠস্বর হয়ে কাজ করেছেন। যা তাকে বানিয়েছে অনন্য-মহান। একজন তরুণ রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব হিসেবে তার যে রাজনৈতিক দর্শন সামনে এসেছে, তার মূল কেন্দ্রে ছিল মানুষের কাছে যাওয়া, তাদের কথা শোনা এবং স্থানীয় সমস্যাকে জাতীয় রাজনীতির সঙ্গে সংযুক্ত করা।
তারেক রহমান ২০০১-২০০৬ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশের প্রতিটি জেলায় ঘুরে বেড়িয়েছেন তৃণমূল মানুষের কথা শুনতে। তখন দেশের ৬৪টি জেলাকে ২০টি সেক্টর ভাগ করে প্রতিটি সেক্টরে তিনি একটি করে কনফারেন্স করেছিলেন। যেখানে অঞ্চলভিত্তিক খেটে খাওয়া দিনমজুর, কৃষক জেলেসহ সাধারণ মানুষের কথা শুনতেন। মানুষের অভিযোগের ভিত্তিতে সমস্যা ও সমাধান নির্ণয় করে প্রতিটি অঞ্চলভিত্তিক আলাদা আলাদা সুপারিশমালা তৈরি করেছেন। সে সময় তিনি সারা দেশের জন্য প্রায় ৮০টি সুপারিশমালা তৈরি করে তা মা প্রধানমন্ত্রী বেগম খালেদা জিয়ার হাতে তুলে দিয়েছিলেন। পাশাপাশি নিজ হাতে সব জেলার খাল ও নদী নালার মানচিত্র তৈরি করেছিলেন উন্নয়নের লক্ষ্যে।
এই ২০টি কনফারেন্সের বাহিরেও তিনি নিয়মিত রোড-মিটিং, ছোট বৈঠক, স্থানীয় সংগঠনের আলোচনা ও মতবিনিময় করতেন। সেসব পর্বেও মানুষের প্রধান দাবিগুলো প্রায় একই ছিল। কৃষি প্রণোদনা, খেতমজুরের ন্যায্যমূল্য, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীদের পুঁজি সংকট, ইউনিয়ন-পর্যায়ের স্বাস্থ্যসেবা, পানি-সেচব্যবস্থা, শিক্ষার মান, গ্রামীণ সড়ক এবং স্থানীয় সিদ্ধান্ত গ্রহণে জনগণের অংশগ্রহণ। তিনি মনে করতেন, গ্রামের একজন কৃষকও দেশের নীতি নির্ধারণে পরোক্ষভাবে ভূমিকা রাখেন, তাই তার কথাও গুরুত্বপূর্ণ।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে নিয়ে তারেক রহমানের সেই রাজনীতি আজও বিদ্ধমান রয়েছে। তার জলন্ত প্রমাণ আমরা দেখেছি গত ১২ নভেম্বর। ওই দিন ‘জাতীয় বিপ্লব ও সংহতি দিবস’ উপলক্ষে বিএনপি আয়োজিত এ সভায় তারেক রহমান গতানুগতীক বক্তব্য দেননি। সে দিনও তিনি বাবা-মায়ের প্রশংসা করে পুরো বক্তৃতায় শেষ করতে পারতেন। কারণ দিনটি তো ঐতিহাসিক ছিল। কিন্তু না, সেই গুরুত্বপূর্ণ অনুষ্ঠানেও তিনি প্রান্তিক মানুষের কথা বলেছিলেন।
তারেক রহমান সাধারণ আলুচাষিদের মনের কথা তুলে ধরেন তার সেদিনের বক্তব্যে। তিনি বলেছিলেন, ‘এই সময়ে গণভোটের চেয়ে আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়া এবং পেঁয়াজের সংরক্ষণাগার স্থাপন কৃষকদের কাছে অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। কারণ চাষিরা বাঁচলে দেশের অর্থনীতি বাঁচবে। অর্থনীতি বাঁচলে দেশ বাঁচবে। গণভোট না হলে দেশের তেমন ক্ষতি হবে না।’
তিনি আরো বলেছেন, ‘আলু চাষ করে আলুচাষিরা এবার প্রায় ৩ হাজার কোটি টাকা লোকসানের আশঙ্কা করছেন। অপরদিকে আমরা দেখি দু-একটি রাজনৈতিক দলের আবদার মেটাতে গিয়ে কথিত গণভোট যদি করতে হয়, রাষ্ট্রকে প্রায় সমপরিমাণ টাকা গচ্চা দিতে হবে। এমন পরিস্থিতিতে লোকসানের মুখোমুখি এসব আলুচাষির কাছে এ সময়ে গণভোটের চেয়ে মনে হয় আলুর ন্যায্যমূল্য পাওয়াটা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। জনগণের হাজার হাজার কোটি টাকা ব্যয় করে কথিত ‘গণভোট উৎপাদনের’ চেয়ে সেই টাকায় পেঁয়াজ সংরক্ষণাগার স্থাপন কৃষকদের কাছে বেশি গ্রহণযোগ্য।
