বাংলাদেশের বিচারব্যবস্থায় শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডাদেশ একটি ঐতিহাসিক ঘটনা। রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ ক্ষমতায় একসময় যিনি ছিলেন, সেই সাবেক প্রধানমন্ত্রীর বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধে বিচার ও সর্বোচ্চ দণ্ডাদেশ এটিই প্রমাণ করে যে, কেউই বিচারের ঊর্ধ্বে নয়। দীর্ঘদিন ধরে বাংলাদেশে ক্ষমতাসীনদের বিচারের ঊর্ধ্বে থাকার যে সংস্কৃতি দেখা গেছে, সেখানে এ রায় আইনের শাসনের একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত।
জুলাই অভ্যুত্থানকালে শত শত মানুষের মৃত্যু, হাজার হাজার মানুষের গুরুতর আহত হয়ে অঙ্গহানি ও বিকলাঙ্গ হওয়ার ঘটনার জন্য যে নৃশংস শাসক দায়ী ছিলেন, ১৭ নভেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে সেই শেখ হাসিনার মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। একইসঙ্গে তার প্রধান সহযোগী সাবেক স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খানেরও মৃত্যুদণ্ডের আদেশ হয়েছে। এ রায় দেশের ভবিষৎ শাসকদের জন্যও একটি দৃষ্টান্ত হতে পারে, জুলুম ও শোষণের শেষ পরিণতি কি হয় তারা এটিকে তার নজির হিসেবে দেখতে পারে।
দীর্ঘ ১৭ বছরের আওয়ামী শাসনামলে জেল, জুলম, গুম ও খুনের শিকার হতে হয়েছে বিরোধী মত পোষণকারীদের। বিরোধী রাজনৈতিক দলগুলোর কর্মীদের নামে দেওয়া হয়েছিল হাজার হাজার মিথ্যে মামলা। বিরোধী দলের কেউ রাজনৈতিক কর্মসূচি করতে আসলে তাদের নিজেদের ছাত্রসংগঠন, ছাত্রলীগ দিয়ে প্রতিহত করা হতো, আওয়ামী লীগ ক্ষমতার চর্চায় ঐতিহাসিক ছাত্রলীগকে একটি লাঠিয়াল বাহিনী তথা হেলমেটে বাহিনীতে রূপান্তরিত করে ফেলেছিল। তাদের অপকর্মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তুললে শিকার হতে হতো গুম, খুনের, দায়ের হয়ে যেত বিচিত্রসব মামলা। আবরার ফাহাদ হত্যা তার একটি উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। পুলিশ, আমলা, সেনাবাহিনী থেকে শুরু করে দেশগড়ার কারিগর বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরও এমনভাবে কলুষিত করা হয়েছিল যে, রাষ্ট্রের এসব নিরপেক্ষ প্রতিষ্ঠানগুলো আওয়ামী লীগের পক্ষে সম্মতি উৎপাদন ও ক্ষমতা ধরে রাখার অনুঘটক হিসেবে কাজ করত। প্রতিটা ক্ষেত্রে দল এবং রাষ্ট্র একাকার হয়ে গিয়েছিল যার কুফল আমরা এখনো ভোগ করছি। ফলে ১৭ নভেম্বরের রায় দেশের ইতিহাসে তাৎপর্যময়।
প্রথমত, এটি প্রমাণ করেছে যে, দেশের বিচারব্যবস্থা রাজনৈতিক বা প্রশাসনিক ক্ষমতার প্রভাবকে অতিক্রম করার সক্ষমতা অর্জন করেছে অন্তত সে সক্ষমতার প্রকাশ ঘটিয়েছে। যারা রাষ্ট্র পরিচালনা করেছেন, বছরের পর বছর ক্ষমতার কেন্দ্রে ছিলেন, তাদের বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তা বিচার পর্যন্ত পৌঁছানোই কঠিন হয়। আর সেখানে সর্বোচ্চ শাস্তি ঘোষণার মতো সিদ্ধান্ত একটি শক্ত বার্তা দেয়। আইন কারো প্রতি নমনীয় নয়, ক্ষমতাধরদের প্রতিও নয়।
দ্বিতীয়ত, শেখ হাসিনার দণ্ডাদেশ ভবিষ্যতের বিচারব্যবস্থার মানদণ্ড হিসেবে একটি নতুন মাইলফলক। এটি দেখিয়েছে যে, যে কোনো ব্যক্তি, যার বিরুদ্ধে গুরুতর অভিযোগ রয়েছে- মানবাধিকার লঙ্ঘন, ক্ষমতার অপব্যবহার বা রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধ- তাকে বিচারকের টেবিলের সামনে দাঁড়াতে হবে, তার অবস্থান বা রাজনৈতিক পরিচয় যা-ই হোকনা কেন। এ বার্তা শুধু বর্তমানের জন্য নয়; এটি ভবিষ্যতের প্রজন্মের জন্য রাষ্ট্রের এক মূল্যবান শিক্ষা ‘আইন সবার জন্যই সমান’।
এ রায়ের মাধ্যমে বিচারব্যবস্থা যে বার্তা দিয়েছে, তা আগামী দিনের বাংলাদেশে আইন শাসনের ভিত্তিমূলকে আরো দৃঢ় করবে- এটাই প্রত্যাশা।
কেকে/ এমএ