একটি বিষয় স্পষ্ট- তারেক রহমানের নেতৃত্ব ছিল কেবল কেন্দ্রীয় নির্দেশনার ভিত্তিতে নয়, বরং তা গড়ে উঠেছিল মাঠের বাস্তবতা ও কর্মীদের মতামতকে অগ্রাধিকার দেওয়ার মাধ্যমে। এ কারণেই বিএনপির ভেতরে তিনি ‘তৃণমূলের রাজনীতি’ শব্দটিকে বারবার সামনে আনতেন। দলীয় সংগঠনকে তিনি প্রায়ই তুলনা করতেন একটি বিশাল বটবৃক্ষের সঙ্গে। যার শিকড় শক্ত না হলে কাণ্ড বা ডাল-পালা কোনোটিই স্থায়ী হয় না। তার রাজনীতিতে ‘শিকড়’ বলতে তিনি বুঝিয়েছেন গ্রাম, মফস্বল, ইউনিয়ন, ওয়ার্ড এবং সেখানে বসবাসকারীরা হলেন সাধারণ মানুষ।
তার কর্মকাণ্ডের একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ ছিল তরুণদের রাজনীতিতে যুক্ত করা। তিনি দেখেছিলেন- তৎকালীন সময়ে রাজনীতিতে নতুন প্রজন্মের অংশগ্রহণ কমে আসছিল এবং রাজনীতি ক্রমে ‘শীর্ষনির্ভর’ হয়ে পড়ছিল। তাই তিনি যুবসমাজকে সংগঠিত করতে মাঠপর্যায়ের বৈঠক করেছেন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে মতবিনিময় করেছেন এবং অনেক তরুণকে সরাসরি রাজনীতিতে আগ্রহী করেছেন। এতে করে তিনি রাজনৈতিক প্রক্রিয়ায় একধরনের প্রজন্মান্তরের সেতুবন্ধ তৈরি করতে সক্ষম হন।
গ্রামীণ অর্থনীতি, কৃষকের সমস্যা, সেচব্যবস্থা, স্থানীয় প্রশাসনের দুর্বলতা, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সংকট- এগুলো নিয়ে তিনি নিয়মিত মানুষের মতামত শুনতেন। দলীয় সংস্কার, সাংগঠনিক বিকেন্দ্রীকরণ এবং নীতি-পর্যালোচনা- এসব প্রসঙ্গেও তিনি তৃণমূলের মতামতকে অপরিহার্য বলে মনে করেন।
তারেক রহমান বিশ্বাস করেন, রাজনীতি মানে কেবল কেন্দ্রীয় কক্ষের সিদ্ধান্ত নয়; বরং ইউনিয়নের একজন কৃষক, শ্রমিক, দোকানি বা শারীরিক শ্রমে নিয়োজিত একজন নীরব মানুষের অনুভূতি ও সংকটও জাতীয় এজেন্ডার অংশ। তারেক রহমানের রাজনৈতিক পরিচয়কে তাই কেবল দলের উচ্চস্তরে সীমাবদ্ধ করা যায় না; বরং তার রাজনৈতিক ক্যারিয়ারের বড় অংশ গড়ে উঠেছে মাঠের মানুষের গল্প, কষ্ট, স্বপ্ন ও প্রত্যাশার ওপর।
এ কারণে অনেকেই তাকে এখনো তৃণমূল মানুষের নেতা হিসেবে মনে করেন। রাজনৈতিক প্রতিদ্বন্দ্বিতার বাইরে গিয়েও বলা যায়- বাংলাদেশের রাজনীতিতে জনগণের সঙ্গে সরাসরি সংযোগ স্থাপনের যে সংস্কৃতি তৈরি হয়েছিল, তারেক রহমান সেই ধারার একজন গুরুত্বপূর্ণ প্রতিনিধি। প্রান্তিক মানুষের কাছে গিয়ে তাদের কথা শোনা, সমস্যাগুলো নথিবদ্ধ করা এবং দলীয় নীতিতে অন্তর্ভুক্ত করার যে প্রক্রিয়া তিনি অনুসরণ করেছিলেন- তা তাকে বাংলাদেশের তৃণমূল রাজনীতির এক স্বতন্ত্র প্রতীকে পরিণত করেছে।
তারেক রহমানের রাজনৈতিক হাতেকড়ি বাবা শহীদ প্রেসিডেন্ট জিয়াউর রহমান ও মা বেগম খালেদা জিয়ার কাছ থেকে। বাবা জিয়াউর রহমান যেমন ছিলেন, প্রান্তিক মানুষের কণ্ঠস্বর ঠিক ছেলে তারেক রহমানও সেই পথ ধরে হয়ে উঠেন উত্তরসূরি। বাবা মায়ের মতো তাকেও প্রায় একই ধরনের পথ পাড়ি দিতে হয়েছে। বগুড়া থেকে তিনি দলের প্রাথমিক সদস্যপদ পেয়ে যুক্ত হন রাজনীতিতে। এরপর সাংগঠনিক দায়িত্ব ও নির্বাচনি কাজে দক্ষতা দেখিয়ে ধীরে ধীরে সামনে এগিয়ে আসেন। ‘একটি উদ্যোগ, একটু চেষ্টা/এনে দেবে সচ্ছলতা’- এই স্লোগানকে সামনে রেখে জিয়া ফাউন্ডেশনের মাধ্যমে তিনি গ্রাম থেকে শহরে বিস্তৃত বিভিন্ন সামাজিক উদ্যোগ পরিচালনা করেছেন। শহীদ জিয়ার স্বনির্ভর আন্দোলনের সঙ্গে তার এসব কর্মকাণ্ডের মিল রয়েছে ওতপ্রোতভাবে।
২০০১ সালের নির্বাচনের আগে, তিনি স্থানীয় পর্যায়ের সমস্যা এবং সুশাসনের উপর গবেষণা করার জন্য ঢাকায় একটি অফিস প্রতিষ্ঠা করেন। যেটি ‘হাওয়া ভবন’ নামে পরিচিতি পায়। সেখানে বুদ্ধিজীবী ও সুশীল সমাজের সদস্যদের সঙ্গেও তিনি আলোচনা করতেন। গবেষণা ও উন্নয়ন চিন্তার কেন্দ্র হিসেবে শুরু করলেও গৃহপালিত মিডিয়াকে ব্যবহার করে ‘হাওয়া ভবন’কে অভিশপ্ত বাড়ি বানিয়ে ছেড়ে ছিল আওয়ামী লীগ গং।
তার প্রচেষ্টায় ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপি নিরঙ্কুশ বিজয় লাভ করে। চেয়ারপারসনের ছেলে হয়েও এবং তৃণমূল থেকে ব্যাপক সমর্থন পাওয়া সত্ত্বেও তিনি স্বজনপ্রীতি করে কোনো মন্ত্রিত্ব বা সংসদ সদস্যপদ গ্রহণ না করে দলের তৃণমূলের ক্ষমতায়নে মনোনিবেশ করেন। দল সংগঠনে তার প্রচেষ্টার স্বীকৃতি হিসেবে ২০০২ সালে স্থায়ী কমিটি তাকে বিএনপির সিনিয়র যুগ্ম সম্পাদক পদে মনোনীত করে। ২০০৫ সালে, তিনি দেশব্যাপী তৃণমূল সম্মেলন আয়োজন করেন এবং বাংলাদেশের প্রতিটি উপজেলা ইউনিটের সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এই সম্মেলনের সময় তিনি তৃণমূল নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলা, স্থানীয়দের সঙ্গে মতবিনিময় করা এবং সমর্থকদের চিন্তাধারা শোনেন এবং জনগণের কাছে বিএনপির কর্মসূচি প্রচার করেছেন।
তিনি কৃষকদের জন্য সরকারি ভর্তুকি, বয়স্কদের জন্য ভাতা, পরিবেশগত ভারসাম্য বজায় রাখার জন্য প্লাস্টিক ব্যাগ বিরোধী আন্দোলন, এবং নারী শিক্ষার্থীদের জন্য উপবৃত্তি বিতরণ সম্পর্কে জনগণকে অবহিত করেন, যা স্কুলে লিঙ্গভিত্তিক বৈষম্য কমিয়ে ভারসাম্য আনতে সহায়ক হয়। তিনি ব্যক্তিগতভাবে সম্মেলনে নিবন্ধনকারীদের অন্তত ১৮ হাজার চিঠির উত্তর দেন।
কিন্তু আজ অন্তর্বর্তী সরকার অনেক সংস্কারের কথা বলছে। কমিশনগুলো তাদের প্রস্তাবও পেশ করেছে। কিন্তু সেই প্রস্তাবে কি তৃণমূলের প্রান্তিক সেই কৃষকের কথা উঠে এসেছে? খেটে খাওয়া মানুষের মনের কথা কি প্রকাশ পেয়েছে? দেশের অন্যতম প্রধান সদস্যা সড়ক দুর্ঘটনা। সেই দুর্ঘটনা রোধে কি কোনো কথা বলা হয়েছে? গ্রামের অর্থনীতিকে কীভাবে উন্নয়ন করা যাবে সেই প্রস্তাব কি রাখা হয়েছে? অথচ এসবের বিস্তারিত প্রকাশ পেয়েছে তারেক রহমানের ৩১ দফা কর্মসূচিতে।
প্রায় ৮ বছর আগে প্রখ্যাত আইনজীবী ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম তারেক রহমান সম্পর্কে বলেছিলেন, আমার মনে হয় কেউ যদি সত্যিকার পলিটিশিয়ান হিসেবে থাকেন, সে হচ্ছে তারেক রহমান। কারণ, তারেক রহমান পলিটিক্সে যুক্ত গোড়া থেকেই। অন্যরা তো কেউ পলিটিশিয়ান না। তারেক রহমান তো পুরানা পলিটিশিয়ান।
লেখক : সাংবাদিক, লন্ডন, যুক্তরাজ্য
কেকে/ আরআই